বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:০১ অপরাহ্ন

বার্ড ফ্লু এবং আরেকটি মহামারীর সম্ভাবনা

  • Update Time : বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১.৪৫ এএম

সারাক্ষণ ডেস্ক

সাল শুরুর এই সময়ে সবার জীবনে নানা ব্যস্ততা থাকেপরিবারসহ বেড়াতে যাওয়ার সময় কারো হঠাৎ অদ্ভুত কাশির উদয়নতুন বছরের জন্য অনুশোচনা আর প্রতিশ্রুতিজানুয়ারির ৬ তারিখ থেকে অভিষেক দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ উদ্বেগময় সময়যখন ওষুধে থাকতে হয়। অনেকে আমাদের চারপাশে সুরক্ষার দেয়াল তুলে রাখি। কিন্তু এই নিরিবিলি বেষ্টনীতে হঠাৎই কোনো ভয়াবহ সংবাদ হাজির হতে পারে। ডিমের দাম হঠাৎ আকাশচুম্বী কিংবা দোকানে ডিম মিলছে না। আশপাশের হাঁস-হনুমানীগঞ্জ (গিজ) শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে। হয়তো শোনা যাবেকোনো শিশু দুর্লভ ফ্লু”-তে আক্রান্তযা আরও ভীতিজনক।

এই পুরনো আতঙ্কের অনুভূতি বা ডেজা ভু এসেছে বর্তমান অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (পাখির ফ্লু) প্রাদুর্ভাব থেকে। মার্চ মাসেটেক্সাসে একটি গরুর মধ্যে এইচ৫এন১ ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকেযা প্রথমবারের মতো কোনো গরুর মধ্যে পাখির ফ্লু দেখা গিয়েছিলভাইরাসটি ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের খাদ্যব্যবস্থার এই ভূতুড়ে বাড়িতে এটি যেন আচমকা ভয়ের জন্ম দিচ্ছেপোলট্রি ও ডেইরি ফার্মেগরুর খামারেমাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায়বোতলজাত কাঁচা দুধে।

যেহেতু ফ্লু মৌসুম শুরু হয়েছেআমরাই এক অসীম-সম্ভাবনার পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছি ভাইরাসটির জন্য।

নভেম্বরেব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এক কিশোর মারাত্মক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সংবাদে আসেকিন্তু কিছুদিন পর সে যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়: আমেরিকান থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের সময় প্রদেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ ঘোষণা দেয় যে ওই কেস বন্ধ করা হয়েছে এবং আর কোনো আপডেট দেওয়া হবে না। ১৯ নভেম্বরেক্যালিফোর্নিয়ার আলামেডায় চিকিৎসকেরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো এক শিশুর দেহে পাখির ফ্লু শনাক্ত করেনকিন্তু কীভাবে এটি ঘটলকেউই বুঝতে পারেনি। ১২ ডিসেম্বরবিজ্ঞানীরা জানান ঘোড়ারাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ১৩ ডিসেম্বর জানা গেলক্যালিফোর্নিয়ায় দুটি ফার্মের কর্মী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং লুইসিয়ানায় এক ব্যক্তিযার বাড়ির উঠোনে পাখি ছিল এবং সেগুলো অসুস্থতিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। এরপর বড়দিনের আগের সপ্তাহেক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম পরিস্থিতিকে সম্ভাব্য পরবর্তী বিপদ এড়াতে পূর্ব প্রস্তুতি” হিসেবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি জানানরাষ্ট্রকে দ্রুত ও নমনীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবেসামনে কী ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন।

