বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৪৭ অপরাহ্ন

মাদক, প্রতারণা ও পাপ: মিয়ানমারের যুদ্ধ দেশটিকে বৈশ্বিক অপরাধের রাজধানীতে পরিণত করেছে

  • Update Time : শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২৫, ৩.৪৩ এএম

হান্না বিচ

পাহাড়ি গ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি রাস্তার ধারে বিস্তৃত ফুলের ক্ষেতসাদাগোলাপি ও বেগুনি রঙের কোমল স্রোতের মতো দোল খায়। পূর্ব-মিয়ানমারের শান রাজ্যের এই মনোরম দৃশ্য প্রথমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নিষ্ঠুরতা থেকে কিছুটা স্বস্তি দেবে মনে হলেওআসলে এই ফুলের উপস্থিতি এক অশুভ চিহ্ন। এগুলো সব আফিমগাছযেগুলো থেকে হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকের কাঁচামাল উৎপন্ন হয়। কিন্তু সমস্যা সেখানেই শেষ নয়।

প্রায় চার বছর আগে সামরিক বাহিনী নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিয়ানমার এক পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়েছে। একইসঙ্গে দেশটি আন্তর্জাতীয় অপরাধচক্রের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। এখানে স্বেচ্ছায় বা লুকিয়ে আসছে বিভিন্ন ওয়ারলর্ডঅস্ত্র ব্যবসায়ীমানবপাচারকারীবন্যপ্রাণী শিকারিমাদকচক্র ও আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযুক্ত সামরিক নেতৃত্ব। গ্লোবাল অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ীবর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠিত অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমার।

মিয়ানমারের উর্বর মাটিতে অপরাধের এই প্রবল বিস্তার দেশটির প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য দুর্বিষহ পরিণতি বয়ে এনেছে। একইসঙ্গে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের ফলাফল সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে বেসামরিক নেতা অং সান সু চির সরকার উৎখাত হওয়ার পর থেকেই দেশটির অর্ধেক অঞ্চল যুদ্ধবিধ্বস্ত। এ অবস্থায় মিয়ানমারের নামের পাশে যোগ হচ্ছে একের পর এক অশুভ তকমা।

এখন এটি পৃথিবীর বৃহত্তম আফিম উৎপাদনকারী দেশ। পাশাপাশি দেশটি বিশ্বে সর্বাধিক পরিমাণে সিনথেটিক মাদকযেমন মেথামফেটামিনকেটামিন ও ফেন্টানিলউৎপাদনকারী অন্যতম প্রধান উৎস। প্রতিবেশী চীন ও ভারত থেকে আনা প্রিকার্সার রাসায়নিক দিয়ে মিয়ানমারের কারখানায় বানানো ট্যাবলেট অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে। কারখানাগুলো লাগাতার উৎপাদনে থাকায় এবং আন্তর্জাতিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় এসব মাদকের রাস্তার দাম অস্বাভাবিকভাবে কম।

কিন্তু মিয়ানমারকে কেবল মাদকচক্রের দেশ বলে ভাবলে ভুল হবে। এটিকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কিছু ভারী রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট রপ্তানিকারক বলেও ধারণা করা হয়যেগুলো সবুজ জ্বালানির জন্য অপরিহার্য। যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত অঞ্চলগুলোতে সুসংগঠিত কাঠামো ছাড়াই কাজ করে শ্রমিকেরা। সেখান থেকে উত্তোলিত রেয়ার আর্থ চীনে পাঠানো হয় পুরোনো চোরাপথ ধরে। দেশটিতে বিশ্বের সেরা জেড (jade) ও রুবিও পাওয়া যায়যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মাদকের নেশায় ডুবে থাকা তরুণ খনি শ্রমিকদের হাত দিয়ে উত্তোলিত হয়। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার ও অবৈধ কাঠ সংগ্রহও ব্যাপকযাদের বেশির ভাগই চীনের বাজারে যায়।

মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধ চীনের অপরাধচক্রের বিস্তারকেও বাড়িয়ে তুলেছেযারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে ওই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে। চীনা অস্ত্র প্রবাহিত হচ্ছে সামরিক জান্তা ও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়ের কাছেই।

