শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন

ভালোবাসার সকাল-বিকেল

  • Update Time : শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২৫, ৬.৪৫ পিএম

মণীশ রায়

প্রথম প্রথম হাসি পেতো খুব।

কাতুকুতু লাগার মতন হাসতে হাসতে রতন গড়িয়ে পড়তো মজুর শরীরে।

হাসতে হাসতেই এই ভালো লাগার শুরু। একটুখানি অন্তরঙ্গ হাসি-কৌতুক আর খানিকটা শিহরণ। সব মিলেমিশে অন্যরকম এক আনন্দ-সায়রে ডুবে যাওয়া।

এ যেনো নাপিতের হাঁটুর উপর নিজেকে সঁপে দিয়ে মাথা বানাবার সুখ শুরুর দিকে সামান্য উসখুস লাগলেও একটু পর ঠিকই চোখ বুজে আসে আরামে। দমকা হাওয়ায় নাকে ঝাপটা দিয়ে যায় কামিনী ফুল আর মগজে ছাতিম ফুলের ঝিম ধরানো নেশা। রতনের বেলায় তাই হলো। প্রথমে মনের ভেতর বর্ষাকালের ভরা নদীর কলকল-ছলছল করা উচ্ছ্বাস। তারপর জাফরানি আবেশে চুবানো এক মোহ।

কিছুদিন বাদে এমন হলো যে মজু কখন আসবে, কখন রতনের পাশে একটুখানি হাত-পা ছড়িয়ে এসে বসবে, সেজন্যে ঘণ্টার

পর ঘণ্টা পানকৌড়ির মতন সে বসে থাকতো গাঙপাড়ে।

কিছু আর মনে ধরে না তখন। সব বাদ দিয়ে কেবলি চলতি ছায়াছবির গান গাইতে ইচ্ছে করতো।

সারাক্ষণ আমি-তুমি গানে গুদাম-বোঝাই হয়ে থাকতো রতনের অন্তর।

মজু আসতো হেলে-দুলে।

লম্বা-ঢ্যাঙা গড়ন তার। কিশোর বয়সেই চোখ জুড়ে ছিল নিষ্ঠুর মদালস এক আবাহন। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় কোথাও এতোটুকু ভাব-ভালোবাসা নেই।

তাকালেই বুক ধড়ফড় করতো রতনের। তার উপর বাপের এয়ারগানটা সবসময় হাতেই থাকতো।

আউস করে খন্দকার চেয়ারম্যান ওকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, মৌলানা সাহেবদের দাবড়ানো খেয়ে কদিনেই মজুর দুরন্তপনা সব দূর হয়ে যাবে। কিন্তু আদরের দুলাল সে পথে হাঁটেনি।

মজুর একমাত্র কাজ ছিল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো আর কাইজা-ফ্যাসাদ বাধানো। কারও সঙ্গে

এতোটুকু বাদাবাদি হলেই এয়ারগান সোজা তার কানের কাছে ‘এক্কেরে হেইপার পাডাইয়া দিমু, চিনস?’ বলে তাক করতো। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স মজুর। তখনই পুরো গ্রাম ওর নখের ডগায় প্রতাপশালী খন্দকার চেয়ারম্যানকেও সমঝে চলতে হয় ছেলেকে। বেচারার তিন কন্যার পর হাজাররকম দোয়া-দুরুদ আর নিরলস চেষ্টা-তদ্বিরের ফসল এই ছাওয়াল, তাকে কি চাইলেই মাটির ঢেলার মতন ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায় গাঙে?

ছেলের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ-অনুযোগ তুললে চরম বিরক্ত তিনি; মনে হতো চোখ-মুখ কুঁচকে ডায়বেটিস রোগী গ্যালাস- গ্যালাস উচ্ছের তেতো রস গিলছেন; অস্থিও অবস্থায় কিছুক্ষণ কাটাবার পর একটাই বাধা উত্তর সাজানো থাকতো তার ঝুলিতে, তুমরা যা পার কর গা। পারলে মাইরা ফেলাও।’ বলতে গিয়ে বুকটা ফেটে যেতো খন্দকারের; তবু সবাইকে একই কথা শুনিয়ে গা বাঁচাতেন তিনি।

জবাব শুনে গ্রামের মানুষ একরকম ধন্দে পড়ে যেতো, মহাজনের মন কোনদিকে তা বুঝতে পারতো না কেউ। কিছুক্ষণ দম ধরে চুপ থাকার পর আপনাআপনি অন্য প্রসঙ্গে সটকে পড়তে হতো সবাইকে।