তবু অধিকাংশ মানুষ মনে করেন না যে আরেকটি মহামারী সামনে আসছে। কোভিড আসার পর থেকে আমরা বেশ সুরক্ষিত অস্বীকারের দেয়াল তৈরি করে ফেলেছি। এই তথ্য জেনে আমাদের বা কোনো কাজেই আসবে নাএমনটাই ভাবি। আমরা জানি গতবার আমেরিকানরা সামগ্রিকভাবে বিষয়টি কীভাবে সামলেছিল। আবার সবকিছু পুনরায় ঘটবে ভাবা মানে নিজের গায়ে নিজের ঘুষি মারা। আমরা মনে করিকেউ মাস্ক পরবে নাকেউ সরকারের কথা শুনবে নাসরকারও হয়তো শেষমেশ হাত গুটিয়ে নেবে। আমরা জানি কোভিড এখনো মানুষ মারছে২০২৪ সালে প্রায় ৫০,০০০ আমেরিকান মারা গেছেনকিন্তু তবু মনে হয়এ নিয়ে খুব বেশি উদ্বেগ নেই। বেশির ভাগ মানুষ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে টিকা নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন।

আরেকটি বদলে যাওয়া পৃথিবীর বাস্তবতা অনেকেই হয়তো মেনে নিতে চান না। এখন আমরা জানিমহামারী আমাদের জীবনে বড় ধরনের স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসে। ২০২৩ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছেঅর্ধেকের বেশি মানুষ মনে করেন কোভিড শুরুর পর থেকে তাদের জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনিআর ৪৭ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের জীবন আর কখনো স্বাভাবিক হবে না।

তবে সত্যি বলতে কিনতুন কোনো মহামারী এলে তা কীভাবে ঘটবে এবং আমরা কীভাবে তা সামাল দেবসেটাও আমরা পুরোপুরি জানি না। এবার কিছু বিষয় আলাদাএবং সবই খারাপ নয়। ২০২০ সালের বসন্তে কোভিড যেভাবে আমাদের আক্রমণ করেছিলসে সময়কার মতো নয় এখনকার অবস্থা। কারণসরকারের বিভিন্ন সংরক্ষণাগারে পাখির ফ্লু প্রতিরোধী টিকার কয়েক মিলিয়ন ডোজ মজুত আছেবিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ছেএবং আরও টিকা প্রস্তুত হচ্ছে। এ ছাড়া এ রোগ শনাক্তকরণের কিছু পরীক্ষা ইতোমধ্যেই আছেযদিও সেগুলো জনসাধারণের হাতে পর্যাপ্তভাবে পৌঁছায়নি।

আমাদের ক্লান্ত মানসিক অবস্থা কিংবা যারা সরকারিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় নাতাদের কী হবেসাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছেদ্বিতীয় কোনো মহামারী এলে আমরা আসলে যতটা ভাবিতার চেয়ে ভালোভাবে সামলাতে পারি। যদিও শোরগোল এর বিপরীতে যায়২০২৪ সালের জুনে হার্ভার্ডের স্কুল অব পাবলিক হেলথ করা এক জরিপে দেখা গেছেআমেরিকানদের বেশির ভাগই কোভিড মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপমাস্ক পরার অনুরোধঘরের ভেতর খাবার খাওয়া বন্ধ রাখাস্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করাসবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন। স্কুল বন্ধ করা অনেকেই অপছন্দ করলেওমাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ এখনো মনে করেন স্কুল বন্ধ রাখা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত।

আরও কিছু গবেষণা থেকে জানা যায় যে অনেক আমেরিকান কঠিন সেই কোভিড সময়কাল অতিক্রম করে নিজেকে আগের চেয়ে মানসিকভাবে দৃঢ় অনুভব করেন। আমরা মুখে যা-ই বলি না কেনমহামারীর চ্যালেঞ্জে কিছু মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিও ঘটেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, “যে শিশুদের কোভিড শুরুর আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত গুরুতর সমস্যা ছিলতাদের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।” (আমেরিকার স্কুল বন্ধ থাকা খারাপকিন্তু স্কুলে যেতে বাধ্য হওয়ার চেয়েও খারাপ আর কী হতে পারে?)

