বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:২১ পূর্বাহ্ন

কীভাবে জিমি কার্টার আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনেছিলেন?

  • Update Time : সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৬.১০ পিএম

স্টুয়ার্ট ই. আইজেনস্টাট

১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এক গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন হন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তিনি ক্যাম্প ডেভিডে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল-সাদাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনকে নিয়ে ঐতিহাসিক এক শান্তি চুক্তির রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করছিলেন। কঠোর মনোভাবাপন্ন বেগিন অনেক বিষয়ে অনড় থাকলেও কার্টার সরাসরি ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশে দায়ানপ্রতিরক্ষামন্ত্রী এজার ওয়েইজম্যান এবং আইনি উপদেষ্টা আহারন বারাকের সঙ্গে আলোচনা করে বিপুল অগ্রগতি সাধন করেন। কিন্তু ত্রয়োদশ দিনে বেগিন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়ে দেনআর কোনো ছাড় দেওয়া সম্ভব নয় এবং তিনি চলে যাচ্ছেন। কার্টার তাঁর পুরো প্রেসিডেন্ট-সুয়ামি ঝুঁকিতে রেখে যে আলোচনা চালিয়ে আসছিলেনতা প্রায়ই বিফল হওয়ার পথে ছিল।

ঠিক তখনই কার্টার এক ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নেন। তিনি জানতেনবেগিনের আটজন নাতি-নাতনি আছে এবং তিনি তাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল। তাই কার্টার তিন নেতাকার্টারসাদাত ও বেগিনএকসঙ্গে থাকা কয়েকটি স্বাক্ষরিত ছবি প্রতিটি নাতি-নাতনির নামে উৎসর্গ করে স্বাক্ষর করেন। এরপর নিজে বেগিনের কেবিনে গিয়ে ছবিগুলো পৌঁছে দেনযেখানে বেগিন বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেগিন যখন তার নাতি-নাতনিদের নাম পড়ছিলেনতখন তার ঠোঁট কাঁপছিল এবং চোখে পানি চলে এসেছিল। তিনি ব্যাগ নামিয়ে রাখলেন। সেদিনই পরে তিনি সাদাতের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছানযার ভিত্তিতে ছয় মাস পর স্বাক্ষরিত হয় মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি।

১৯৮১ সালের গোড়ার দিকে কার্টার ক্ষমতা ত্যাগ করার পর ওয়াশিংটনে সাধারণভাবে মনে করা হতোতাঁর পররাষ্ট্রনীতি ছিল ব্যর্থ। তিনি তাঁর মেয়াদের শুরুতেই বলেছিলেন যে তিনি কমিউনিজম-ভীতিতে” অতিমাত্রায় আক্রান্ত হবেন নাযা অনেক সমালোচকের কাছে দুর্বলতা হিসেবে মনে হয়েছিল। আবার তাঁর প্রশাসনের সময়েই ইরানে ইসলামি বিপ্লব ঘটে এবং তার পরই ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জিম্মি-কাণ্ড। তাছাড়াশক্তি ও কূটনৈতিক নীতি মিশিয়ে চালানোর কারণে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সহজেই ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হয়। তার ওপর ১৯৮০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে ব্যাপক পরাজয়ের ফলে কার্টারের সাফল্য দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়।

কিন্তু ক্যাম্প ডেভিডের সেই শেষ দিনের ঘটনাই দেখিয়ে দেয়এক মেয়াদে থেকেই তিনি এক স্থায়ী ও ইতিবাচক পররাষ্ট্রনীতি রেখে গেছেনযা অনেক দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্টও অতিক্রম করতে পারেননি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আচ্ছন্ন অবস্থায় থাকলেও কার্টার নিশ্চিতভাবেই তাঁর অর্জনে সন্তুষ্ট হতে পারেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং একজন শান্তিরক্ষাকারীযিনি সামরিক শক্তি ব্যবহার এড়িয়ে কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে কথা বলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি দেশটির সর্বোত্তম মূল্যবোধের প্রতিফলন হওয়া উচিত। পাশাপাশিঠান্ডা লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে তিনি কঠোর অবস্থান নিতে প্রস্তুত ছিলেনকিন্তু গর্ব করতেন এই বলে যেতাঁর প্রশাসনের সময় কোনো আমেরিকান যোদ্ধা যুদ্ধে মারা যায়নি।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় কার্টার ১৯৭৭ সালে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের সময় ঠান্ডা লড়াই বেশ জমাট বাঁধা অবস্থায় ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকায় আঙ্গোলাইথিওপিয়ানামিবিয়া এবং আফ্রিকার শৃঙ্গ অঞ্চলে নানা প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে সক্রিয় ছিল। তারা পারমাণবিক অস্ত্র মজুত বাড়াচ্ছিলঅভ্যন্তরীণ ভিন্নমত আরও দমন করছিলসোভিয়েত ইহুদিদের দেশত্যাগ কঠিন করে তুলছিল এবং সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। অন্যদিকেলাতিন আমেরিকা জুড়ে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী স্বৈরশাসকেরা জেঁকে বসেছিলযাদের নিক্সন ও ফোর্ড প্রশাসন সমর্থন দিয়েছিল। আর ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধের ধাক্কা এখনো কাটেনিএমন উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পরিস্থিতি ছিল সংঘাতময়।