মজুর তুলনায় রতন কিছু নয়, আস্তাকুঁড়ের বাসি-পঁচা ফুল, কোনো কাজেই লাগে না। রতনের বাপ মিঞাচাঁন এ গ্রামের মাটি কোপানো শ্রমিক। সবাইকে নিয়ে গাদাগাদি করে খালপাড়ের একটা বেড়ার ঘরে থাকে। কোদাল-খলুই সম্বল তার। ডোবা- পুকুর কাটা কিংবা ডোবা-পুকুরের মাটি তুলে এনে উঠোন-ভিটা উঁচু করার কাজেই ওর ডাক পড়ে বেশি। সারাদিন দিনমজুর হিসাবে খেটে সে যা পায় তা দিয়ে সংসার চালায়। দুবেলা পেট পুরে ভাত খাওয়াটাই রতনদের জীবনের সবচেয়ে বড় জৌলুস। ওটুকু পেলেই ওরা সবাই সুখী। আর কিছু লাগে না।

এলাকায় আর সবার মতো রতনও ছিল মজুর ভয়ে কাতর।

দূর থেকে দেখলে ওকে একটা ষাঁড় বলে মনে হতো ওর। চোখে পড়বার আগেই গা-ঢাকা দিতো গলি-ঘুপচির ভেতর। রতনের প্রায় সমবয়সী সে। হয়তো এক-দুই বছরের বড় হতে পারে। তবু কিছুতেই মুখোমুখি হতে মন চাইতো না।

কখনও সখনও আচম্বিতে সামনে পড়ে গেলে কটমট করে ওরই দিকে তাকিয়ে থাকতো মজু। একদিন জোর করে রতনকে গাঙপাড়ে নিয়ে এলো। ফিসফিস করে ওকে বলল,’ তর দিকে কেরে চাইয়া থাহি জানছ?’

রতন মাথা নাড়ে। সে কি করে জানবে? গাঙের মৃদু বাতাসে কলমিদামের পাতা নড়ে, মজুর ঠোঁটের ফাঁকে অস্ফুট রহস্যময় হাসি।

মজু বলে, ‘খুসা ছাড়াইন্যা দুইডা বেতফল আছে তর চোহে। চাইলেই এয়ারগানডা দিরিম-দিরিম কইরা ওডে ভিতরে। তুই টের পাছ না?’

শোনার সঙ্গে সঙ্গে অজানা শিহরণে ভরে ওঠে রতনের শরীর-মন। জলার ধারের ধুতুরা গাছের মতন নিরন্তর অনাদর আর অবজ্ঞা পেয়ে বেড়ে উঠেছে সে। এরকম করে কেউ কোনোদিন কথা কয়নি ওর সঙ্গে। স্পষ্ট সে টের পাচ্ছে, ওর শরীরের ভিতরে যেন আরেকটা শরীর, তার ভেতরে আরেকটা। মহুর্তে সব তছনছ। রতন বুঝতে পারছিল এ ঠিক আদর নয়; বুকের গহিন থেকে উঠে আসা বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক মেঘমালা। উড়তে উড়তে ওর খুব কাছে চলে এসেছে সেটি; গাঙের উপর নীল-সাদা চাঁদোয়া হয়ে ছড়িয়ে থাকা আকাশটাও সেই মেঘের ভেতর লুকোচুরি খেলায় মগ্ন।

‘আমার কাতুকুতু লাগে, মজু। মইজ্যা, ছাড়স না কেরে? ছাড়?’ রতন আর কথা বলতে পারে না। কলমিদামের উপর দিয়ে বাতাস বইছে ঘাটে। সেখানে একটা ফড়িংকে ফরফর করতে দেখছে সে। এর ঠিক পিছনে একটা ভিমরুল। কিম্ভুতভাবে পাখা নাড়াচ্ছে, মুখে অবিরাম ভোঁ-ভোঁ। এক্ষুণি কামড়ে দেবে নাকি?

8

একটু বাদে জলার ধারে হাত-পা ছড়ানো মজু রতনকে গালি দিয়ে উঠল, ‘ওই কুত্তার বাইচ্চা, ব্যাং খুঁইজ্যা পাইছস? কইলাম না, আসল ব্যাং না পাইলে তরে ব্যাং বানামু? আমার ব্যাং কই, চুদানির ফুত, ব্যাং কই?’

নিমেষে রতনের আবেশ কেটে যায়। সে ছুটে গিয়ে জলার কিনারে নিরীহ দুটো ব্যাং দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওই যে, একটার উপরে আরেকটা উইঠা রইছে। লড়তাছে, মজা করতাছে। কিছু করিছ না ভাই? এইসময় কিছু করন ঠিক না রে।’ মিনমিন করে উত্তর দেয় রতন। হাত-পা তখনও কাঁপছে ওর অজানা ভয়ে। সে যদি নিজেই ব্যাং হয়ে যায়? মজুকে কি বিশ্বাস করা চলে? ডাকু একটা।

একবার গমের ভূষি ভরতি এক বস্তার ভেতর দুটো ফণিমনসার চারা লুকিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে দিল মজু। ঘরের ভেতর আত্মীয়-পরিজন সব। এমনি একজন আত্মীয়া বসার জায়গা না পেয়ে মজুর সেই বস্তার উপরই বসে পড়ে। মজু বলল, হারামি বেডি আমার লগে সেয়ানাগিরি দেহাইছিল। আমিও বেডির পাছা লাল কইরা দিছি। পাঁচশ ট্যাকার ওষুধ লাগছিল। হাহাহা।’

নির্মম অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে মজু।

‘বেডিডা কেডা?’ অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে রতন।

হাসি থামিয়ে নির্বিকারভাবে জবাব দিল আমার মাইজ্যা খালা।’ ফের উচ্চকিত হাসি।

এ-হেন মজুকে কি ব্যাং না দেখিয়ে উপায় আছে? রতন আবার বলে ওঠে, ‘ওই যে দ্যাখ, ব্যাং দুইডা নিজেরার ভিতরে মজা করতাছে। দ্যাখ চাইয়া? কী যে আনন্দে আছে, আহারে!