একটি পাখির ফ্লু মহামারী একদমই আনন্দদায়ক কোনো বিষয় নয়। এখনকার প্রচলিত ভাইরাসগুলো অতীতে যে স্তরে মারাত্মক ছিল (সেসময় মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল)এখন সেগুলো মানুষকে হয়তো সেই পর্যায়ে মারে না। তবু কিছু মানুষের জন্য এটি হবে প্রাণঘাতীআবার অনেকের জন্য বিপজ্জনক। সমাজ হিসেবে আমরা সামাল দিতে পারব কিসম্ভবত পারব।

আমরা জানি না আসলে কতটা ঝুঁকি বা সম্ভাবনা আছে যে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। সংক্রামক-রোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পছন্দ করেন না। আমরা যা জানিতা হলো ব্যাপক ঝুঁকি আমরা নিচ্ছি। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত এক ভয়ঙ্কর প্রতিবেদন অনুযায়ীসক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দেখেছেনবর্তমানে প্রচলিত অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার জিনগত উপাদানে মাত্র একটি মাত্র মিউটেশন” ঘটলেই তা মানুষের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মানিয়ে যেতে পারে। এক গবেষক বলেছেন, “এইচ৫ যদি কোনো দিন মহামারীতে পরিণত হয়সেটি এখনই ঘটতে পারে।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে বেশির ভাগ সরকারি সংস্থা শান্ত থাকার এবং যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সিডিসি বলেছেপাখিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে এবং ফ্লু টিকা নিতে। ওশা জানিয়েছেযাঁরা পশু নিয়ে কাজ করেন তাঁদের শ্বাসরোধী সুরক্ষা পরতে হবে। ইউএস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস অনুরোধ করেছে বন্য ও পোষা পাখিদের মেলামেশা না করানো এবং শিকার করা পাখি যেন ভালভাবে বায়ুচলাচল হয় এমন জায়গায়” পরিষ্কার করা হয়।

২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাত্র ৬০ জনের মতো মানুষের দেহে পাখির ফ্লু শনাক্ত হয়েছেআর পশুপাখির দেহে যে ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেতা এখনো পর্যন্ত মানুষে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। আগের কিছু প্রাদুর্ভাবে মানুষে মানুষে সংক্রমণ ঘটেছেকিন্তু তা খুবই বিরল। এখন পর্যন্ত এই রোগটি পাখিদের জন্যআর গরুদের জন্যও—(এবং শূকরইঁদুরবিড়ালসিল প্রভৃতির ক্ষেত্রেও)।

তবে বিগত শতাব্দীর সব ফ্লু মহামারী১৯১৮ সালের সেই ভয়াবহ ইনফ্লুয়েঞ্জা-সহযা দুই কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিলশুরু হয়েছিল পাখির মধ্য থেকেই। মৌসুমি ফ্লু প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়ে যাওয়ায় ভাইরাসটির মানুষের দেহে মানিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল: প্রতিবার এটি অন্য কোনো ভাইরাসের মুখোমুখি হলে নিজেকে বদলে নেওয়ার সুযোগ পায়।

দেশজুড়ে প্রায় ৮৫০টির বেশি ডেইরি খামারে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছেযে সংখ্যা আসলে অনেক বড় হতে পারেকারণ এটি মানে হাজার হাজার গরু বা তার চেয়েও বেশি। ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয়ভাবে দুধ পরীক্ষার যে কর্মসূচি শুরু হয়েছেতা মাত্র ছয়টি রাজ্যে চালু হয়েছেফলে তথ্যের বড় অভাব রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় পরীক্ষা করা হয়সেখানে প্রায় অর্ধেক ডেইরি খামারে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। জানোয়ারের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে আছেআর বেশির ভাগ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণ ফ্লুর টিকাও নেন নাফলে আমরা প্রায় এক অনন্ত-মাত্রিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছি পাখির ফ্লুর জন্য।

সম্প্রতি ৩৩টি দেশে জনমতের একটি গবেষণায় জানা গেছেমানুষ আগের চার বছরের চেয়ে সামান্য কম হতাশাচ্ছন্ন অনুভব করছে: শুধু” দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছে, “২০২৪ আমার দেশের জন্য খারাপ একটি বছর ছিল।” ২০১৯ সালের পর থেকে এটিই সবচেয়ে ইতিবাচক ফল। অর্থাৎ কিছু বিষয়ে আমরা হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আরেকটি মহামারীর কথা ভাবলে যেন হাস্যকরই মনে হয়। কিন্তু বিপর্যয় আসলে সুযোগ-সন্ধানীএটি ভাগ্যের হাতে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024