ওই সময়যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিল। ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার চার বছর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রকৃত অর্থমূল্যে কমে গিয়েছিল। ন্যাটো সদস্যরাও সামরিক খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করেনি। পাশাপাশিডলারের মূল্যমান পড়ছিল এবং টোকিও রাউন্ডের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনা অচলাবস্থায় ছিল।

কার্টার ১৯৭৬ সালের নির্বাচনে একজন উদারপন্থী পররাষ্ট্রনীতিক” হিসেবে প্রচারণা চালান। তিনি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র ও ওয়ারহেডের সংখ্যা স্থির রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনপ্রতিরক্ষা ব্যয় বছরে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার কমানোর কথা বলেছিলেন এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সব মার্কিন স্থলবাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেনমানবাধিকারকে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখবেনযা পূর্বসূরিদের বাস্তববাদী (রিয়েলপলিটিক) অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়ায়।

কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি দেখলেনসোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত সামরিক ও পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রকেও আরও শক্তিশালী হতে হবে। তিনি প্রায়ই তাঁর শিকারি” জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্বিবিগনিউ ব্রেজিনস্কি আর শান্তিবাদী” পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইরাস ভ্যান্সের পরামর্শের মাঝখানে আটকে থাকতেন। প্রতিরক্ষা বাজেট কাটছাঁট না করে বরং বাড়াতে উদ্যোগী হনভিয়েতনাম-পরবর্তী সময়ের ঋজুতা কাটিয়ে সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনে নজর দেন। প্রকৃত অর্থমূল্যে তিনি তাঁর চার বছরের মেয়াদে প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িয়েছিলেন। আসলেপরবর্তীতে রিগ্যান প্রশাসনে যেসব বড় সামরিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিলস্টেলথ বোমারএমএক্স মোবাইল মিসাইলউন্নত ক্রুজ মিসাইল ইত্যাদিতার বেশির ভাগই অনুমোদন দিয়েছিলেন কার্টার। ২০১৭ সালে পেন্টাগনের এক গবেষণায় বলা হয়, “রিগ্যানের সময় প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বিপ্লব শুরু হয়েছিল কার্টার প্রশাসনের শেষ দিকে।

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করলে কার্টার আরও কড়া অবস্থান নেন। তিনি এটিকে বলেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তির প্রতি সবচেয়ে গুরুতর হুমকি,” এবং এমন অবস্থান গ্রহণের জন্য সমালোচকরাও তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে শস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেনমস্কো অলিম্পিক বয়কটের ঘোষণা দেনসোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং আবারও সামরিক খসড়া (ড্রাফট) কার্যকর করেন। পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেন যে পারস্য উপসাগরে তেলের প্রবাহ অবাধ রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা করবে নাএটি কার্টার ডকট্রিন” নামে পরিচিত এবং আজও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।

কার্টার ইউরোপীয় মিত্রদেরবিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট শ্মিটকেরাজি করাতে সক্ষম হনযাতে তারা সোভিয়েত মোবাইল মিসাইলের জবাবে নিজেদের ভূখণ্ডে মধ্যমপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে সম্মত হয়। সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ পরে স্বীকার করেনএই পদক্ষেপ তাঁকে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত সাল্ট টু” চুক্তি যে রিগ্যানের সময় বাস্তবায়িত হয়েছিলঅনেকেই তার কৃতিত্ব রিগ্যানকে দিতে চানকিন্তু এই চুক্তিটি প্রথমে কার্টারই সম্পাদনা করে গিয়েছিলেন।