সঙ্গে সঙ্গে দ্রিম-দ্রিম-দ্রিম। মজুর হাতসই এমনি পাকা যে দুটো ব্যাং একসঙ্গে ধরাশায়ী।

জলার ধারের কদমগাছে অনেকগুলো পাখি কিচিরমিচির করছিল এসময়। শব্দ পেয়ে ওরা আকাশে এলোমেলো হয়ে উড়তে লাগল। অজানা ভয়ে গাছের পাতার সঙ্গে ওরাও থিতু হতে পারছে না কোথাও!

রতন তখন একটা শালিক পাখির মতন মজুর দিকে তাকিয়ে, এয়ারগানটা কি ওর দিকে তাক করবে সে?

কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছে না সে। তবু কেনো যে ওকেই ভালো লাগে!

এ গ্রামের অনেকেই মজুর এয়ারগানের গুলি খেয়েছে।

কথার সামান্য নড়চড় হলেই গুলি। পায়ে-হাতে-পিঠে আরও যে কতখানে। সব বলাও যায় না। শেষমেষ এমন হলো যে সে চা খেতে দোকানে ঢুকলেও দোকানদার সব ফেলে পালিয়ে যেতো। যদি সামান্য কথার হেরফেরে গুলি খেতে হয়, সেই ত্রাসে। রতনের বেলায় সেই ভয়-ডর নেই। ওর ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন। সে ওর নিত্যসঙ্গী। ছায়ার মতন, বাতাসের মতন, সূর্যালোকের মতন অবাধ ও স্বাধীন সে।

ভাবতেই রতনের চোখ বুজে আসতো গর্বে। নিরিবিলি গাঙপাড়ে যখন দুজন জড়াজড়ি করে ঘাসের উপর আনন্দ-শিহরণে গড়াগড়ি খেতো তখন বন্দুকটাকে একটা ডাংগুলি ছাড়া কিছুই মনে হতো না ওর। বেচারা ব্যাঙগুলোর জন্যে কচুপাতার জলের মতন বুকের কোথায় যেন টলোমলো করতো একফোঁটা করুণা; আবার প্রায়ই হাসি পেতো পালিয়ে বেড়ানো ভীত-সন্ত্রস্ত অসহায় মানুষগুলোর জন্যে।

মজু আর সে ছাড়া দুনিয়াদারির কিছুই আর ভালো লাগতো না তখন; সব মনে হতো ফালতু, নিরর্থক।

ঠিক এসময় হঠাৎ করে কেয়ার-টেকারের একটা চাকরি দিয়ে খন্দকার চেয়ারম্যান আচমকা রতনকে পাঠিয়ে দিল ঢাকায়। চেয়ারম্যানের দয়ায় ছেলে রোজগেরে হচ্ছে, এ আনন্দে থরথর কাঁপছে মুনিষ মিঞাচাঁনের শরীর।

‘হুজুর, আপনের দয়ার শরীর। আপনে সব।’

‘শর্ত একটাই।’

‘কিতা?’ গ্র্যানাইট পাথরের মতন মাজা কালো গায়ের রং আর পেটানো শরীর-স্বাস্থ্য হলেও মিঞাচাঁনের গলায় কোনো জোর নেই, গরিবি ওর সব শক্তি খুবলে খেয়েছে। নত হতে হতে মাথা এখন পা ছুঁতে চায়।

‘এই গ্যারামে ফিরতে পারব না তর পোলা। মজুর লগে কুনু সাক্ষাৎ হবে না, রাজি?’ রতনের উপর চেয়ারম্যানের শিকারি দৃষ্টি। এ চোখ চেনে রতন। এয়ারগানের গুলির চাইতেও ভয়ংকর। একে না বলা যায় না।

‘রাজি, হুজুর। আপনে যে কি কন?’ মিঞাচাঁন বাঁকা হতে হতে মাটি ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে বিনয়ে। চোখের সামনে বিশাল এ সুযোগ নদীর তলার বালু ঘেঁটে স্বর্ণকণা খুঁজে পাওয়ার মতন সৌভাগ্যের ইঙ্গিত। এ কে কি হেলাফেলা করা যায়?। ‘তাইলে আইজ ভোরেই চইলা যাবে তর পোলা। আমার এক বন্ধুর পরিচিত হিন্দু দাদা উত্তরায় নতুন বাংলো বাড়ি কিনেছে।