সীমান্ত এলাকায় চীনা গডফাদার ও জাতিগত ওয়ারলর্ডদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অপরাধচক্র বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজনকে অপহরণ করে কারখানায় এনে অনলাইনে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করছে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থাগুলো বলছেএই অনলাইন জালিয়াতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রচীনইউরোপসহ সারা বিশ্বের বয়স্ক মানুষ ও একাকী হৃদয়দের লক্ষ লক্ষ ডলার হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হয়সংগঠিত অপরাধ তত স্বার্থবদ্ধভাবে লাভবান হয়,” বলছিলেন জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের প্রতিনিধি মাসুদ করিমীপুর। আর যত দিন এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকবেতত দিন বিশাল এলাকাজুড়ে সেসব মানুষের দখল ও প্রভাব বাড়বে যারা এই পরিস্থিতি থেকে লাভবান হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, “এই মুনাফা আসে এমন সব ভয়াবহ কর্মকাণ্ড থেকেযা মিয়ানমারসহ অন্যান্য বহু দেশের মানুষের জীবন ধ্বংস করছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ জাতিগত মিলিশিয়াগুলোই অবৈধ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। সামরিক জান্তার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে তাদের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় আয়ের কিছু উৎস কমে গেলেওগণতন্ত্রপন্থী ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও বোঝেযুদ্ধ চালাতে গেলে এমন অবৈধ অর্থই সবচেয়ে সহজ বিকল্প।

নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক বছরগুলোর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে করা প্রতিবেদনে স্পষ্ট বোঝা যায় যেকীভাবে দেশটির ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে তীব্রতর করছেআর দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে দুর্নীতিআসক্তি ও মানবিক বিপর্যয়।

মিয়ানমারের সামরিক-শিল্প অপরাধ জগতের প্রধান কয়েকটি খাত নিচে তুলে ধরা হলো:

১.খোলামেলা আফিম চাষ

শান রাজ্যের পাহাড়ে আফিমগাছকে শান্তির ফুল” বলা হয়। এর নামই যথেষ্টবিদ্রূপাত্মককারণ শান রাজ্যে বহু দশক ধরে প্রকৃত শান্তি নেই। এখানে বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী একে অপরের ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যমাটি আর সম্পদের দখল ছাড়াও মাদকের বাণিজ্যই তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

এবারের মৌসুমে শান রাজ্যের পেকোন টাউনশিপএ আফিম চাষ নতুন মাত্রা পেয়েছে। আগে কৃষকরা পাহাড়ের গহিনে বা উপত্যকায় গোপনে চাষ করতোযেন কোনো বাহিনী এসে পপি ক্ষেত ধ্বংস বা শুল্ক আদায় করতে না পারে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এই মৌসুমে কৃষকরা প্রকাশ্যেই গ্রামসংলগ্ন জমিতে আফিমের ফুলের ক্ষেত লাগিয়েছে। সেচব্যবস্থা জটিল হলেও প্রশস্তফলে গির্জামন্দিরপুলিশ স্টেশন এবং পৌর ভবনের পাশেও দোল খাচ্ছে আফিমের ফুল। তারা নির্ভয়ে আফিমের কষ সংগ্রহ করছে।

এখন আর কোনো সরকার বা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেইতাই লুকিয়ে রাখার দরকার পড়ে না,” বলছিলেন দও হলা উইন। নিজের বাড়ির কাছের জমিতে আফিম চাষ সেরে ফেরার পথে তিনি বললেন, “এটা আমাদের জন্য আফিম চাষের সেরা সময়।

অভ্যুত্থানের আগে নির্বাচিত সরকার ও বিদেশি সংস্থাগুলো এখানকার কৃষকদের সাবস্টিটিউট শস্যযেমন অ্যাভোকাডোকফি বা ভুট্টাচাষে আগ্রহী করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্গম ও দরিদ্র এই এলাকায় সেসব শস্যের বাজারমূল্য খুব কম। তাছাড়া আফিম তাদের বহুদিনের ঐতিহ্যগত ওষুধ হিসেবেও সামান্য পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং অর্থের দিক থেকেও বেশ লাভজনক। চলতি মৌসুমে প্রতি পাউন্ড আফিমের দাম ৪৩০ ডলার পর্যন্ত উঠেছেযা কয়েক বছর আগের তিন গুণ।