এছাড়াসোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে চাপ বাড়িয়ে যান কার্টার। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে ঐতিহাসিক বরফ গলা শুরু করেছিলেন নিক্সন ও কিসিঞ্জারসেটি পূর্ণতা পায় কার্টারের সময়। তিনি ১৯৭৯ সালে চীনের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সে সময় চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এ পদক্ষেপের ফলে তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ করতে হয়তবে ১৯৭৯ সালের তাইওয়ান রিলেশন্স অ্যাক্টের মাধ্যমে তাইওয়ানের সঙ্গে এক নতুন সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয়। সেখানে কৌশলগত অনিশ্চয়তার ধারণা দেওয়া হয়যার ফলে চীন আগ্রাসন করলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করার সক্ষমতা থাকবেকিন্তু তা সরাসরি প্রতিশ্রুত নয়। এই আইনের ওপর এখনো যুক্তরাষ্ট্রের চীন ও তাইওয়ান নীতি প্রতিষ্ঠিত।

মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন কার্টার প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননিতবে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে ছিল মানবাধিকার। নির্বাচনী প্রচারে যেমন বলেছিলেনতেমনই তিনি লাতিন আমেরিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আমূল বদলে দেন। ১৯৭৭ সালে তিনি পানামা খাল চুক্তি সম্পাদন করেনযাতে খালের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে পানামার হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়যা বহু লাতিন আমেরিকানদের কাছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিষয় ছিল। তারপর চুক্তিটি সিনেটের অনুমোদন নিতে তিনি তাঁর প্রেসিডেন্ট মেয়াদের সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ে নামেন। এছাড়াআর্জেন্টিনার জর্জ রাফায়েল ভিদেলাব্রাজিলের এর্নেস্তু গেইসেল আর চিলির অগস্তো পিনোশের মতো স্বৈরশাসকদের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করেন। এমনকি গুয়াতেমালা ও উরুগুয়ের মতো দেশের বিরুদ্ধে হুমকি দেন যে তারা হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি না দিলে সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে এবং কার্টারের জোরালো সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর প্রথমবারের মতো বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেযা পরবর্তীতে প্রতিটি প্রশাসনের সময়েই অব্যাহত থাকে।

কার্টারের মানবাধিকার নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এক বিরাট চাপ তৈরি করে। তিনি সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বী আন্দ্রে সাখারভের পক্ষে সরব হনসোভিয়েত ইহুদিদের দেশত্যাগের অধিকারকে সমর্থন করেন এবং নাটান শারানস্কির মতো “রিফিউজনিক” বা বাধাগ্রস্ত সোভিয়েত ইহুদিদের পক্ষে দাঁড়ান। দীর্ঘদিন ওয়াশিংটনে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ছিলেন এমন আতোলি দোব্রিনিন স্বীকার করেন যে কার্টারের মানবাধিকার নীতি ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানে” সহায়তা করেছিলকারণ এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে উদারীকরণের দীর্ঘ ও কঠিন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কার্টারের পররাষ্ট্রনীতির সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং এর ফলে ১৯৭৯ সালে স্বাক্ষরিত মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তিযা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের অন্যতম বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয়। গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ একজন ব্যাপটিস্ট হিসেবে কার্টার মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি অগ্রাধিকার দেনতিনি পবিত্র ভূমিতে শান্তি আনতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি ঠান্ডা লড়াইয়ের হিসাবেও মধ্যপ্রাচ্য সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল। তাই তিনি মিশর-ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ব্যর্থতার পরতাঁর উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধ মত সত্ত্বেওসাদাত ও বেগিনকে আমন্ত্রণ জানান প্রেসিডেনশিয়াল রিট্রিট ক্যাম্প ডেভিডে। ১৩টি অস্বস্তিকর দিনের মধ্যে কার্টার নিজে ২০টিরও বেশি খসড়া চুক্তি লিখেছিলেনবেশির ভাগ সময়ে দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে। কারণ সাদাত ও বেগিন একে অপরের প্রতি চরম অবিশ্বাস পোষণ করতেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বহুবার চেষ্টা করেছেনশেষ পর্যন্ত তাঁর নাতি-নাতনির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বেগিনকে মন গলাতে পেরেছিলেন। বেগিন বিশ্বাস করতেনইসরায়েলের সীমানা ভূমধ্যসাগর থেকে জর্দান নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া উচিত।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিল আসলে একটি বহুমুখী কাঠামোযা তিন মাসের মধ্যে আইনগত চুক্তিতে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। ছয় মাস কেটে গেলেও তা না হওয়ায় কার্টার আবার ঝুঁকি নিলেনপুনরায় উপদেষ্টাদের বক্তব্য উপেক্ষা করে নিজেই এলাকা সফরে যান এবং ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে নিজস্ব খসড়া চুক্তি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন। শেষ মুহূর্তেজেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে বেগিনের সঙ্গে তিনি এক চূড়ান্ত চুক্তি করেনযা মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ৪০ বছরের সংঘাতের অবসান ঘটায়। এই চুক্তির ভিত্তিতেই আজ পর্যন্ত দুদেশের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক টিকে আছেযদিও ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ভয়াবহ সহিংসতায় জর্জরিত।