খুব সুন্দর সেই বাড়ি। তাইনের বাড়ি পাহারা দিব তর পোলায়। খাইবো, দাইবো, ঘুমাইবো আর মাসকাবারে তুই গিয়া হাত ভরা ট্যাকা আনবি পোলার কাছ থেইক্যা। কিন্তু শর্ত একটাই, মজু য্যান না জানতে পারে। কিরে বদমায়েশ পোলা, শর্তে রাজি?’ এসময় মিঞাচাঁনের ছেলেকে ইশারা করেন খন্দকার চেয়ারম্যান।

রতন সরাসরি তাকাতে পারে না, কেবল মাথা নেড়ে সায় জানায়। ভেতরে ভেতরে বুকটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে, ছুটে গিয়ে মজুকে সে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে। তারপর সিনেমার সংলাপের মাতম তুলবে এভাবে, মজু, আমারে বাঁচা। তর বাপ আমরারে মাইন্যা নিতে পারতাছে না। ঢাকায় পাড়াইয়া দিতে চায়। মজু, বাঁচা তুই আমারে।’

কিন্তু বাস্তবে ওর মুখ থেকে একটি কথাও বের হলো না। সে তার বাপের চাইতেও দুর্বল ও নতশির। তাই নত মন্ত্রকে সব

মেনে নেয়াই ওদের নিয়তি। মুখে বললো,’ জ্বে হুজুর।’

রতন চলে এলো উত্তরার প্রদ্যুত সাহার বাড়ির দেখাশোনা করার লোক হয়ে।

প্রদ্যুতের স্ত্রী শিবানী ওকে দেখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হায়-হায় করে ওঠেন,’ এ কারে নিয়া আসছ, তুমি? এ যে দুধের শিশু। আহা! মুখটা যে অসম্ভব মায়ায় ভরা।’ রতনের মাথায় হাত রেখে স্বামীকে প্রশ্ন করেন তিনি।

প্রদ্যুত রোডস এন্ড হাই ওয়েজের এক নম্বর ঠিকাদার। উঠতি বড়লোক। প্রশ্ন শুনে স্ত্রীকে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘কদিন ভাল করে খাওয়া-দাওয়া জুটলেই দেখবা একহাত লম্বা হয়ে গেছে। এমনিতেই লোক পাওয়া যায় না। তুমি আর তাল দিও না, আজাইরা ফ্যাকড়া বাধাইয়ো না।’

‘আহারে।’ বলে শিবানী মুখ দিয়ে বুদ্বুদের মতন একধরনের মমতা মেশানো দরদ প্রকাশ করেন রতনের প্রতি। ঠাণ্ডা হতের তালু দিয়ে আদর দেন রতনের গালে। এসময় শিবানীর পাশে এসে দাঁড়ায় ওদের একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তান জয়া। হয়তো রতনের বয়সী কিংবা খানিকটা ছোটো। বেশ কিছুক্ষণ রতনকে পরখ করার পর এক অজানা কারণে হাতমুখ আর শরীর নেড়ে তার মা-বাবাকে জানালো, সে-ও খুশি!

মেয়েটা সহজে হাসে না। যখন হাসে তখন জোনাক জ্বলে ওর দুচোখে। সেই বিরল অপার্থিব আলোর কণার দিকে তাকিয়ে প্রদ্যুত স্ত্রীকে বলে উঠলেন,’ বলছিলাম না, তোমার মেয়েও খুশি হবে?’

শিবানী একথার কোনো উত্তর দেন না; বারান্দায় কিংবা লনের বাগানে নতুন বনসাঁইর টব সাজানোর মতন রতনকেও তিনি মেনে নেন হাসিমুখে। তৃপ্তিভরা সেই হাসি মেঘলা দিনের মিহি-মিষ্টি সূর্যালোক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওর গৌরবর্ণ মুখাবয়বের পরতে পরতে!

রতনের মন ভরে যায় এক অনাবিল আনন্দে। এ যেন এক নতুন গাঙপাড়, পুরনোটার সঙ্গে কোনোরকম মিল নেই এর!

নতুন আশ্রয়, নতুন বিছানা, নতুন মানুষ আর টবে গুছানো নতুন গাছপালা। সব মিলিয়ে অপরিচিত অথচ মনভরানো এক পরিবেশ। তবু মা-বাবা-ভাই-বোন আর মজুকে ছেড়ে নতুন এ বাসায় রতনের একা একা ঘুম আসছিলো না।

বুক ফেটে ক্ষণে-ক্ষণে কেবল কান্না পাচ্ছে ওর। মজুকে মনে পড়ছে খুব। একটা নিষ্ঠুর, নির্দয়, হারামি কিসিমের সময়বয়সী এক পুরুষ, তবু দস্যুটার জন্যেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে বারবার। চারপাশের সবকিছু ফাঁকা লাগছে। এতো কষ্ট, এতো যাতনা চোখের জলে বালিশ ভিজে একেবারে জবজবে। বুকের ভেতর বিধে থাকা বেলকাঁটাটা কিছুতেই সরছে না। বালিশে মুখ ঢেকে অবিরাম সে হোঃ হোঃ করে কেঁদে উঠছে, ও মা। মাগো।’ এ যেন মা নয়, মজুকেই সে ডাকছে কাতরভাবে!