জীবনে কখন কী হয় বলা মুশকিল,” বললেন কো হতেইন লিনযিনি তার জমি পুরোটাই আফিমের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। সময় থাকতে আমাদের অর্থ উপার্জন করতে হবে।

ইউএনওডিসি অনুমান করছেশান রাজ্যের আফিম থেকে তৈরি হেরোইন এ বছর প্রায় ১.২৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যে রপ্তানি হয়েছে। আবার পেকোন এলাকার অধিকাংশ কৃষকই বাস্তুচ্যুতযারা ভাগচাষি হিসেবে দিনে মাত্র ২ ডলার আয় করে। আমি বাঁচতে চাই,” বললেন কো Pa লেযিনি পরিবারসহ সামরিক বাহিনীর বিমান হামলা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন।

প্রায় এক বছর আগে প্রতিরোধ আন্দোলনের আক্রমণে সামরিক বাহিনী পেকোন অঞ্চলের বেশ কয়েকটি শহর থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে সেখানকার আফিম খেত এখন সরকারবিরোধী এক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীযারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান হামলা ও ড্রোন দিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছেএবং তাদের মিত্র মিলিশিয়াগুলো স্থানীয়ভাবে চাষ করা আফিমের বড় ক্রেতা। প্রতিরোধকামী কিছু গোষ্ঠীও পপি থেকে অর্থ উপার্জনের পথ নিয়েছেযদিও অন্যরা মাদকের সঙ্গে জড়ায়নি।

যে কেউ কিনতে এলে আমরা বিক্রি করি,” বললেন কো মায়ো লেপেকোনের আরেক আফিম চাষি। আমি ওদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করি না।

২.জঙ্গলে গড়ে ওঠা মাদক-কারখানা

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত সারা দেশকে অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এক বোতল বিয়ারের দাম যেখানে প্রায় ১ ডলারসেখানে মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ইয়াবা” নামে পরিচিত ক্ষুদ্র গোলাপি ট্যাবলেটের দাম ২৫ সেন্টেরও কম। গত বছর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রেকর্ড ১৯০ টন মেথামফেটামিন জব্দ হয়েছে বলে ইউএনওডিসি জানায়। এত বিশাল পরিমাণ জব্দ হওয়া সত্ত্বেও ইয়াবার দাম কমেই যাচ্ছেকারণ শান রাজ্যের জঙ্গলে কারখানাগুলো ফুল সক্ষমতায় পণ্য তৈরি করছে।

অভ্যুত্থানের আগেই মিয়ানমারে সিনথেটিক মাদকের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। শান রাজ্যের স্বায়ত্তশাসিত কিছু অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতসামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা এই ব্যবসা থেকে শেয়ার নিত। সাবেক পাইলটদের ভাষ্যমতেসামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে প্যাকেট ভর্তি ট্যাবলেট ও আইস (ক্রিস্টাল মেথ) শহর ও বন্দরে পৌঁছে যেত।

মিয়ানমারে মাদক উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়বিশেষ করে চীনে কড়াকড়ি আরোপের পর। চীনা রাসায়নিক প্রিকার্সার ও ল্যাব টেকনিশিয়ানরা মিয়ানমারে এসে তাদের জ্ঞান ও যন্ত্রপাতি দিয়ে স্থানীয়দের মেথামফেটামিন তৈরিতে সাহায্য করেছে। ফলে জঙ্গলের গোপন কারখানাগুলোতেও ইয়াবার বড় বড় চালান তৈরি হচ্ছে।

