ম্যাকসিম গোর্কী
একটি চিঠি
কথা ক’টি তীরের মতো গিয়ে পৌঁছলো আমার অন্তরে, আমি রোষে ক্ষোভে যন্ত্রণায় আকুল হ’য়ে কেঁদে উঠলাম। এখন আমি অর্ধ উন্মত্তের মতো কেবলই ভাবছি তাঁর কথা, যেমনটি তাঁকে আমি দেখেছিলাম, যেমনটি জেনেছিলাম-তাঁর সংগে একটিবার কথা বলার অসহ্য একটি বাসনা আমি দুঃসহ বেদনার মতো কেবলই অনুভব করছি। আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি, শবাধারে তিনি শায়িত, ঝর্ণার তলদেশে মসৃণ প্রস্তরের মতো; তাঁর শ্বেত-পক্ক গুম্ফ-শ্মশ্রুর আবরণে নিঃশব্দে গোপন রয়েছে তাঁর উদাস, নিরাসক্ত, রহস্যময় সেই মৃদুমন্দ হাসি। অবশেষে শান্তিভরে নিমীলিত হ’য়েছে তাঁর ছ’টি করপল্লব-তাঁর কঠিন কর্মের হ’য়েছে পরিসমাপ্তি।
মনে পড়ে, তাঁর তীক্ষ্ণধার ছাট চক্ষু-সে দু’টি তন্নতন্ন ক’রে দেখতো সব কিছু; আর মনে পড়ে, তাঁর অংগুলির সঞ্চালন; এই অংগুলিগুলি যেন অবিরাম শূন্য থেকে খোদাই ক’রে আনতো তাঁর কথাগুলি, তাঁর রসিকতা, তাঁর প্রিয় চাষাড়ে ভাষা, তাঁর এড়িয়ে-যাওয়া মিষ্টি সুর। আমি কেবলই দেখছি, কী বিশাল জীবনী শক্তি মূর্ত হয়ে উঠেছিল এই মানুষটির মধ্যে, কী অমানুষিক ভাবে বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি, আর ছিলেন কী ভয়ংকর।
আমি তাঁকে একবার দেখেছিলাম, যেমনটি সম্ভবত আর কেউ দেখে নি। গ্রাস্পার আমি একবার সমুদ্র তীরে তীরে তাঁর কাছে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ইউসুপভদের এস্টেটের ঠিক পিছন দিকে বেলাভূমিতে এদিক ওদিকে ছড়ানো পাথরের উপর দেখলাম, ছোট্টো বেঁকে পড়া তাঁর দেহটি। পরনে ছাই রঙের ভাঁজপড়া মোটা কাপড়ের স্যুট আর মাথায় দুমড়ানো একটা টুপী। ছ’টি হাতের ওপর মাথা রেখে ব’সে আছেন।
আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর দাড়ীর রূপালি চুলগুলিকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে হাওয়া: তিনি দূর সমুদ্রের পানে তাকিয়ে ব’সে আছেন। আনুগত্য ভরে তাঁর পায়ের তলায় এসে লুটিয়ে পড়ছে ছোট্টো সবুজাভ ঢেউগুলো, ‘আর তাঁর পাছটিকে সাদরে সোহাগে জড়িয়ে ধ’রে যেন নিজেদের কতো কথা তারা ব’লে যাচ্ছে ওই বুড়ো যাদুকরটিকে। সেদিন আকাশে ছিল সূর্য আর মেঘের খেলা; মেঘের ছায়াগুলি লঘুপায়ে এলো গেলো কতোবার পাথরের উপর দিয়ে; আর সেই সাথে তাঁর দেহ হ’য়ে উঠলো কখনো আলোকিত, কখনো বা অন্ধকার।
Leave a Reply