ভিক্টোরিয়া হিথ
বছরের শেষ প্রান্তে এসে আমরা সারা বছরের ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাচ্ছি। জলবায়ু বিষয়ক খবরে পৃথিবীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগজনক অনেক তথ্য রয়েছে—যেমন ২০২৪ প্রায় নিশ্চিতভাবে ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে—তবু বিজ্ঞানী ও নানা সংগঠনের অসংখ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ আমাদের বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবীর লক্ষ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে।
নিম্নে ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশে গৃহীত বা অর্জিত কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মযজ্ঞ উপস্থাপন করা হলো, যেগুলো জলবায়ু রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে:
১) সোলার এনার্জিতে যুগান্তকারী সাফল্য
২০২৪ সালে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একটি অতিসূক্ষ্ম, আলোক-শোষণকারী সোলার সেল কোটিং উদ্ভাবন করেছেন যা প্রায় যেকোনো পৃষ্ঠে—ব্যাগ, গাড়ি এমনকি ভবনের ওপরেও—প্রয়োগ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই আবিষ্কার সফলভাবে বাঁকা পৃষ্ঠেও প্রয়োগ করা গেছে, যার ফলে এর ব্যবহারিক ক্ষেত্র কার্যত সীমাহীন হতে পারে।
এই প্রযুক্তি সৌরশক্তির খরচ কমাতে এবং এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসে পরিণত করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে ব্যবসা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে আরো টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
২) যুক্তরাজ্যে সর্বশেষ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবসান
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্য জি৭ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়, যখন নটিংহ্যামশায়ারের র্যাটক্লিফ-অন-সোরে অবস্থিত শেষ কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নিঃসরণ কমানোর এক বিশাল পদক্ষেপ। কার্বন ব্রিফের হিসাব অনুযায়ী, ১৮৮২ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে মোট ১০.৪ বিলিয়ন টন CO₂ নির্গত হয়েছে—যা অনেক দেশের সর্বমোট নির্গমনের চেয়েও বেশি।
সবুজ জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকার এখন দেশটিতে বৈদ্যুতিক গাড়ির (EV) জন্য ব্যাটারি তৈরির বড় কারখানা বা গিগাফ্যাক্টরি স্থাপনে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মাধ্যমে EV উৎপাদন ও ব্যবহার দুটোই উৎসাহিত হবে।
৩) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ইকোসাইডকে অপরাধ হিসেবে প্রস্তাব
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইকোসাইডকে—যা মারাত্মক পরিবেশগত ক্ষতিসাধনকে বোঝায়—আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি সম্ভাব্য নতুন অপরাধ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।
যদি শেষ পর্যন্ত ইকোসাইডকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে নীতিনির্ধারক এবং উচ্চপদস্থ নির্বাহীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতির জন্য আইনি জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবেন। এটি বিশ্বের বড় বড় করপোরেট ও সরকারি নেতাদের জলবায়ুবান্ধব উদ্যোগ নিতে আরো উদ্দীপিত করবে।
৪) পোল্যান্ডের সবুজ জ্বালানির বিপ্লব
পোল্যান্ডে বসবাসের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে, দেশটির মানুষ এখন পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে।
পোল্যান্ড বিশ্বের নবম বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী দেশ, এবং এর ৪২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় সম্পূর্ণ দেশীয় কয়লার ওপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে ভবনগুলোতে হিট পাম্প ও সোলার প্যানেল স্থাপনের কাজ বেড়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই প্রায় ২ লাখ হিট পাম্প বিক্রি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১২০ শতাংশ বেশি।
জনমত পরিবর্তনের ফলে ২০৩৫ সালের মধ্যেই পোল্যান্ডে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
৫) জাতিসংঘের আদালতে ঐতিহাসিক জলবায়ু মামলা
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) বৃহত্তম জলবায়ু মামলা উত্থাপন করা হয়। এটি মূলত দুইটি প্রধান প্রশ্নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, যার রায় এখনো জানা যায়নি।
প্রথম প্রশ্নটি ছিল, পরিবেশ রক্ষায় (বিশেষত মানুষসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রতিরোধে) দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে। দ্বিতীয়টি ছিল, দেশের কর্মকাণ্ডের ফলে যদি জলবায়ু ও পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে কী ধরনের আইনি পরিণতি ভোগ করতে হবে।
মামলাটি প্যাসিফিক দ্বীপ রাষ্ট্র ভানুয়াতুর উদ্যোগে আনা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ দ্বীপ রাষ্ট্রটির অবদান কম হলেও, rising sea level ও উপকূলীয় ক্ষয়ের কারণে তারা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে।
আইসিজের সিদ্ধান্ত আইনিভাবে বাধ্যতামূলক নয়, তবে এর আইনি ও নীতিগত প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। ফলে এর পরবর্তী রায় বহুবিধ জলবায়ু বিষয়ক মামলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
৬) গরুর বাতাস উদ্গিরণ নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাজ্যের প্রধান সুপারমার্কেটের পদক্ষেপ
খাদ্য উৎপাদনে গরুর ভূমিকা বিশাল হলেও, এগুলোর ডাকার ও বায়ুনিস্সরণ (ফার্টিং) থেকে বড় মাত্রায় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। মানবসৃষ্ট মোট মিথেনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং সব মিলিয়ে মানুষের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু দূষণের প্রায় ১৪ শতাংশের জন্য গরুর এই নিঃসরণকে দায়ী করা হয়।
২০২৪ সালে, বড় একটি সুপারমার্কেট চেইন এমঅ্যান্ডএস তাদের গরুর খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনে। মাঠে চারণভূমিতে ঘাস খাওয়ানোর বদলে তারা গরুকে খাওয়াতে শুরু করে খনিজ লবণ ও ফারমেন্টেড কর্ন-জাত উপাদান। এতে প্রতিবছর প্রায় ১১ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৭) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে রাসায়নিক শিল্পে ডিকার্বোনাইজেশন
রাসায়নিক শিল্প বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু নতুন একটি স্টার্টআপ, এন্টালপিক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় এই শিল্পকে ডিকার্বোনাইজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।
প্রক্রিয়াটি সহজ করে বললে, তারা এমন উপাদান ও অণুর সন্ধান করতে এআই ব্যবহার করবে যা পুরোনো, দূষণকারী রাসায়নিক পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। এআই বিশাল তথ্যভান্ডারের মধ্য থেকে দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করতে পারে—কোয়ান্টাম সিমুলেশন, গবেষণাগারের ফলাফল ও একাডেমিক প্রকাশনা ইত্যাদি একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে খুব অল্প সময়েই সর্বোত্তম টেকসই উপাদানের সন্ধান দেয়।
এর ফলে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার সময় অনেকাংশে কমে যাবে এবং টেকসই হাইড্রোজেন উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট ও ব্যাটারি সেমিকন্ডাক্টর তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এগুলো ছিল ২০২৪ সালে জলবায়ু রক্ষায় আশাব্যঞ্জক কয়েকটি সাফল্যের দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর উষ্ণায়ন রোধে এবং পরিবেশের সুরক্ষায় যৌথভাবে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়।
Leave a Reply