বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:১১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে যাচ্ছে   

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী, ২০২৫, ১০.০৮ এএম

স্বদেশ রায়

আজ কাল অনেকে বলেন, বর্তমানের গ্লোবালাইজেশানের পরে পৃথিবীতে পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব বেড়েছে। কারণ, এখন কোন একটি দেশ এককভাবে বা একাকি চলতে পারে না। বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাসের একটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, পররাষ্ট্রনীতি ও সফল কূটনৈতিক যোগাযোগই মূলত সবকালে একটি রাষ্ট্র’র অর্থনীতির ভিত্তি ও তার দেশের ভেতরকার স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিয়েছে।তাই সে মৌর্য চন্দ্র গুপ্তের চানক্য হোক আর কুবলাই খানের মার্কো পোলো হোক। কুবলাই খান চায়নার বিশাল এলাকা স্থিতিশীল করতে পেরেছিলেন মূলত তার মার্কোপোলোর ভিয়েতনাম নীতির ফলে। ওই সময়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব থেকে বড় বানিজ্য কেন্দ্র ও অর্থনৈতিকভাবে সফল রাষ্ট্র বিশাল আকারের ভিয়েতনামের(যে ভিয়েতনামের সঙ্গে সে সময়ের ভারতেরও ছিলো বিপুল বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ওই সময়ের চায়নাকে বিশ্ব বানিজ্য চলাচলে আরো বেশি সফল করে। তেমনিভাবে অতীতের এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার ছোট ছোট রাজাদের সাফল্য’র ইতিহাস যতটা না যুদ্ধে তার থেকে বেশি কূটনীতিতে।

তাই যে কোন রাষ্ট্র’র সাফল্য সবকালেই তার কূটনৈতিক সাফল্য’র ওপর নির্ভর করে। যেহেতু পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই নৌ, স্থল, ও আকাশ যোগাযোগ ছাড়া সফল হতে পারে না। আর তা নির্ভর করে প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও বিশ্বপরিসরে তার সম্পর্কের ওপর। তেমনি প্রয়োজনীয় পণ্যেতেও ভৌগলিকভাবে কোন দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। কারণ, এটা প্রাকৃতিক বৈচিত্রের ওপর নির্ভর করে। যেমন সুইজারলান্ডের হিউমিডিটি যে সুক্ষ্ম কারিগরি কাজে সহায়তা করে অস্ট্রিয়ার হিউমিডিটিতে সেটা তৈরি করতেও পারে- তবে হিমিউটির তারতম্য’র ফলে উত্‌পাদিত পণ্যের মান সুইজারল্যান্ডের সমান হয় না। যে কারণে একই ব্রান্ডের তৈরি কোন চশমা’র মান ও স্থায়ীত্ব অস্ট্রিয়ার থেকে সুইজারল্যান্ডেরটা অনেক বেশি ভালো। তাই বড় কোম্পানিকে যেমন অস্ট্রিয়াতে কারখানা করতে হয় তেমনি সুইজারলান্ডেও করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ওই সব কোম্পানিকে ঘোড় সওয়ারের ইতিহাস নিয়ে বসে থাকলে চলে না। তাকে হিউমিডিটি বুঝতে হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কতটা বর্তমান বিশ্বের কূটনীতির হিউমিডিটি বুঝছে সেটা একটি বড় প্রশ্ন। সরকারে যারা আছে তারা হয়তো মনে করছেন তারা সঠিকভাবে এগুচ্ছেন। হয়তো তারা সঠিক। তবে বাস্তবতা যা দেখা যাচ্ছে সেগুলো কিন্তু এমনই। বাংলাদেশে ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে,বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান ক্ষমতা গ্রহনের আগেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের উত্তর পূর্ব এলাকা নিয়ে যে বক্তব্য দেন এবং সর্ব শেষ তার মেটিকুলাস চিন্তক উপদেষ্টার একটি ফেসবুক পোস্টের পরে ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক- ভারত কানাডার সঙ্গে যা করেছে সেই মাপের আনুষ্ঠানিক ডাউনগ্রেডেড হয়নি ঠিকই। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে ভারত তার হাই কমিশনার প্রত্যাহার করে ডেপুটি বা কাউন্সিলর পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি।  তবে তারা কূটনৈতিক সম্পর্কটি মোটামুটি রাজনৈতিক পর্যায় থেকে প্রশাসনিক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি নদী’র পানি সংযোগ, তাছাড়া নিত্যপণ্য সেবা সহ অনেক সেবা জড়িত- সর্বোপরি ২৭১ কিলোমিটার ল্যান্ড বর্ডার শুধু মাত্র মিয়ানমারের সঙ্গে- বাদবাকী সবই ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের সমুদ্র পথ ও আকাশ পথও তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সব থেকে অবাধ। অথচ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে এ অবধি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমান যে পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে;  এ পর্যায়ে আগে কখনও সাদা চোখে দেখা যায়নি। এমনকি খোন্দকার মোশতাকের সরকারের সময়ও এমনটি ঘটেনি।

