শশাঙ্ক মণ্ডল
এর পাশাপাশি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বদেশি গানও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সুন্দরবনের বিশাল অরণ্য, দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, প্রকৃতির উন্মুক্ত উদার পরিবেশ, কৃষিনির্ভর জীবনের সহজ অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা সেই সাথে দুঃখ কষ্ট মন্বন্তর মহামারী সব মিলিয়ে মানুষের মনের ওপর একটি নৈব্যক্তিক নিরাসক্ত মানসিকতার জন্ম দিয়েছে। সীমার জগৎ তার কাছে দূরে সরে যায়, অসীম জগতের উদাসীসুর তাকে আকৃষ্ট করে। এসব গানের মধ্যে পল্লীগ্রামের মানুষের সহজ সরল প্রাণ ও মনের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি জীবনের নিগূঢ় ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ফুটে উঠেছে।
নদীমাতৃক সুন্দরবন- তার জলের ছল ছল শব্দে জলতরঙ্গ বেজে ওঠে, নৌকাখানি ঘিরে জলের ছন্দ, মাঝি দাঁড় বেয়ে চলে- ক্লান্তি তার দেহমনে, চোখে ঘুমের আবেশ জাগে। নিস্তব্ধ প্রকৃতি জনমানবহীন নদীতীর এবং সেই সাথে দিগন্তবিস্তারী অনন্ত জলরাশির কলকল ধ্বনি তার মনের মধ্যে এক অপূর্ব শূন্যতার সৃষ্টি করে; এমনি একমুহূর্তে যে গান গেয়ে ওঠে অথবা দূরের কোন মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালী সুর বেজে ওঠে- ‘ও মন মাঝিরে তোর বৈঠা নে রে’ প্রকৃতি ও পরিবেশ তার গানের আবহ সঙ্গীত রচনা করে। ভাটিয়ালী গানের এই সুরে উদার প্রকৃতি যেন কথা বলে ওঠে, মানুষে মানুষে পার্থক্য দূরীভূত হয়, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ, শুচি অশুচিতার প্রশ্ন সবকিছুই দূরে চলে যায়।
কবি গানের আসরে হিন্দু পুরাণ নির্ভর সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা মন দিয়ে শোনে মুসলমান শ্রোতা, গাজীর গানে ইসলামধর্মীয় চিন্তা হিন্দুমনকে আলোড়িত করে। সারি জারি ভাসান, কবিও বাউলের সুরের ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক জ্ঞাতিত্ব লক্ষ্য করেছেন অনেক সঙ্গীত বিশারদ। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রাজনৈতিক শঠতা ও জটিলতার স্থান এসব গানে নেই তা সহজে অনুধাবন করা যায়।
সারিগান
কর্ম সঙ্গীতের মধ্যে প্রধান হল সারিগান। সুন্দরবন এলাকায় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হত। দুর্গোৎসবের শেষ দিন কিংবা মনসা প্রতিমা বিসর্জনের দিনের ভাসান উৎসবে নৌকা বাইচ চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। নৌকা বাইচের তালে তালে দাঁড় বা বৈঠাগুলি যাতে ফেলা যায় সেজন্য দ্রুত তালে সারিগান গাওয়া হত, এর ফলে একই সঙ্গে বৈঠা পড়লে নৌকার গতি তীব্র হয়। যে সব গানে সমবেত শারীর ক্রিয়ার প্রয়োজন হয় সে সব গানকে সারি গানের ‘অর্ন্তভূক্ত করা হয়।
Leave a Reply