হাও নান
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদ ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়লের বিরুদ্ধে সামরিক আইন ঘোষণার ব্যর্থ প্রচেষ্টার দায়ে অভিশংসন পেশ করে। অভিশংসন প্রক্রিয়া এখন সাংবিধানিক আদালতে গিয়েছে, যা সর্বোচ্চ ছয় মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ফোন করে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেন।
নেতৃত্বশূন্য অবস্থার মধ্যেও দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতি কার্যক্রম সচল রয়েছে। ৯ ডিসেম্বর জাপান–দক্ষিণ কোরিয়া–যুক্তরাষ্ট্রের একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উত্তর কোরিয়া-সংক্রান্ত ইস্যুতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতার গুরুত্ব আবারও স্পষ্ট হয়। পিয়ংইয়াংয়ের বেড়ে চলা হুমকির জবাব দিতে এ অঞ্চলের ত্রিদেশীয় সহযোগিতা যে অপরিহার্য, তা এতে প্রতিফলিত হয়েছে।
কয়েক মাসের মধ্যে যদি বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা লি জে-মিয়ং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিদেশনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনেন, তাহলেও অন্তত তাঁর প্রশাসনের প্রাথমিক পর্বে এই ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল, বিশেষত বর্তমান শত্রুতাপূর্ণ আন্ত-কোরীয় সম্পর্কের কারণে।
একটি বড় ইতিবাচক যৌথ উদ্যোগ হলো ২০ নভেম্বর ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্র–দক্ষিণ কোরিয়া–জাপান ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা সচিবালয়ের প্রতিষ্ঠা। বাইডেন প্রশাসনের আমলে গত কয়েক বছরে যে ত্রিদেশীয় অংশীদারত্ব শক্তিশালী হয়েছে, এটি তারই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এই উদ্যোগ সময়োচিত, কেননা তিন দেশই তাদের কূটনৈতিক অর্জনগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে বদ্ধপরিকর, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন—এমন সম্ভাবনার কারণে।
সিউল ও টোকিওর জন্য এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ নিছক নীতিগত সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে একটি নিরপত্তা-ব্যবস্থা, দীর্ঘ পরিশ্রমে গড়া সম্পর্ক রক্ষা করার উপায় এবং উত্তর-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পথ চলার কৌশল।
এ বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এশিয়া জার’ কার্ট ক্যাম্পবেল তিন দেশের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে প্রথম এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। দীর্ঘ কয়েক মাস আলোচনার পর সেপ্টেম্বর মাসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৫ নভেম্বর পেরুর এপেক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। প্রাথমিকভাবে এটি দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থাপন করা হবে এবং প্রতি দুই বছর পরপর দেশ বদল করে সচিবালয় স্থানান্তরিত হবে। যদিও পরিকল্পনাটি বহুমুখী, এর মূল গুরুত্ব প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার দিকেই, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার হুমকি এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের দৃপ্ত অবস্থান মোকাবিলায়।
ঠিক এমন সময়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, যখন ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে লেনদেনে লাভ-লোকসানের মানদণ্ড এবং বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যয় ভাগাভাগির দাবি সিউল ও টোকিওকে চাপের মধ্যে ফেলেছিল। ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরে এলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির স্থায়িত্বের বিষয়ে (বিশেষ করে উত্তর কোরিয়াকে প্রতিরোধ ও বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার্থে) নতুন উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। এ জন্য সিউল ও টোকিও ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, যেন হঠাৎ করে নীতি পরিবর্তন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি কমানো যায়।
এই প্রেক্ষাপটে সচিবালয় কেবল এক ধরনের কূটনৈতিক অঙ্গীকার নয়; বরং এটি একটি নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী।
এসব ঘটনার মধ্যেই, অভ্যন্তরীণভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছে। ইউন-এর অভিশংসন বাড়তি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে হান খুব দ্রুততার সাথে মিত্রদের কাছে আশ্বাস দিয়েছেন যে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতি অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ত্রিদেশীয় কাঠামোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া তার প্রতিশ্রুতিকে যে অটুট রেখেছে, তা এই অস্থির সময়েও তাদের সামর্থ্য প্রদর্শন করে।
উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন এই ত্রিদেশীয় উদ্যোগের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া ত্রিদেশীয় সহযোগিতা সচিবালয়ও রয়েছে, যা ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সিউলে সদর দপ্তর অবস্থান করছে। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই ত্রিপাক্ষিক মেকানিজম মূলত প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় জোর দেয়। ২০২৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সম্মেলনে বাণিজ্য, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং সরবরাহ-শৃঙ্খল স্থিতিশীলতা নিয়ে যৌথ উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করা হয়। এটি স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র–জাপান–দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক অংশীদারত্বের তুলনায় এক ভিন্নধর্মী কাঠামো।
সিউল ও টোকিওর কাছে এই দ্বৈত ত্রিদেশীয় কাঠামো — একদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক নিরাপত্তা, অন্যদিকে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা — কোনো বিরোধ নয়, বরং একটি সচেতন কৌশল।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র–দক্ষিণ কোরিয়া–জাপান অংশীদারত্ব প্রত্যক্ষ নিরাপত্তা শক্তিশালী করে, যা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি। অন্যদিকে চীন–জাপান–দক্ষিণ কোরিয়া সহযোগিতার মাধ্যমে বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বজায় রেখে বাণিজ্যিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় এবং আলোচনার মাধ্যমে আঞ্চলিক উত্তেজনা নিরসনের পথ খোলা থাকে। এই দুই ত্রিদেশীয় কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রেখে সিউল ও টোকিও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার যুগে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইউন-এর অভিশংসন আর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সংখ্যালঘু সরকার পরিস্থিতি এই দ্বৈত কাঠামোর গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
দেশীয় রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়লেও, সিউল ও টোকিও তাদের বৈদেশিক কৌশলকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করেই এগিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা একদিকে নিরাপত্তা সুরক্ষা পাচ্ছে এবং অন্যদিকে দরকষাকষিতে একটি অবস্থান তৈরি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং চীনের সঙ্গে বাস্তবমুখী সম্পর্কও বজায় রাখবে।
তবে এ ভারসাম্যের কৌশলে ঝুঁকিও আছে। দ্বৈত ত্রিদেশীয় কাঠামো দ্বিধাগ্রস্ত বার্তা দিতে পারে, যা উভয় কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতা দুর্বল করার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা ত্রিদেশীয় নিরাপত্তার অঙ্গীকারকে দুর্বল করতে পারে বলে মনে হতে পারে, যার ফলে ট্রাম্প প্রতিরক্ষা ও জোটের ব্যয় ভাগাভাগি নিয়ে আরও কঠোর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। আবার বেইজিং হয়তো এটিকে ঘিরাও-নীতি (containment) হিসেবে দেখবে, যার জেরে তারা আরও আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে পারে। সিউল ও টোকিওকে তাই কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সতর্কতা ও স্পষ্টতার সঙ্গে এই বার্তা দিতে হবে যে তাদের দ্বৈত কৌশল পরস্পর-বিরোধী নয়, বরং পরস্পর-পরিপূরক।
সব মিলিয়ে, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্র–দক্ষিণ কোরিয়া–জাপান ত্রিদেশীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা উত্তর-পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতার বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলছে। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক—উভয় ক্ষেত্রেই সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সিউল ও টোকিও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
ট্রাম্পের ফিরে আসার সম্ভাবনা এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন সত্ত্বেও এই দ্বৈত ত্রিদেশীয় ব্যবস্থা আঞ্চলিক অস্থিরতার মধ্যে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ও নমনীয় কাঠামো নিশ্চিত করে। বদলে যাওয়া মিত্রতা ও মহাশক্তির প্রতিযোগিতার সময়ে এই নমনীয়তা ও দূরদর্শিতাই উত্তর-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তনশীল আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
লেখকঃ হাও নান চারহার ইনস্টিটিউটের একজন গবেষণা ফেলো এবং আর্মস কন্ট্রোল নেগোশিয়েশন অ্যাকাডেমির (২০২৪-২০২৫) একজন ফেলো।
Leave a Reply