এর পরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার- যার সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার ল্যান্ড বর্ডার বাংলাদেশের। এবং অনেক নিত্য পন্যের বানিজ্যও এই ল্যান্ড বর্ডার এবং তাদের সঙ্গে নৌ ও সমুদ্র পথ রয়েছে সে পথেই হয় । এই ল্যান্ড ও সমুদ্র বর্ডারের চরিত্র ৫ আগষ্টের পর দ্রুত বদলে গেছে। কেন এমন দ্রুত বদলে গেলো বাংলাদেশের কূটনীতিতে এটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।

ভারতের পরে এশিয়ায় বাংলাদেশের সম্পর্ক জড়িত বড় দুই আর্থিক শক্তি চায়না ও জাপানের সঙ্গে। দুটি দেশই তাদের কূটনীতিতে রাজনীতির থেকে অর্থনীতিকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগও কম নয়। এই দুটি দেশের কূটনীতির এ মুহূর্তে মূল লক্ষ্য তাদের বিনিয়োগের অর্থ নিয়মিত  ফেরত এবং নতুন বিনিয়োগ করার সুযোগ এর চিন্তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তারা এখন বেশি চেষ্টা করছে নিয়মিত বিনিয়োগের লভ্যাংশ ফেরতে বিষয়টি নিয়ে।  এই নিয়মিত ফেরতের চিন্তায় দুটো দেশকে দেখা যাচ্ছে তারা এখন “ওয়েট এন্ড সি” পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। তারা প্রথমে দেখছে আসলে বাংলাদেশে যে অস্থিতিশীলতা চলছে এখান থেকে এই সরকারের বের হবার সমর্থ আছে কিনা? এবং স্থিতিশীল সরকারের পথে বাংলাদেশ যায় কিনা? তাছাড়া বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুই দেশের একটি স্পর্শ্ব কাতর বিষয় রয়েছে। জাপানের রয়েছে হোলি আর্টিজান অভিজ্ঞতা। তারা দেখেছে, হোলি আর্টিজানের যে সব দৈত্য নানাভাবে বোতলে বন্দী ছিলো- সে সব বোতলের অনেক মুখ খুলে গেছে। অন্যদিকে চায়নারও রয়েছে উইঘুর সমস্যা। তাদের উইঘুরের সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানে ট্রেনিং নেয় বলেই কিন্ত আফগানিস্তানে ফাঁকা মাঠ পাওয়ার পরেও তারা সেখান থেকে একটি বিশেষ ধাতু কেনা ছাড়া অন্য বিনিয়োগে খুব বেশি মনোযোগী হয়নি। এমনকি পাকিস্তানেও উইঘুর মৌলবাদীদের ট্রেনিং হয় বলে চায়না পাকিস্তানকে ব্যবহার করে তবে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশে যেমন দীর্ঘকাল ধরে সহায়তা করে আসছে- সে কাজটি পাকিস্তানের জন্যে করে না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ৫ আগষ্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে ৫ নভেম্বর বিশ্বরাজনীতিতে বড় একটি পট-পরিবর্তন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিপুল ভাবে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়া এবং সিনেট ও কংগ্রেসে বিজয়ী হবার মধ্যে দিয়ে। এখানে পপুলার ভোটের কথা উল্লেখ করার কারণ, এবার ট্রাম্প সেই সব রাজ্যগুলোতেও জিতেছেন যেগুলো ডেমোক্র্যাটদের নিশ্চিত বিজয়ের ক্ষেত্র ছিলো। আমেরিকার নির্বাচনে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পপুলার ভোট পাবার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখে। তাই ট্রাম্পের এই পপুলার ভোট অনেক বেশি পাবার ভেতর দিয়ে এটা প্রমান করে এ মুহূর্তে বেশি ভাগ আমেরিকান ক্লিন্টন, হিলারী, ওবামা ও বাইডেনের “বিশ্বপুলিশিং” নীতিকে প্রত্যাখান করছে। এমনকি তাদের এই “ বিশ্বপুলিশিং”  নীতি ডেমোক্র্যাটদেরও একটি বড় অংশ পছন্দ করছে না। যে কারণে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এই গ্রুপটির যেমন বয়স হয়েছে তেমনি নীতিগতভাবে তারা ওয়াশ আউট না হোক দ্রুতই কোনঠাসা হবার পথে চলেছে।