ইরান নিয়ে অন্ধত্ব কার্টারের পররাষ্ট্রনীতি মূল্যায়নে ইরান প্রশ্ন এড়ানো যায় না। ১৯৭৯ সালের গোড়ার দিকের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইসলামি বিপ্লব ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের বহু দশকের মিত্রতা থেকে এক স্বঘোষিত বৈরী রাষ্ট্রে পরিণত করে। ওই বছরের শেষের দিকেচরমপন্থী ইরানি শিক্ষার্থীরা তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ঢুকে ৫০ জনের বেশি আমেরিকানকে জিম্মি করেযা ৪৪৪ দিন ধরে চলে। ইরান বিপ্লবের আগে কার্টারের কয়েকটি বড় ভুল ছিল। মিশর-ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়ায় প্রশাসনের গুরুত্বারোপের ফলে ইরানের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ১৯৭৭ সালের শেষ দিনেইরানের শাহকে উদ্দেশ করে কার্টার বলেছিলেনইরান একটি স্থিতিশীলতার দ্বীপ”—কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় শাহকে দেশছাড়া হতে হয়। গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে কার্টার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়েনসিআইএ বুঝতে পারেনি শাহের সমাজে জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে এবং কেউ জানত না যে শাহের অনিরাময়যোগ্য ক্যানসার ছিল। শাহ পালিয়ে যাওয়ার ছয় সপ্তাহ আগে পর্যন্ত সিআইএ প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলইরানে বিপ্লবের কোনো সম্ভাবনা নেই।

কিছু সমালোচকযেমন হেনরি কিসিঞ্জারদাবি করেন যে কার্টারের মানবাধিকার নীতি শাহকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু বাস্তবে কার্টার কখনোই শাহের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে সমালোচনা করেননিযদিও তার গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক নিপীড়ন চালাত। তিনি কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে শাহকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সমাজের মধ্যপন্থী মহলের সঙ্গে সংলাপ করতে। উল্টোকার্টার শাহকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যেপ্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সামরিক হস্তক্ষেপ বা কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি জেনারেল রবার্ট হুইজারকে পাঠান শাহর শেষ প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা দিতেআয়াতোল্লাহ রুহোলা খোমেনির বিরুদ্ধেও গুপ্তচর কার্যক্রমের অনুমোদন দেন। তা সত্ত্বেওশেষ পর্যন্ত ইরান হারান আসলে শাহইকার্টার নন। ইরানের পশ্চিমাপন্থী সরকার পতনের জন্য কার্টারকে দায়ী করা ঠিক ততটাই অন্যায্যযতটা প্রেসিডেন্ট ডউাইট আইজেনহাওয়ারের ওপর দায় চাপানো অন্যায্য যে তিনি কিউবাকে ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে যেতে দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রেও কার্টার কূটনীতিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেনকঠোর ক্ষমতা প্রদর্শনের বিপরীতে। তিনি প্রথমেই জিম্মিদের নিরাপত্তার কথা ভাবেন এবং আমার (লেখক) ও ব্রেজিনস্কির উপদেশ অগ্রাহ্য করেনযেখানে আমরা খার্গ দ্বীপের (সেখান থেকে ইরানের বেশির ভাগ তেল রপ্তানি হতো) আশপাশে মাইন পেতে বা অবরোধ আরোপের কথা বলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত কার্টার আলোচনার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করতে সক্ষম হনযদিও তা সম্পন্ন হয় তাঁর নির্বাচনে পরাজয়ের পর। এখন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে রিগ্যানের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান ও পরবর্তী সময়ে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম কেইসি ইরানের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেনতাদের লাভজনক চুক্তি পেতে হলে জিম্মিদের মুক্তি নির্বাচন পার হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত করতে হবে। ২০২৩ সালে টেক্সাসের লেফটেন্যান্ট গভর্নর বেন বার্নস নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এ কথা জানান। আমি জেমস বেকারকে (যিনি রিগ্যানের চিফ অব স্টাফ ছিলেন এবং পরে ট্রেজারি সেক্রেটারি হন) জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “কেইসির ব্যাপারে এমন কিছুই নেই যা আমি অবিশ্বাস করতে পারি।” তিনি এটাও স্বীকার করেন যে কেইসি আমার তৈরি কার্টারের প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের তথ্য হাতে পেয়েছিলেন। কেইসি ১৯৮৭ সালে মারা যাওয়ার আগে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। তবুওজিম্মি সংকট নিয়ে চুক্তি বিলম্বিত হওয়ায় কার্টার নির্বাচনে পরাজিত হনএমনটাই অনেকে মনে করেন।