২০১৯ সালে শান রাজ্যের কনেমন গ্রামে দেখা গিয়েছিলকীভাবে পুরো গ্রামই ইয়াবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তখন স্থানীয়রা জানিয়েছিলতিনটি ছাড়া বাকি সব বাড়িতেই কোনো না কোনোভাবে ইয়াবা উৎপাদন চলে। রাতে জেনারেটরের গুনগুন শব্দ শোনা যেতঅ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে এলাকায় দূষিত বাতাস বইত।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এসব ল্যাবে মাদক উৎপাদনের মাত্রা আরও বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। শান রাজ্যের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন ধরনের ক্লাব ড্রাগও বানাতে শুরু করেছেযেগুলো হ্যাপি ওয়াটার” বা ললিপপ নামেও পরিচিত। এতে কেটামিনএমডিএমএ ও মেথামফেটামিনের মিশ্রণ থাকে।

শান রাজ্যের জঙ্গলে তৈরি সিনথেটিক মাদক লাওস ও থাইল্যান্ডের দিকে যাচ্ছেপুরোনো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলের কেন্দ্রে। আবার বাংলাদেশ ও ভারতেও এসব মাদক পাচার করা হচ্ছে বিদ্রোহীদের মাধ্যমেযারা একদিকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেঅন্যদিকে মাদক ব্যবসা থেকেও অর্থ উপার্জন করছে।

মণ্ডলয় শহরেযা মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরপ্রায় ৪০ জন ট্যাটু করা রাইফেলধারী লোক রয়েছে যারা সরকারি অনুমোদিত তথাকথিত পিপলস মিলিশিয়ার সদস্য। তারা কখনো কখনো সামরিক হুকুমে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমন করে বা কোনো ব্যবসায়ীকে হুমকি দেয়। তবে বেশির ভাগ সময়েই তারা শান রাজ্য থেকে সিনথেটিক মাদক নগরে আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করে।

পিপলস মিলিশিয়া বলা হলেও আমাদের কখনো কখনো সামান্য যুদ্ধই করতে হয়,” বললেন কো ইয়েওই দলের এক সদস্য। আমরা মূলত মাদক ব্যবসায় যুক্ত।

 ৩.বৈশ্বিক পরিসরে প্রতারণার কল-কারখানা

মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের একসময়কার ঘন জঙ্গলে কো কিয়াও হতেই ১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করতেন জানালেনতাঁরা প্রায় ৪০ জন প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁদের প্রধান কাজ ছিল সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগ রক্ষা করা: চীনমেক্সিকোজাপানইতালিভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সঙ্গে।

ফ্রান্সের বাসিন্দাদের টার্গেট করেছিলেন কো কyaw হতেই। গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করে তিনি ফরাসি বিধবা বা একাকী নারীদের উদ্দেশে লিখতেন, “তুমি কত সুন্দর,” সঙ্গে থাকত হার্ট ইমোজি। আবার কখনো লম্বা চুলের কোনো এশীয় নারীর ছবি প্রোফাইলে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙা ফরাসিতে বয়স্ক পুরুষদের প্রলুব্ধ করতেন।

রোমান্স ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর বিনিয়োগের কথা তুলতেন। যেমনএক ফরাসি বিধবাকে তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সি-সমর্থিত হাউজিং প্রকল্পে” যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি রাজি হন। কো কিয়াও হতেই জানালেনএভাবে এক মাসে তিনি প্রায় ৮০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন। তাঁকে মাসিক প্রায় ৪৪৫ ডলার বেতন দেওয়া হতোযা অভ্যুত্থানের পরের মিয়ানমারে খারাপ নয়। তবে ওই একই ঘরে কাজ করা চারজন আফ্রিকানসাতজন ভারতীয় ও পাঁচজন চীনা নাগরিককে জোরপূর্বক এই কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

জাতিসংঘের হিসাবে২০২২ সালে অন্তত ১২০,০০০ বিদেশিকে মিয়ানমারের এইসব অনলাইন প্রতারণা ও জুয়ার কল-কারখানায় বলপূর্বক নিয়ে আসা হয়েছে। কেউ কেউ দালালের মাধ্যমে এখানে কাস্টমার সার্ভিস’ বা আইটি’-র কাজের প্রলোভনে এসে আটকা পড়েছেনআবার অনেককে চীনের রাস্তায় অপহরণ করে বন্ধুকের মুখে এখানে এনে বিক্রি করা হয়েছে। সীমান্তের শান ও কারেন রাজ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও অরাজক এলাকাগুলোতে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের। সেসব এলাকা মূলত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও চীনা অপরাধচক্রের কর্তৃত্বে।