নতুন জায়গায় কদিনেই থিতু হয়ে এলো রতন; কাজ তেমন কিছু নয়। হিমশীতল গাড়িতে করে জয়াকে ওর বিশেষ স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর ঠিক সময়ে ফিরিয়ে আনা এই তার প্রধান কাজ। বাদবাকি সব ফুট-ফরমাশ, দুদিনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে: কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি।

এমনিতে রতন শান্ত প্রকৃতির ছেলে। মায়ের মতন ওরও অসম্ভব ধৈর্যশক্তি রাগ বলে কিছু নেই শরীরে। বছরখানেক ধরে ঢাকার এই বাড়িটায় থেকে আর ভালো খেয়ে-পরে শরীরের চেকনাই যেনো আরও বেড়ে গেছে, অপুষ্ট হাত-পা-শরীর মাংসল হয়েছে। চেহারটা হয়েছে আরও নধরকান্তি।

মাঝবয়সী শিবানীর বড় অদ্ভুত ধাত সারাক্ষণ আবেগে ভাসে। কখনও ক্ষেপে গিয়ে যা-তা বলে ফেলেন। আবার একই মানুষের ভেতরে আবেগের ধুসর ধোঁয়া ছড়ালে রতনকে শোনান,’তুই আমার ছেলে হবি, বাপ? জয়ার দাদা হয়ে থাকবি সবসময়? থাকবি?’ ছেলে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেনো তাকে পাগল করে তোলে মাঝে মাঝে। রতন সব বুঝতে পারে না, তবু মায়া লাগে। নিজের মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে কোথাও কোনো তল না পেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে। চোখের সামনে ভাসে ছটা ভাই-বোনের ক্ষুধাক্লিষ্ট চেহারা।

তবু একইরকম মায়ার নানারূপ যেনো ওর পথ ছাড়ে না। গাঙপাড়ে মজুর সংঙ্গে যে মায়া-মায়া খেলাটা খেলে সে অভ্যন্ত, বাস্তবে মন-ছোঁয়া একই আদর খুঁজে পায় মহিলার কথায় ও ব্যবহারে। চোখেমুখে একই কাঙালিপনা। বড় ভালো লাগে রতনের। কল্পনায় সে জলার উপর কলমিদামটা দেখতে পায়। বাতাসে দোল খাচ্ছে। একটা ফড়িং, এর পিছু নেয়া একটা ফাজিল ভিমরুল।

কতোদিন সে নিজের গ্রামের বাড়ি যেতে পারে না। মনে হলে আনমনা হয়ে যায় সে। সবার কথা, বিশেষ করে মজুকে মনে হলে কেনো যে বুকের ভেতরটা হাউমাউ করে ওঠে। কতোদিন কেটে গেলো; তবু আবেগের রংগুলো পাগলের মতন নীলাকাশে একইরকম ছুটে বেড়ায়।

মিঞাচাঁন প্রতিমাসে ছেলের সাথে দেখা করতে আসে ঢাকার উত্তরায়। বেশিক্ষণ থাকে না। টাকা নিয়েই কেটে পড়ে। মনে হবে বেতন রতনের নয়, তার নিজের।

বাপকে দেখতে পেয়ে প্রথমেই রতন জিজ্ঞাসা করে,’ বাড়ির হগলে বালা, আব্বা?

মিঞাচাঁন একথার ধারেকাছে নেই। সে তখন মাসোহারার টাকা গোনায় ব্যস্ত। কোনো কারণে দশ টাকা কম পড়লে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করবে, দশ ট্যাকা যে কম? গ্যারামে আমরা কত কষ্টে থাহি, জানছ?’ বাপের গলায় প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা। রতন ঠিকই টের পায়।

যাবার সময় এককথা বারবার,’ লোক কেমন?’

‘খুব ভালা।’

‘খাওন-পিন্ধন ঠিকঠাক দেয় তো?’

‘কওন লাগে না।’ গলায় জোর এনে উত্তর দেয় রতন।

মিঞাচাঁন আর কথা বাড়ায় না। হাতভরা টাকা নিয়ে অবাক চোখে বাংলো বাড়িটির দিকে তাকাতে তাকাতে গেটের বাইরে চলে আসে। সারামাসে আর যোগাযোগ নেই রতনের সঙ্গে। ঘুণাক্ষরে একবারের জন্যেও ওকে গ্রামে যাওয়ার কথা বলে না বুড়ো। যদি সমস্ত সুবিধা নিমেষে বন্ধ হয়ে যায়, সেই শঙ্কায়।

শিবানী একদিন দূর থেকে ওর বাবাকে দেখতে পেয়ে বললেন,’ এইটা তোমার আব্বা? তুমি পরিচয় করিয়ে দেবে না? ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসাতে পারলে না? আহারে, লোকটারে না খাইয়ে তাড়িয়ে দিলে?’

