সারাক্ষণ ডেস্ক
দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে রোববার মুয়ান-গুনে (সাউথ জেওলার প্রদেশ) মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হওয়ার পর, দেশটির ছয়টি এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা সব বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজে সর্বাত্মক নিরাপত্তা পরীক্ষা চালানো হবে।
পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এভিয়েশন টেকনিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, যেসব যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ আন্তর্জাতিক রুটে ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪০০টিরও বেশি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিদ্যমান, যার মধ্যে ১০১টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ নিবন্ধিত আছে। রোববারের দুর্ঘটনায় এই মডেলের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়, যা দেশের মাটিতে সর্বাধিক প্রাণহানির বিমান দুর্ঘটনা।
সোমবার দুপুরে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এভিয়েশন পলিসি ব্যুরোর প্রধান, জু জং-ওয়ান জানান, এক সপ্তাহব্যাপী বিশেষ নিরাপত্তা পরীক্ষা শুক্রবার পর্যন্ত চলবে। তিনি আরও বলেন, এ সময় বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের সবগুলো উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, ল্যান্ডিং গিয়ার এবং অন্যান্য ফ্লাইট অপারেটিং সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণ ইতিহাস পরীক্ষা করে দেখা হবে।
১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে প্রথম উড্ডয়ন করা বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলটি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কয়েকটি লো-কস্ট এয়ারলাইন্স ব্যবহার করে, যার মধ্যে জেজু এয়ার রয়েছে—রোববারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটি ছিল তাদেরই ফ্লাইট। টি’ওয়ে, ইস্টার জেট, এয়ার ইনচন এবং দেশের পতাকাবাহী এয়ারলাইন কোরিয়া এয়ার লাইনস-ও এই মডেল ব্যবহার করে।
সোমবার সকালের এক ব্রিফিংয়ে পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এভিয়েশন সেফটি পলিসির প্রধান, ইউ কিয়ং-সু বলেন, “আমরা (এয়ারলাইন্সগুলোর) রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় কোনও বিলম্ব বা নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা আছে কি না, তা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করব।”
পরিবহন মন্ত্রণালয় আরও জানায়, জেজু এয়ারের বিরুদ্ধে “উচ্চ-স্তরের পরীক্ষা” শুরু হয়েছে। কারণ, সোমবার জেজু দ্বীপ থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আরেকটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ল্যান্ডিং গিয়ার নিয়ে সন্দেহজনক ত্রুটির কারণে জরুরি অবতরণ ঘোষণা করে, পরে ইনচন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে diverted হয়ে যায়।
জু জং-ওয়ানের বক্তব্য অনুযায়ী, উক্ত দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের দুইজন কর্মকর্তা এবং বোয়িং কোম্পানির দুইজন প্রতিনিধি মিলে যৌথ তদন্ত করবে। ইঞ্জিন নির্মাতা সিএফএম ইন্টারন্যাশনাল-ও এতে অংশ নিতে পারে।
সোমবার দুপুরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি চোই সাং-মক দক্ষিণ কোরিয়ায় বিমান চলাচল ব্যবস্থার সার্বিক তদারকি ও পর্যালোচনার নির্দেশ দেন। তিনি পরিবহন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন যেন “দক্ষিণ কোরিয়ার গোটা ফ্লাইট সিস্টেমের ওপর জরুরি নিরাপত্তা পরীক্ষা” চালানো হয়, যাতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটে। দুর্ঘটনার তাৎক্ষণিক পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো সম্পন্ন হওয়ার পরই এই পরীক্ষা শুরু হবে।
সেই একই দিনে সিওলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ সভায় চোই সভাপতিত্ব করেন। সংসদ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ল ও প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সুকে অভিশংসিত করায়, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন চোই। তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
পরে, চোই জাতীয় সংসদের স্পিকার উ উন-শিকের সঙ্গে একটি বন্ধ দরজার বৈঠক করেন। স্পিকারের প্রতিনিধির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা দুর্ঘটনার পরবর্তী পদক্ষেপ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর সহায়তার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