৫ নভেম্বরের আগে অর্থাৎ আমেরিকার নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ছিলো। ওই অধিবেশনের সময় অধিকাংশ দেশের সরকার প্রধান বা পরারাষ্ট্র মন্ত্রী যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা ভবিষ্যত কূটনীতিটি মাথায় রেখেছিলেন। যে কারণে তারা ওই সমেয়র আমেরিকার সিস্টেমের বাইরে কারো সঙ্গে দেখা করেননি। কারণ, নির্বাচন বা জনগনের রায় চূড়ান্ত হবার আগে সুস্থ ডিপ্লোম্যাসি গা বাচিয়ে চলার নীতিই নেয়। বাংলাদেশের সরকার প্রধান বিজয়ের আনন্দে হোক আর পুরানো বন্ধুত্বের টানে হোক স্টিটেমের বাইরে গিয়ে ক্লিন্টন ফাউন্ডেশানে বিজয় উৎসব পালন করার অনুষ্ঠান করেন। এবং সেখানে তিনি তার ক্ষমতা গ্রহনের মেটিকুলাস ডিজাইনারকে (যিনি ইতোমধ্য বাংলাদেশের আয়তন বাড়ানোর তার যে  পরিকল্পনা সেটা  জাতিকেও গোটা বিশ্বকে জানিয়েছেন) পরিচিত করিয়ে দেন। ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছে বিজয়ের আনন্দে বিজয়ের মূল জারক রসটি জানানো সব সময়ই আনন্দের- তবে ডিপ্লোম্যাসিতে তার ফলটা কী হতে পারে সে চিন্তাও গুরুত্বপূর্ণ। এবং এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, ক্লিন্টন ফাউন্ডেশানের গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে সে দেশে ও অনান্য দেশেও প্রশ্ন আছে।

তাই  একদিকে যেমন বাংলাদেশকে আমেরিকার এই লবিতে প্রকাশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যদিকে আমেরিকার জনগনের রায়ের ফলে বিশ্বরাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটে গেছে দ্রুত। শুধু আমেরিকায় ট্রাম্পের বিজয় বা “আমেরিকা গ্রেট নীতির” বিজয় নয়- ভারত ও চায়না তাদের সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে বানিজ্যিক অগ্রগতিতে হাত ধরা ধরি করে চলার পথে পা রেখেছে। অন্যদিকে চায়না ও ভারতের রাশিয়া নীতির সঙ্গে আমেরিকার ভবিষ্যৎ রাশিয়া নীতি কাছাকাছি চলে আসার কাজটি ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকেই শুরু করেছেন। তার ফলে খুব দ্রুতই ট্রাম্প, মোদি, শি ও পুতিনকে সৌহার্দ্য পূর্ণ মিটিং এ দেখা যাওয়াটাই বাস্তবতা। তেমনি ইরানের সঙ্গে রাশিয়া, চায়না ও ভারত যে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে এতদিন- আমেরিকা দ্রুত সেখানে না এলেও কাছাকাছিই আসবে। এমনকি পুতিন বা মোদিকে যেমন তেহরানে দেখা যায়, তেমনি ট্রাম্পকে তেহরানে দেখা গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।

অন্যদিকে মিডলইস্টের ইউনাইটেড আরব আমিরাত আগের থেকেই ইনক্লুসিভ মিডল ইস্টের নীতিতে ঢুকে গেছে। হঠাৎ হামাস অজানা কারণে ইসরাইল আক্রমন করায় ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরু হওয়াতে সৌদি আরবের ইনক্লুসিভ মিডলইস্ট নীতি থমকে গিয়েছিলো। তবে আমেরিকা, রাশিয়ার সম্পর্কের পরিবর্তনের পরে ইনক্লুসিভ মিডলইস্ট নীতি দ্রুত অগ্রসর হবে।

তাই এসময়ে ভারত, চায়না, রাশিয়া ও আমেরিকার বলয়ে নিজেকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে ইনক্লুসিভ মিডলইস্ট এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পথটি কঠিন। আর সে অবস্থায় বাংলাদেশের হাতে থাকবে শুধু পাকিস্তান। কিন্তু সেখানেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে নভেম্বর পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের পরে ইমরান খানকে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে শক্তি প্রয়োগে কি দূরে রাখা সম্ভব হবে? সে শক্তির ফুয়েল কি চায়না ও আমেরিকা দেবে? এমনকি ভারতও কি নতুন করে তাদের পাকিস্তান নীতি নিয়ে চিন্তা করবে না? আর ইমরান খান জেল থেকে বের হলেই পাকিস্তানের অদৃশ্য ক্ষমতার শক্তি কি বর্তমানের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে?  সে সময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার থাকলে ওই পাকিস্তান কতটা তার পাশে থাকবে?

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World. 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024