শেষ সেই শান্তির দূত নির্বাচনে পরাজয়ের পর কার্টার কার্টার সেন্টার” প্রতিষ্ঠা করেনযা তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অনেক অসমাপ্ত কাজযেমন শান্তি প্রচার ও নানা রোগ মোকাবিলাচালিয়ে যাচ্ছে। এই সেন্টারের নেতৃত্বে তিনি ১১৫টিরও বেশি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আলোচনা আয়োজন করেন এবং গিনিয়া ওয়ার্ম রোগ প্রায় পুরোপুরি নির্মূলের পর্যায়ে নিয়ে যান। ১৯৮৬ সালে বিশ্বে ৩৫ লাখের মতো গিনিয়া ওয়ার্ম রোগী ছিল২০২৩ সালে এসে তা ১৪ জনে নেমে এসেছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মতো নেতারাও অবসর জীবনে কার্টার সেন্টারের মডেল অনুসরণ করেছেন। হ্যাবিটাট ফর হিউম্যানিটির সঙ্গে কাজ করে জিমি এবং রোজালিন কার্টার ১৪টি দেশে ৪,০০০-এর বেশি পরিবারের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন গড়ে তুলেছেন।

যদি কার্টার পুনর্নির্বাচিত হতেনতবে তিনি সাল্ট টু পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি অনুমোদনের লড়াই চালিয়ে যেতেন (যদিও চুক্তিটি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন পায়নিসোভিয়েত ইউনিয়ন ও রিগ্যান প্রশাসন উভয়ই তা অনুসরণ করেছিল)। এছাড়াতিনি সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আরও ব্যাপক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির চেষ্টা করতেনযেমন রিগ্যান করেছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোতিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন চুক্তির প্রশ্নে জোর দিতেন। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ও পরবর্তী শান্তি চুক্তি অনুসারে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন” দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি কার্যকর করতে আরেকটি চুক্তি দরকার ছিলযার আলোচনা কার্টার প্রশাসন শুরুও করে দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশতরিগ্যান এই ইস্যুতে তেমন অগ্রসর হননি। যদি কার্টার এর সময় বাড়তি রাজনৈতিক মূলধন বিনিয়োগ করে ফিলিস্তিনিদের অধিক অধিকার ও সম্ভাব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের পথ সুগম করতে পারতেনতবে হয়তো মধ্যপ্রাচ্য আজ আরো শান্তিময় হতে পারত।

ইরানে কিছু ভুল সত্ত্বেওকার্টারের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বে স্থায়ী এক ইতিবাচক ছাপ রেখে গেছে। আজকের বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে কার্টারের দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ স্পষ্টঅর্থাৎ কঠোর ও নরম শক্তির মিশ্রণমানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি মনোযোগমস্কোর আগ্রাসনের সামনে দাঁড়ানোর সাহসআর চীনের ক্ষেত্রে কৌশলগত অনিশ্চয়তায় অবিচল থাকা। তাছাড়াকার্টারের পর বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে ক্যাম্প ডেভিডের সমতুল্য সফল একটি শান্তিচুক্তি আনার চেষ্টা করেছেনকিন্তু তেমন সাফল্য মেলেনি। হয়তো সেই ব্যর্থতার ফলেই আজকের চরম সহিংসতার মধ্যে গোটা অঞ্চল ডুবে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে কার্টারের মতো সাহসী ও দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন অনুভব করছে।

(লেখাটি ফরেন এফেয়ার্স  থেকে অনুদিত)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024