শশাঙ্ক মণ্ডল
কোথাও লোহার শলা, পাথরের টুকরো, আবার কোথাও কাঠ। মাটির বেদীতে অনেক সময় মোচার আকৃতিবিশিষ্ট ঢিবি করে পূজা করা হয়। গ্রামদেবতা পূজার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পশু বলি দেওয়া। গ্রামদেবতার নাম অনুসারে অনেক গ্রামের নাম হয়েছে। কোন কোন সময় যে দেবী যে গ্রামের ওপর প্রভুত্ব করেন তার নামে সেই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। চণ্ডীর পুর বলে চণ্ডীপুর, কালীর নগর বলে কালীনগর, কালীর তলা থেকে কালীতলা- এ ধরণের অসংখ্য গ্রাম সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় লক্ষ করা যায়। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামেও লক্ষ করা যায় হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান গ্রামবাসীরাও বাস্তুপূজার সময় অংশ গ্রহণ করে থাকে।
-মুসলিম প্রধান গ্রামগুলিতে অনাবৃষ্টি মহামারী গোমড়ক ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য গ্রামবন্ধন অনুষ্ঠান করে। গ্রামের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হয়ে একটা বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে তাতে সুরাইয়া কলমা লিখে পতাকা নিয়ে বয়েৎ পড়তে পড়তে সবাই মিলে গ্রামের চারিদিকে ঘোরে এবং গ্রামের সীমানার কাছে এসে সীমানার চারিদিকে মাটির ভাড়ের মধ্যে কলমা সুরাইয়া লিখে মাটিতে পুঁতে দেয়।
অনেক জায়গায় চাঁদার পয়সা থেকে ছাগল কিনে ছাগলকে উৎসর্গ করা হয় এবং ঐ ছাগলের মাংস রেঁধে গ্রামের সকলকে প্রসাদ হিসাবে তা দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক গ্রামে বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এটা করা হয়। এ ব্যাপারে মসজিদ বা তার ইমাম এর ভূমিকা আদৌ দেখা যায় না। আবার বিশেষ প্রয়োজন পড়লে, মহামারী দেখা দিলে তা ঠেকানোর জন্য গ্রামবন্ধন বা গ্রামঘেরা অনুষ্ঠান করা হয় এলাকার হিন্দুরা কমবেশি এই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে থাকে।
২৪ পরগণার মিনাখাঁ, ভাঙর হাড়োয়া এলাকায় ছাদগী – অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রামবন্ধন করা হয়ে থাকে- ধ্বজা পূজা করা হয় এই উৎসব উপলক্ষে। গ্রামের মধ্যে একটা জায়গায় বাঁশ বা ধ্বজা পোঁতা হয়। তার পূর্বে বয়েৎ সুরাইয়া কলমা পড়তে পড়তে ঐ বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে সেই বাঁশ নিয়ে গ্রামবাসীরা মিছিল করে সমগ্র গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। মানুষের বিশ্বাস এই অনুষ্ঠান গ্রামকে সর্ববিধ অমঙ্গল মহামারী অনাবৃষ্টি প্রভৃতি থেকে মুক্ত রাখবে।
সুন্দরবনের আদিবাসীদের মধ্যে গ্রামঘেরা অনুষ্ঠান এখনও সমানে চলছে। আদিবাসীদের গ্রামবন্ধন অনুষ্ঠানে সমগ্র গ্রামের মানুষদের কল্যাণ কামনায় যাদু ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠান করে বছরে দু বার। অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমার দিন এবং পরের বছর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান আষাঢ় মাসে অমাবস্যার দিন করে থাকে। এই পূজায় ওঝা অথবা পাহান এর একটা বড় ভূমিকা থাকে। পূজার থান পূর্বদিন গোবর দিয়ে পরিষ্কার করা হয় এবং সেই সঙ্গে আদিবাসী পাড়ায় সমস্ত বাড়িতে কাপড় চোপড় ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়ে থাকে।
Leave a Reply