‘আরেকদিন আইলে কমু।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় রতন। বাপ চলে গেলে মনটা ওর বিষণ্ণ থাকে সারাদিন। বন্ধু-পরিজনের স্মৃতি

বড় দগদায় ওকে।

‘অবশ্যই বলবে। বলবে কিন্তু।’ বলে তিনি অন্যদিকে চলে যান।

শিবানী শুধুই গৃহিনী নন। চাকরি করেন সরকারী স্কুলে। সারাক্ষণ ব্যস্ত। তবু সবার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় মিষ্টি করে কথা

বলেন। মেজাজ খারাপ হলে কিছুক্ষণ আবোল-তাবোল কটুকথা বলেন বটে। তবে তাও মন্দ লাগে না, কোথাও এতটুকু হিংস্রতা নেই। একটু বাদে মেজাজ পড়ে গেলে একেবারে অন্যরকম, রাস্তার কলের মতন তখন আদরের আর শেষ নেই। কতোকিছু যে খেতে দেন তখন। কতো যে অকারণ সোহাগ প্রকাশ পায় আচরণে। মনে হয় সত্যিকারের আপনজন তিনি।

এ জীবনে এরকম মানুষ সে প্রথম দেখছে। ওদের গ্রামে বলতে গেলে সবাই রতনদের মতো গরিব-গুর্বোদের কারণে-অকারণে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বেড়ায়। তুই-তুকারি ছাড়া কেউ কথা বলতে চায় না। শুধু মজুর কাছে দুদন্ড বসলে নিজেকে আর বিড়াল-

কুকুর বলে মনে হতো না। বিবশ হয়ে আসতো তনু-মন সব।

নতুন করে সেরকমই এক মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে এ পরিবারটির সঙ্গে রতন। শিবানীর একমাত্র কন্যা জয়া রতনের চাইতে বছর চারেকের ছোটো সারাদিন কারণে-অকারণে শুধু খিলখিল করে হাসে আর রতনকে দাদা বলে ডাকে। কথা স্পষ্ট নয়। জিহ্বায় সামান্য বাজে। তবু কদিনেই আকার-ইঙ্গিতে বলা ওর সব কথা রতন বুঝতে পারে এখন। তাতেই প্রদ্যুত-শিবানী মহা খুশি। মেয়েটা কখনও ভালো কোনো কার্টুন দেখলে কিংবা ভালো খাওয়া-দাওয়া হলে ছুটে আসে নিচতলায় ওর ঘরে, দাদ্দা, দাদ্দা, খাবে?’

‘পরে’

‘না। অক্কন খাবে? আসো, আসো।’ বলে এঁকে-বেঁকে ওকে টেনে নিয়ে যায় ডাইনিং রুমে।

রতন লেখাপড়া কিছুই করেনি। বোধ-বুদ্ধিও অকিঞ্চিৎকর; তবু মনে হয়, এর নাম মায়া। এ মহব্বত কেবল মানুষে-মানুষেই সম্ভব। যেমন হয়েছে রতনে-মজুতে।

‘রতন, জান আমার। ওঠ। দ্যাখ, আমি আইসা পড়ছি।’

ছুটির দিনের সকালবেলা। আকাশে কালো মেঘের বেপরোয়া আনাগোনা। হঠাৎ বৃষ্টি এসে চারপাশ তছনছ করে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য সব সুনসান, ক-ফোঁটা অশ্রুর মতন বৃষ্টিবিন্দুগুলো যু-ক্যালিপটাসের পাতা ছুঁয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ভেজা মাটিতে ঝরে পড়ছে। ফের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাউন্ডুলে বৃষ্টিটা আবার উড়ে এসে জুড়ে বসছে। মনে হবে বৃষ্টি এখন পাগলি হয়ে মাথার উপর নেচে বেড়াচ্ছে, তা-থৈ, তা-তা-থৈ। দিনভর সূর্যের দেখা নেই; বাতাসে নির্বিঘ্ন ঘুমের আমেজ।

ফজরের আযান দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভোরবেলায় রতনের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে ফের একটা ঘুম দেয়া ওর অভ্যেস।

এর ভেতর রতন যেনো মজুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। এরকম আগে কখনও হয়নি। আধো ঘুম আধো জাগরণের ভেতর শরীর ওর বারবার করে শিউরে উঠছে।

সহসা ধড়ফড় করে চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসতেই সে চোখের সামনে যাকে দেখতে পেলো সে সত্যিকারের মজু, ওর ময়েজুদ্দিন।

প্রথমে সামান্য হোঁচট খেলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি। পুরো বদলে গেছে মজু। মুখভরা তার ঘন কালো চাপদাড়ি। পরনে সাদা আলখেল্লা। মাথায় পাগড়ি। পিঠে ঝুলানো র‍্যাক্সিনের ব্যাগ।

‘কিরে, তুই ভাবছস কি? এই জীবনে তরে পামু না আমি? দ্যাখ, তর লাইগা দুনিয়াদারি ছাইরা দিছি। দ্বীনের পথে চইল্যা গেছি। দ্যাখ ভালা কইরা আমারে। দ্যাখ?’

