শ্রী নিখিলনাথ রায়
যে সময়ে লোকনাথকে প্রথমে ইজারা দেওয়া হয়, তৎকালে তিনি দশ বা একাদশ বৎসর-বয়স্ক -বালক মাত্র ছিলেন। স্ত্রীলোকের হস্ত হইতে জমিদারী কাড়িয়া লইয়া বালকের হস্তে প্রদান করা হইল। এরূপ ন্যায়-বিচার কেহ দেখিয়া- ছেন কি? যদিও কান্তবাবুর বেনামীতে লোকনাথকে জমিদারী দেওয়া হয়, তথাপি প্রকাশ্যভাবে একটি বালকের হস্তে জমিদারী প্রদান করিতে তিনি কিছুমাত্র লজ্জা বোধ করেন নাই। ইহা লইয়া পীড়াপীড়ি করিলে, তিনি বলিয়াছিলেন যে, কান্তবাবুর বেনামীতে লোকনাথকে দেওয়া হইয়াছে এবং বেনামীতে জমিদারী দেওয়া এ দেশে প্রচলিত আছে। •
হেষ্টিংস এইরূপে আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে ত্রুটি করেন নাই। ইহা অপেক্ষা অধিকতর নির্লজ্জতার বিষয় আর আছে কি না, জানি না। স্ত্রীলোক বলিয়া রাণী ভবানীর হস্ত হইতে বাহারবন্দ বিচ্যুত হইল। স্ত্রীলোক হইলে যদি দোষ হয়, তাহা হইলে, বোধ হয়, মহারাণী স্বর্ণময়ীর নাম আজ কেহ শুনিতে পাইতেন না। হেষ্টিংস বাহারবন্দ কান্তবাবুকে প্রদান করিলেন বটে, কিন্তু প্রজারা প্রথমতঃ তাঁহাকে কর প্রদান করিতে স্বীকৃত হইল না। যাহারা রাণী ভবানীর অধিকারে বাস করিত, তাহারা সহজে অন্য লোকের নিগ্রহ ভোগ করিতে যাইবে কেন? দয়া যাঁহার নিত্যসহচরী, পরোপকার যাঁহার জীবনের মুখ্যব্রত, যাঁহার নামে দারিদ্র্য দরিদ্রের কুটীর ছাড়িয়া দূর-দূরান্তরে পলায়ন করে, তাঁহার প্রজাবর্গ যে, তাঁহার নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে হৃদয়ে যথার্থ বেদনা পাইবে, ইহা বিচিত্র নহে।
যাহারা তাঁহাকে প্রকৃত মাতা বলিয়া জানিত, যাঁহার অজস্র করুণাধারা স্তন্য- দুগ্ধের ন্যায় ক্ষরিত হইয়া এতদিন তাহাদিগকে স্নিগ্ধ করিয়াছে, আজ ‘কোন্ প্রাণে তাহারা তাঁহা হইতে বিচ্যুত হইতে ইচ্ছা করিবে? কিন্তু দুঃখের বিষয় এবং তাহাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, দেশের শাসন- ‘কর্তাই বলপূর্ব্বক তাহাদিগকে সে সুখভোগ হইতে বঞ্চিত করিতেছেন। সমস্ত প্রজাবৰ্গ যখন জানিতে পারিল যে, বাস্তবিকই তাহারা রাণী ভবানীর হস্ত হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে, তখন তাহারা দলবদ্ধ হইয়া, কর- প্রদানে অসম্মতি জানাইতে লাগিল। কান্তবাবু অত্যন্ত বিপদে পতিত হইলেন। তাঁহার পক্ষে সরকারের রাজস্ব দেওয়া ভার হইয়া উঠিল। যদিও অন্যান্য লোকের সহিত তুলনায় তাঁহার রাজস্ব অতি সামান্যমাত্র ছিল, তথাপি কর আদায় না হওয়ায়, তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। প্রজারা মধ্যে মধ্যে যাহা কিছু প্রদান করিত, তাহাতে কোন প্রকারে রাজস্বের সংকুলান হইত।
কিন্তু ইহাতে বিশেষ কোন লাভ হইত না। তাঁহাকে অনেক দিন পর্যন্ত এই কষ্ট ভোগ করিতে হয়। অবশেষে তিনি হেষ্টিংস সাহেবকে সমস্ত জানাইলে, হেষ্টিংস তাঁহার সুবিধা করিয়া দেন। ১৭৮৩ খৃঃ অব্দে যখন কান্তবাবু বাহারবন্দ পরিদর্শনে নিজে গমন করেন, সেই সময়ে (১৭৮৩ খৃঃ অব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি) হেষ্টিংস রঙ্গপুরের কালেক্টর গুডল্যাড সাহেবকে এই মর্ম্মে লিখিয়া পাঠান,-“আমার দেওয়ান কান্তবাবু আমার অনুমতিক্রমে তাঁহার জমিদারী বাহারবন্দ দেখিতে যাইতেছেন। সেখানকার বিদ্রোহী প্রজাদিগকে দমন করিবার জন্য কান্ত বাবুকে সাহায্য করিবে এবং এখন, যখন খাজানা আদায়ের সময়, তখন লাগাদ বৈশাখ প্রজাদিগের কোন অভিযোগ আপত্তি শুনিবে না। তাহাতে কান্তের ক্ষতি হইতে পারে, বৈশাখ মাসে শুনিলে তাহার বিশেষ ক্ষতি হইবে না।”
Leave a Reply