শান ও কারেন রাজ্যের বহু এলাকা বহু বছর ধরেই সামরিক বাহিনীর মিত্র জাতিগত কমান্ডারদের হাতে অঘোষিত স্বায়ত্তশাসনে ছিল। অভ্যুত্থানের পর সেসব অঞ্চলে উঁচু ভবন আর ভুয়া কল-সেন্টারের গোডাউন ব্যাপকহারে গড়ে উঠেছে। এ ধরনের কারবারে প্রধানত ম্যান্ডারিন ভাষার ব্যবহার চলেকারণ মূল অপারেটর ও গডফাদারেরা চীনা।

২০২২ সালে মিয়ানমারে ৪০,০০০-এর বেশি চীনা নাগরিককে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে চীনে ফেরত পাঠানো হয়। কেবল হাতে গোনা কয়েকজন চীনা গডফাদারকে ধরা গিয়েছে। প্রতারণা কমপ্লেক্সে গোলাগুলির ঘটনায় কিছু চীনা নাগরিক নিহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।

সেখানে কাজ করা মিয়ানমারের নাগরিকেরা জানানচীনা সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে এখন প্রতারকেরা আর আগের মতো চীনা ভুক্তভোগীদের লক্ষ্য করছে নাবরং আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষদের দিকে ঝুঁকছে। সম্প্রতি জালিয়াতির পদ্ধতিতে আরও নতুন নতুন কৌশল যোগ হয়েছেডিপফেইক ছবি তৈরির‍্যানসমওয়্যার ব্যবহার ইত্যাদি।

এসব প্রতারণার কল-কারখানা একটা ব্যাপক ভয়াবহতার উদাহরণ,” বললেন ইউএনওডিসি-র মাসুদ করিমীপুর। থাই সরকার কিছু এলাকার বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেকিন্তু কোনো এলাকায় অভিযান হলে অপরাধচক্র দ্রুত অন্য জায়গায় ঘাঁটি গাড়ছে।

৮ মাস পর মিঃ কিয়াও হতেই ফরাসি বৃদ্ধাদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অনুতপ্ত হয়ে সেই জালিয়াতির কারখানা থেকে পালান। তিনি উল্লেখ করলেন এক বৃদ্ধার কথাযিনি স্বামীর মৃত্যুশোক ভাগাভাগি করেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে ওই বৃদ্ধার আস্থা অর্জন করেনআর বৃদ্ধা ভালোবাসার কথা জানিয়ে তাঁদের যৌথ বিনিয়োগে’ ১৫,০০০ ইউরো ঢেলে দেন। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব।

ওই নারীর বিশ্বাস আর আশাবাদ আমাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়,” বললেন কো কিয়াও হতেই। আমি সত্যিই অনুতপ্ত।

৪.সর্বাত্মক খনির উন্মাদনা

অভ্যুত্থানের তিন মাস আগে মিয়ানমারের উত্তরে কাচিন রাজ্যের পাংওয়া এলাকায় মাত্র ১৫টি রেয়ার আর্থ খনি ছিল। অভ্যুত্থানের তিন মাস পর সেই সংখ্যা পাঁচ গুণে দাঁড়ায়জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

২০২২ সালে ধারণা করা হয়মিয়ানমার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কিছু ভারী রেয়ার আর্থযেমন ডিসপ্রোসিয়াম ও টার্বিয়াম রপ্তানি করেযা বৈদ্যুতিক যানবাহন ও উইন্ড টারবাইনের মতো প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। (সরকারি কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেইতবে ২০২৩ সালে পাওয়া চীনা কাস্টমসের তথ্য বলছেমিয়ানমার থেকে আমদানি চীনের নিজস্ব কোটা থেকেও বেশি।)