কথা শুনে চোখ বেয়ে রতনের জল গড়াতে শুরু করে। সে বিছানা থেকে নেমে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ে মজুর বুকে।

মজু ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর ঘরের ভেতর পা রাখে। বহুদিনের জমানো বেদনা বরফ হয়ে রয়েছে ওদের ভেতর। এই প্রথম সূর্যালোক পড়লো সেখানে। কোনো কথা নেই। নিঃশব্দ আদর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ওরা যেন বেদনাভরা সেই হতাশা থেকে নিজেদের মুক্তি দিতে চাইছে।

রতনের চোখে তখন গাঙপাড়ের নিসীম নীলাকাশ। সেখানে ছায়া ফেলছে চিরচেনা কলমিদাম। একটা ফড়িং, পিছু নেয়া এক অশান্ত-অস্থির ভিমরুল। কিছুতেই জায়গা ছাড়তে চাইছে না।

সহসা এসময় ভেজানো দরজা খুলে বসন্তদিনের দুধে-আলতা প্রথম রোদের মতন জয়া এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, দাদ্দা, দাদ্দা। ওটা কে? বন্ধু? ভাই?’ জয়ার কোলে একটা টেডিবিয়ার। মুখ ভরতি অহেতুক বেশরম হাসি।

ইলেকট্রিক ঝটকা খাওয়ার মতন মজু রতনকে ছেড়ে দেয়। জয়ার দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর মতন রতনকে প্রশ্ন করে, কেডা এই বেআক্কেল বেহা মাইয়াডা?’ চরম বিরক্তি মজুর চোখেমুখে।

‘মালিকের মাইয়া। খুব ভালা। জয়া দিদি। তুই এই রহম করতাছস কেরে?’ চাপা গলায় জানায় রতন।

‘ছিঃ?’ একরাশ তাচ্ছিল্য মজুর কণ্ঠে।

‘চুপ। শুনতে পাইবো তো।’ ভয়ে-সংকোচে রতন ডরে ডরে তাকায় জয়ার দিকে।

জয়া ঘাড়-গ্রীবা নেড়ে হাসিমুখে বলে, ‘দাদ্দা, মা ডাকছে। খেতে আসো।’ বলে সে চলে যায়।

মজু এবার একরাশ উষ্মা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রতনের উপর, ‘তুই ইগন একটা বেহা মাইয়ারে লইয়া আছস? তর লাইগ্যা গ্যারাম

ছাড়ছি। তর ঠিকানা যোগাড় করনের লাইগা কতবার যে বাপের গলাত বন্দুক ধরছি। তর লাইগ্যা দরবার-শরীফের খাদেম অইয়া কত জিকির করছি। হে পরওয়ারদিগার খোদা মেহেরবান আমার জানরে মিলাইয়া দ্যাও। আর তুই একটা ইহুদি- নাসারা-কাফেরের আস্তানায় ক্রীতদাস অইয়া আছোস? হায় খোদা, এর আগে আমার মরণ হইলো না কেরে?’ বলে সে দুহাত তুলে উপরের দিকে তাকায়। ওর দুচোখ জুড়ে মেঘভরা আকাশের রাশি রাশি ঠাডা-বিজলির মতন হতাশা।

ঘটনার আকস্মিকতায় রতন একেবারে থ। গ্রামে থাকতে মজু আর রতনের অনেক বন্ধু ছিলো হিন্দু। বেশিদিন আগের কথা তো নয়। টিংকু, বিকাশ, সুরেশ, উত্তম, শ্যামলকে কি ভোলা যায়? সব তো মজুর ভাব-শিষ্য আর বন্ধু সব ভুলে গেছে মজু? গ্রামের একপাশে খ্রিস্টানপাড়া, সেখানকার যোসেফ আর জগদীশ হালসোনা তো ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো সারাক্ষণ। সন্ধ্যা হলে গীর্জায় ওরা সবাই মিলে ওদের সমবেত কীর্তন শুনতে যেতো, প্রসাদ পেতো। কিছু বুঝতো না, তবু মজু-রতন সেসব শুনেই তো বড় হেেয়ছে। এখন সব হাওয়া?

প্রচণ্ড রাগে মজু কাঁপতে থাকে। গাঙপাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে ব্যাঙ মারবার সময় যেমন একধরনের হিংস্রতা ওর চেহারায় খেলা করতো, এখন তা-ই ভাসছে মজুর চোখে।

মজুকে সে চেনে। রেগে গেলে সে দুর্ধর্ষ ডাকাত বনে যায়। যা খুশি তা-ই করে ফেলতে পারে চক্ষের নিমেষে।

সে মজুকে শান্ত করতে নরোম সুরে জানায়, ‘এরা বড় ভাল মানুষ রে, মজু। তুই যেরহম ভাবতাছস, ওইরহম না। আমরার শ্যামইল্লার থেইক্যাও ভালা। মনে নাই? হে না নিজের বাড়ির ডাব চুরি কইরা তরে খাওয়াইতো? মনে নাই মজু?’