রোববার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেজু এয়ারের ফ্লাইট বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক চলমান। সরকারের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, সোমবার বিকেল পর্যন্ত ১৭৯ জন মৃত যাত্রীর মধ্যে ১৪৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত যে ল্যান্ডিং গিয়ারের ত্রুটির কারণেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে কী কারণে ল্যান্ডিং গিয়ারের ত্রুটি হয়েছে, সে বিষয়ে মতভেদ আছে।
কেউ কেউ মনে করছেন, পাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগে এ ত্রুটি দেখা দেয়। আবার কেউ প্রশ্ন তুলছেন, কেন বাড়তি ব্রেকিং সিস্টেম কাজ করেনি বা রানওয়ের শেষে থাকা কংক্রিটের দেয়ালটি নিয়ে। দুর্ঘটনার পরে আগুন লাগার বিষয়টিও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এদিকে, দুর্ঘটনার তদন্ত চলতে থাকায় পরিবহন মন্ত্রণালয় জানায় যে, ১৭৯ জনের মরদেহই আপাতত বিমানবন্দরের হ্যাংগারে তৈরি অস্থায়ী মর্গে রাখা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা দিন-রাত এক করে মৃতদেহ শনাক্তকরণ ও নমুনা সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছে, পরিচয় শনাক্ত ও ফরেনসিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর পরিবারগুলোর কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে।
জেজু এয়ারের দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনেরা মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রথম তলায় একটি যৌথ স্মৃতিসৌধ স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যাতে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থেকেই তাদের প্রিয়জনদের স্মরণ করতে পারেন।
যদিও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুয়ান স্পোর্টস পার্কে একটি যৌথ স্মৃতিবেদী স্থাপন করা হয়েছে, অনেকেই বিমানবন্দরের কাছেই এই স্মরণস্থল তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।
স্বজনদের প্রতিনিধিরা শেষকৃত্যের বিষয়েও আলোচনা করেন। তাদের মত, যতক্ষণ পর্যন্ত সব মরদেহ উদ্ধার ও শনাক্ত না হবে, ততক্ষণ যেন কোনো শেষকৃত্য সম্পন্ন না হয়। তবে কেউ কেউ ব্যক্তিগত পরিস্থিতির কারণে কিছুটা আগেভাগে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে হতে পারে, সে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।
বিরহী পরিবারগুলোর প্রতিনিধি পার্ক হান-সিন বলেন, এখনো প্রায় ২০টি মরদেহ শনাক্তের অপেক্ষায় আছে। তাই সব পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত কাজ স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান তিনি। তিনি মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে থাকা স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, “পরিবারগুলোর কাছে অনুরোধ, দয়া করে কেউ আলাদাভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন না।”
কেউ কেউ জানিয়েছেন, নিজের পরিবারকে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। তবে অন্যরা বলছেন, প্রতিনিধির পরামর্শ অনুযায়ী যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। একজন মন্তব্য করেন, “একসঙ্গে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করাটাও ভালো হবে।”
এভাবে তারা নিজেদের ভাবনা বিনিময় করছেন, সর্বশেষ আপডেট তুলে ধরছেন এবং প্রিয়জনদের শান্তিতে চিরবিদায় জানাতে সেরা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন।
এদিকে, সাউথ জেওলার প্রাদেশিক সরকার জানিয়েছে যে দুর্ঘটনায় হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং জনসাধারণের অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ দিতে প্রদেশের ২২টি শহর ও কাউন্টিতে আলাদা স্মৃতিবেদী স্থাপন করা হবে।
দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিবহন মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত সহায়তা কেন্দ্র চালুর ঘোষণা দিয়েছে। মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত এই কেন্দ্র কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
আইনজগত থেকেও সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শেষ হলে দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একাধিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের হতে পারে। গওয়াঞ্জু বার অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে একটি আইনি সহায়তা টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, যাতে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা যায়।
এই অ্যাসোসিয়েশন থেকে স্বেচ্ছাসেবী আইনজীবী সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের সদস্য সংগ্রহ সোমবারের মধ্যে শেষ হবে। টাস্কফোর্স মঙ্গলবার থেকেই কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। গওয়াঞ্জু সিটি ও সাউথ জেওলার প্রাদেশিক প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি সহায়তা দেবে এই টাস্কফোর্স।
Leave a Reply