চীন নিজেই রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াকরণের ওপর বিশ্ববাজার প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার পরিবেশগত ক্ষতির কারণে এসব খনি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় সামরিক জান্তা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় চীনের সহায়তায় তারা এ খাতকে অর্থউপার্জনের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে।

কাচিন রাজ্যের পাংওয়ার নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর মিত্র একটি জাতিগত মিলিশিয়ার হাতে ছিল। পরিবেশ বা শ্রমিকদের নিরাপত্তা কোনোভাবেই নিশ্চিত না থাকায় পাংওয়া দ্রুত মাত্রাতিরিক্ত খনির শহরে পরিণত হয়। শয়ে শয়ে চীনা খনি-মালিক ও প্রযুক্তিবিদ সেখানে আসেন। স্থানীয়রা দেখেছেকয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় সব পাইন বন উজাড় হয়ে গেছে। শুধু একটি কবরস্থানের আশপাশের গাছগুলো অবশিষ্ট ছিলযেখানে স্থানীয় মিলিশিয়া নেতার দাদির কবর।

খনি থেকে পাওয়া টাকার লোভে পাংওয়ার বাসিন্দারা সারাদিন খনিতে কাজ করে। তারা শক্তিশালী অ্যাসিড দিয়ে মাটির খনি গর্তে কাজ করেফলে হাতে ফোসকা পড়ে আর শ্বাসকষ্টজনিত নানা সমস্যায় ভোগে। দিনটা পার করতে তাদের অনেকেই ইয়াবার শরণাপন্ন হয়। কো সান হ্লাইং বললেন, “আমরা যা উপার্জন করিতার বেশির ভাগই আবার ইয়াবা কিনতে খরচ হয়ে যায়। কাজ আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেআর ইয়াবা আমাদের জীবনটা শেষ করে দেয়।

অসংখ্য বিষাক্ত রাসায়নিক মাটিতে মিশে জমিকে বিষাক্ত করে তুলছে। বহু মানুষ এখন আর পানি পান করতে ভয় পায়। এদিকে কাচিন রাজ্যের বহু জেড খনি ও অন্যান্য খনিতে প্রায়ই ধস নামেপ্রতিবছর অনেকে প্রাণ হারায়।

অক্টোবরে কাচিন স্বাধীনতা বাহিনী (কেআইএ)যারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গঠিত বিদ্রোহী জোটের অংশপাংওয়া দখল করে। এখন পুরো চীন-কাচিন সীমান্ত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণেযেখান দিয়ে আগে রেয়ার আর্থকাঠজেড ও অন্যান্য খনিজ পাচার হতো। কয়েক সপ্তাহের জন্য পাংওয়ায় রেয়ার আর্থের খনির কাজ বন্ধ ছিলচীনা শ্রমিকেরা ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু অন্য এলাকাগুলোতেও নতুন করে খনি খোঁড়ার প্রকোপ বাড়ছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়আরও বিস্তৃত এলাকা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠছে।

কাচিন স্বাধীনতা সংস্থার মুখপাত্র কর্নেল নাউ বু বললেন, “আমরা কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। আমরা যদি বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাইতবে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি যেন না হয় সে চেষ্টা করব।” তিনি জানানইতোমধ্যে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয়েছেযদিও কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ বছরের শেষদিকে এক কাচিন প্রতিনিধিদল চীনে গিয়েছে বৈঠক করতে।

কিন্তু পাংওয়ার মানুষ জানায়ইতোমধ্যেই কিছু খনি আবার চালু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে রেয়ার আর্থযেখানে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছেসেগুলো আবারও বিশ্ব বাজারে যোগ হচ্ছেযেখানে সবুজ বিপ্লবের” জন্য এধরনের খনিজের চাহিদা তুঙ্গে।

হান্না বিচ বহু বছর ধরে এশিয়া নিয়ে কাজ করছেনবর্তমানে তিনি ব্যাংককে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক। দীর্ঘ অনুসন্ধানী ও গভীর প্রতিবেদন তৈরিতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024