‘চোপ। আমি চল্লাম। তর এইখানে একদন্ডও না। চল্লাম।’ তীব্র অভিমান আর ঈর্ষা মজুকে ভিন্ন মানুষ বানিয়ে দেয়। ‘একটা কিছু মুহে দিয়া যা।’ কাতর গলায় অনুরোধ করে রতন।

‘আমি মুতি তর খাওনে। শালা বদমায়েশ কুনহানের।’ একদলা থুথু ফেলে সে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায় হনহন করে। রতনের চোখে একরাশ শূন্যতা খাঁ-খাঁ করে। এতোদিন পর মজুকে পেয়েও কাছে ধরে রাখতে না পারার বেদনায় মুহ্যমান সে। এ কি শুধুই মজুর ঈর্ষা নাকি এর চেয়েও বেশি অন্যকিছু?

রতন বুঝতে পারে না।

১০

সারাটা দিন মনমরা হয়ে রইলো রতন।

কিছুই আর আগের মতন ভালো লাগছে না। সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে। একটু আগে একপশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেলো। লনের কিনার ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক চিলতে বাগানের পাতাবাহার গাছগুলো ঘনঘন কাঁপছিল বৃষ্টির শিহরণে। অন্যসময় হলে ভাবত, গাছেরা বুঝি আনন্দে নাচছে। কিন্তু ওর যা মনের অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে, ওর চারপাশ কাঁদছে।

সামনে পুজো। শিবানী ওকে একখানা দামি পাঞ্জাবী উপহার দিয়েছেন সকালে নাশতার সময়। ওর থালায় পরোটা দিতে গিয়ে আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার রুমে কে এসেছিল, রতন? দোতলা থেকেও একটা হৈ-চৈ শুনতে পাচ্ছিলাম। কে?’ ‘জ্বে, আমার বন্ধু ময়েজুদ্দিন।’ মাথা নুয়ে পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরতে পুরতে উত্তর দিল রতন।

‘গ্রাম থেকে এল? থাকল না যে? ব্রেকফাস্ট করিয়ে দিতে পারতে।’ কথার কথা শিবানীর। তবু সেই ভদ্রতার ভেতরও যেন মায়া লুকিয়ে আছে। রতন ঠিক টের পায়।

পাশ থেকে প্রদ্যুতবাবু বলে উঠলেন, ‘বললাম না, গ্রামের বন্ধুই হবে। শহরের মানুষ অত জোরে কথা বলে না। হাহা।’

জয়া সব শুনছিল। এবার সে শিবানীর দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করে দিল। শিবানী যতো জিজ্ঞাসা করেন ‘কারণ কি হাসার’ ততো ওর হাসি বাড়তে থাকে। কিছুতেই থামতে চাইছে না। একসময় মেয়েকে ধমম লাগান শিবানী। এতে কাজ হয়। বরফের মতন ফর্সা জয়া চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, দাদ্দাকে দেখলাম বন্দুটারে জড়িয়ে ধরে বসসে থাকতে। এক্কেরে হিন্দি সিনেমার মত। হিহি।’ বলেই হাত-পা নেড়ে ফের হাসতে শুরু কওে দেয়।

রতন লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে থাকে এসময়।

ওর হয়ে প্রদ্যুত বলে ওঠে, ‘বন্ধুরা এরকমই করে। অনেকদিন পর দেখা তো। এটা হাসার কিছু নয়।’

রতন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

সে নিজের রুমে গিয়ে মজুর কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে প্রাণ খুলে কাঁদতে চাইছে কিছুক্ষণ। কিন্তু যার ছবি দেখে সে চোখের জল ঝরাবে, চিরচেনা মুখের সেই আদলটাই কেমন বদলে যাচ্ছে। বিষণ্ণ মন নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা বুজে আসে রতনের। ফের বৃষ্টির শব্দ চারপাশ জুড়ে। রতন তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন; আপ্রাণ চেষ্টা করছে মজুর জন্যে ভেতরে আবেগ জাগাতে। কিন্তু বারবারই অস্ফুট এক আর্তনাদ ওর বুকের তলা থেকে বের হয়ে আসছে, মজু, তুই আগের লাহান হ। মজু, তুই আগের লাহান হ।’

এসময় রতনের চোখের সামনে ভাসে গ্রামের জলায় বেড়ে ওঠা চেনা কলমিদাম। মৃদু বাতাস দোল দিচ্ছে তাতে। দামের উপর একটা ফড়িং, তিরতির করছে বাতাসে। এর সঙ্গে নতুন করে জোড় বাধে একটা রঙ্গিন প্রজাপতি।

এবার আগের মতন রতন আর ভয় পাচ্ছে না। প্রাণের আনন্দে রতন ডেকে ওঠে আয়, ফিরে আয় মজু।’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024