শশাঙ্ক মণ্ডল
তাই বনবিবি মূলত মুসলমানের আরাধ্য হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য হিন্দু তার আরাধনা করছে, দক্ষিণরায়ের ভক্ত অসংখ্য মুসলমান। এভাবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সাংস্কৃতিক ঐক্য লক্ষ করা যায়। ধর্মের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই পার্থক্য দূরীভূত হয়েছে। এই এলাকার বিভিন্ন পীর গাজী দেবদেবী উৎসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটা ঐক্যবোধ গড়ে উঠেছে।
আদিবাসীদের সুন্দরবনের বেশ কিছুকাল বসবাসের মধ্য দিয়ে হিন্দু সমাজের বেশ কিছু আচার আচরণ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে। সরস্বতী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী-সুন্দরবনের হিন্দু মুসলমানের আরাধ্য দেবী, বনবিবি আদিবাসী সমাজের মানুষের কাছে আরাধ্য দেবী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে- সব মিলিয়ে মিশ্র লোক সংস্কৃতির লীলাভূমি হিসাবে সুন্দরবন বাংলার লোকসংস্কৃতির মানচিত্রে এক বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে।
সুন্দরবনের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে লোক সংস্কৃতি তার নিত্য সহচর- আনন্দের সাথী। প্রাত্যহিক জীবনের ধর্মাচরণ, পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান, নাচগান যাত্রা পাঁচালী কথকতা প্রবাদ প্রবচন ছড়া হেয়ালি গৃহসজ্জা আলপনা প্রভৃতির মাধ্যমে সে নিজেকে প্রকাশ করে আসছে। চাওয়া পাওয়া আশা-আকাঙ্খা হাসি-কান্নার দোলায় সে দুলেছে লোকসংস্কৃতির উপকরণগুলিকে অবলম্বন করে।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে পুরানো সেই সমাজ যে সমাজ হতে একদিন লোক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল তা আজ ভেঙে গেছে- সেই সমাজ এখন খণ্ডিত বিশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে- যৌথ পারিবারিক জীবনের স্থান গ্রহণ করেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনচর্চা। বঙ্গবিভাগের মধ্য দিয়ে পুরানো প্রতিবেশীরা কে কোথায় হারিয়ে গেল তার পরিবর্তে নতুন প্রতিবেশী, নতুন রীতি আচার-আচরণের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল এসব মানুষ।
পুরানো যৌথ পরিবার, পিতামহেরা কয়েক ভাই এবং তাদের সমস্ত পরিবার মিলে সেই বিশাল পরিবার আজ আমাদের সামনে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। পুরানো কৃষিজীবী সমাজের দীর্ঘ অবসর সুখ-স্বাচ্ছন্দ আজ সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। প্রয়োজনের তাগিদে তাকে সারা বছর ছুটে চলতে হয়। নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রামের সঙ্গে শহরের দ্রুত যোগাযোগ, সব মিলিয়ে লোকসংস্কৃতির পুরানো আবহ হারিয়ে গেছে। সেই সাথে লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলি বিস্মৃতির অতলজলে হারিয়ে যাচ্ছে। লোকসংস্কৃতি আজ নির্বাসিতপ্রায়।
Leave a Reply