লিভ ম্যাকমাহন
টিকটক সম্প্রতি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন এই ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হতে পারে, যদি এটি কোনো অচীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি না করা হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত টিকটকের আবেদনের শুনানি প্রত্যাখ্যান করে; এর ফলে ২০২৪ সালের এপ্রিলে পাস হওয়া আইনের ভিত্তিতে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার পথ খুলে গেছে।
অ্যাপটির রয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে কোটি কোটি ব্যবহারকারী। কিন্তু ব্যবহারকারীদের ডেটা সুরক্ষা এবং চীনের সরকারি প্রশাসনের সাথে সংযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে।
কারা যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চাইছে এবং কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল থেকেই সমর্থন রয়েছে এমন একটি আইনের, যেখানে বাইটড্যান্সকে বাধ্য করা হচ্ছে টিকটককে অচীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে, অন্যথায় দেশটিতে অ্যাপটি নিষিদ্ধ হবে। তাদের আশঙ্কা, চীনা সরকার চাইলে টিকটকের ১৭ কোটি মার্কিন ব্যবহারকারীর ডেটা হস্তগত করতে বাইটড্যান্সকে চাপ দিতে পারে।
টিকটক বরাবরই দাবি করে আসছে যে, তারা বিদেশি ব্যবহারকারীদের ডেটা চীনা সরকারের হাতে দেবে না।
২০২৪ সালের এপ্রিলে কংগ্রেসের অনুমোদনের পর, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিল স্বাক্ষর করেন, যেখানে টিকটককে বাধ্যতামূলকভাবে বিক্রি করার পথ তৈরি হয়েছে। এর আগে জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে টিকটককে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে হোয়াইট হাউসে থাকাকালে টিকটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচনের প্রচারে তিনি এই নতুন আইন সমালোচনা করেন, কারণ এতে ফেসবুকের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মগুলোর অন্যায় সুবিধা হবে বলে তিনি মনে করেন।
কবে টিকটক নিষিদ্ধ হতে পারে?
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিলটিতে স্বাক্ষর করলেও, সঙ্গে সঙ্গে টিকটক নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। এতে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
আইন অনুযায়ী, বাইটড্যান্সকে টিকটক বিক্রির জন্য প্রাথমিকভাবে নয় মাস সময় দেওয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত তিন মাসের একটি গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। এই সময়সীমার শেষ প্রান্তিক হলো ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি।
টিকটক কর্তৃপক্ষ বলছে, আইনি লড়াইয়ে হেরে গেলে তাদের বিক্রি হতে হতে পারে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, টিকটক এক ধরনের স্বস্তি পেতে পারে। কারণ তিনি বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় এলে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে দেবেন না।
কীভাবে টিকটক নিষিদ্ধ করা হতে পারে?
সবচেয়ে সরল উপায় হলো, অ্যাপল ও গুগলের মতো অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটককে সরিয়ে দেওয়া। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে নতুন কোনো ব্যবহারকারী যাতে অ্যাপটি ডাউনলোড করতে না পারে, সেটিই হবে প্রথম ধাপ।
এতে পুরোনো ব্যবহারকারীরাও কোনো ধরনের নতুন আপডেট বা বাগ ফিক্স পাবে না। ফলে সময়ের সঙ্গে অ্যাপটি কার্যত অকেজো হয়ে যেতে পারে।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলোর হালনাগাদ ও রক্ষণাবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত থাকবে। প্রেসিডেন্টকে এই ধরনের অ্যাপ সীমিত করার ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
টিকটক এই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কী বলছে?
টিকটক এই আইনকে ‘অসংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটন ডিসি-র একটি ফেডারেল আপিল আদালতে টিকটকের আইনি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। টিকটকের আইনজীবীরা আদালতে বলেন, টিকটক নিষিদ্ধ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর বাক্স্বাধীনতায় ‘চরম’ আঘাত হানবে। অনেক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এই নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু ডিসি আদালত ৬ ডিসেম্বর এক রায়ে টিকটকের আপিল খারিজ করে আইনটির পক্ষেই অবস্থান নেয়।
এরপর টিকটক জানায়, তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে যাবে। টিকটকের এক মুখপাত্র বলেন, “আমেরিকানদের বাক্স্বাধীনতা রক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক নজির রয়েছে। আমরা আশা করি এই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে তারাও একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আইনটি ভুল তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সেন্সর করবে।”
টিকটকের প্রধান নির্বাহী শোও চু ব্যবহারকারীদের উদ্দেশে একটি ভিডিওবার্তায় বলেন, “আমরা কোথাও যাচ্ছি না।”
সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া শোও চু হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং ফেসবুকেও কিছুদিন কাজ করেছেন।
টিকটককে বিক্রি করতে হলে চীনা কর্তৃপক্ষেরও সম্মতি লাগবে। কিন্তু বেইজিং আগেই জানিয়েছে, তারা এই বিক্রয়ের বিরোধিতা করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া কেমন?
অনেকেই এই সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের তরুণ প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী টিফানি ইউ বিবিসিকে জানান, হোয়াইট হাউসের সামনে আয়োজিত এক প্রতিবাদে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তার ভাষায়, “টিকটক আমার কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
অন্য কোথায় কোথায় টিকটক নিষিদ্ধ?
যুক্তরাষ্ট্রের এই বিল অন্য দেশগুলোকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
টিকটক ইতোমধ্যেই ভারতে নিষিদ্ধ, যেখানে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অ্যাপটির বিশাল বাজার ছিল। এছাড়াও ইরান, নেপাল, আফগানিস্তান ও সোমালিয়ায় টিকটক ব্লক করা রয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকার ও পার্লামেন্ট ২০২৩ সালে সরকারি কাজে ব্যবহৃত ডিভাইস থেকে টিকটক সরিয়ে দেয়। ইউরোপীয় কমিশনও একই সিদ্ধান্ত নেয়। বিবিসিও নিরাপত্তাজনিত কারণে কর্মীদের কর্পোরেট ফোন থেকে টিকটক সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে।
টিকটক কীভাবে কাজ করে এবং কতটা ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করে?
টিকটকের কেন্দ্রে রয়েছে এর অ্যালগরিদম, যা ব্যবহারকারীর আগের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে কনটেন্ট সাজায়। সাধারণত তিনটি ফিড থাকে – ফলোয়িং, ফ্রেন্ডস এবং ফর ইউ।
ফলোয়িং ও ফ্রেন্ডস ফিডে থাকে যাদের আপনি অনুসরণ করেন এবং যারা আপনাকে অনুসরণ করে। তবে ফর ইউ ফিডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন কনটেন্ট দেখানো হয়, যা আলগোরিদমের ভিত্তিতে সাজানো।
টিকটকে এসব কনটেন্ট সহজেই ভাইরাল হয়, ফলে এখানে দ্রুত লাখো-মিলিয়ন ভিউ পাওয়া সম্ভব।
এর সমালোচকেরা বলেন, অত্যন্ত ব্যতিক্রমীভাবে ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করেই টিকটক এত দক্ষভাবে কনটেন্ট সাজায়। এতে ব্যবহারকারীর অবস্থান, ডিভাইস সম্পর্কিত তথ্য, কীভাবে ব্যবহারকারীরা ভিডিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে এমনতরো বিবরণ, এমনকি কীভাবে টাইপ করছে তার গতিবিধি পর্যন্ত জানা যায়।
তবে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অনুরূপ ডেটা সংগ্রহ করে থাকে।
Leave a Reply