মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
চায়নার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা-র প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা জীবন শুরু করেছিলেন শূন্য থেকে। তিনি বিভিন্ন সময় নানা ধরনের কাজ করতে চেয়েছেন কিন্তু প্রায় সবগুলোতেই ব্যর্থ হয়েছেন। ‘ব্যর্থতা’ ও ‘জ্যাক মা’ শব্দ দুটো এক সময় পরিপূরক মনে হলেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং লেগে থেকে সক্রিয় চেষ্টার মাধ্যমে তিনি সারা পৃথিবীতেই একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেছেন। বিশাল কর্মকাণ্ড এবং অর্থের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকলেও জ্যাক মা ভুলে যান নি তার অতীতের কথা। নিঃসংকোচে তিনি সবখানে তার ব্যর্থতা এবং জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন।
জ্যাক মার প্রকৃত নাম মা ইউন। তিনি জন্মেছেন ১৫ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে চায়নার দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চল হোয়াং ঝুতে। বড় ভাই ও ছোট এক বোনসহ তিনি বেড়ে ওঠেন চায়নার কমিউনিস্ট শাসনের সূচনা সময়ে। তার বাবা মা মিউজিশিয়ান ও গল্পকথক ছিলেন কিন্তু আর্থিক অনটন এতো বেশি ছিল যে তাদের অবস্থান মধ্যবিত্তের পর্যায়েও ছিল না। চায়নার সাংস্কৃতিক বিপ্লব তাদের পরিবারের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জ্যাক মার দাদা ছিলেন জাতীয়তাবাদী দলের অনুসারী। যারা চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কমিউনিস্টরা এক সময় জ্যাক মার দাদাকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে ফাঁসি দেয়। তার বাবা মা যে ধরনের গান গাইতেন ১৯৬৬ থেকে দশ বছর ১৯৭৬ পর্যন্ত তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে তখন চায়নার সম্পর্ক ভালো না থাকায় দেশটি সারা পৃথিবী থেকে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। জ্যাক মার পুরো পরিবারই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মাত্র সাত ডলারের সমপরিমাণ অর্থে তাদের ছয় সদস্যের পরিবারের মাস কাটাতে হতো। বছরে একবার মাত্র মুরগি খাওয়ার সুযোগ হতো তাদের।
বিদেশিদের প্রতি এক সময় চায়নার নীতি বদলে যেতে থাকে। ১৯৭২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চায়নায় এলে হোয়াং ঝু এলাকায় আসেন। এতে করে এই এলাকায় পর্যটক বেড়ে যায়। প্রচুর বিদেশি অতিথি সেখানে ঘুরতে আসতেন। কিশোর মা এই সময়টি কাজে লাগাতে চান। তিনি ইংরেজি শিখতে চাইতেন। তিনি তার সাইকেল নিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়তেন। পার্কে গিয়ে দেখতেন কোনো বিদেশি আছেন কি না। তিনি বিনা পয়সায় তাদের গাইড হিসাবে কাজ করতেন। তিনি হোটেলগুলোতে যেতেন। বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাতেন এলাকা ঘুরিয়ে দেখার জন্য। তার লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলে তার ইংরেজি বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তার এই আগ্রহ দেখে অনেকেই তাকে পছন্দ করতেন। তার ইউন নামটি উচ্চারণ করতে কঠিন মনে হয় বলে এক বিদেশি মেয়ে তাকে ‘জ্যাক’ নামে ডাকা শুরু করে। তিনি তখন থেকে নিজেকে জ্যাক হিসাবে পরিচয় দিতে থাকেন। এই কাজে তার তেমন অর্থ উপার্জন না হলেও তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে কাজটি করতেন।
পাতলা লিকলিকে আকারের জ্যাক মা তার ক্লাসমেটদের সঙ্গে নিয়মিত মারামারি করতেন। তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই আমার চেয়ে আকারে বড় কারো সঙ্গে লড়াই করতে ভয় পাই নি।’
অন্য শিশুদের মতো জ্যাক মাও ঝি ঝি পোকা সংগ্রহ করতেন এবং তাদের নিয়ে খেলা করতেন। তাদের দিয়ে মারামারি করিয়ে আনন্দ পেতেন। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনে তিনি বলে দিয়ে পারতেন এটির ধরন সম্পর্কে। চায়নায় ঝি ঝিঁ পোকা সংগ্রহ করা ঐতিহ্য হলেও কমিউনিস্ট শাসনের সময় এটি সংগ্রহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
ছেলেবেলায় প্রাইমারি স্কুল পরীক্ষায় জ্যাক মা ফেল করেন। একবার নয়,দুইবার! উচ্চ মাধ্যমিকে এসে তিনি ব্যর্থতায় আরো ‘সাফল্য’ দেখালেন। এবার ফেল করলেন তিনবার। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায়ও একই রকম ফল। তিনবার ব্যর্থ হয়ে তিনি সুযোগ পেলেন চতুর্থ মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত হোয়াং ঝু নরমাল ইউনিভার্সিটিতে। উচ্চ শিক্ষার আশায় তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেন মোট দশবার। কিন্তু দশবারই তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।
ইংরেজিতে বিএ ডিগ্রি গ্রহণ করে তিনি হোয়াং ঝু ডিয়ানজি ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এখানে তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র দশ ডলার। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার আগের তিন বছরে তিনি কমপক্ষে ত্রিশ বার চাকরির আবেদন করে ব্যর্থ হন। তার ব্যর্থতার ধরনও ছিল অভিনব। চায়নায় যখন প্রথম কেএফসি এলো তখন ২৪ জন তাতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ২৩ জনের চাকরি হয়। একজন ব্যর্থ হন। তিনি জ্যাক মা। এরপর পুলিশে চাকরির জন্য আবেদন করেন। পাঁচজন আবেদনকারীর মধ্যে একজন বাদ পড়েন। বলাবাহুল্য নামটি জ্যাক মা। তাকে বলা হয়, ‘তুমি ঠিক যোগ্য নও।’
উদ্যোক্তা হিসাবে জীবন শুরু করার পরও ব্যর্থতা তার পেছন ছাড়ে নি। তবে কোনো অবস্থাতেই জ্যাক মা হাল ছেড়ে দেন নি। তিনি যা করে গিয়েছেন তা হলো চেষ্টা।
তবে এই ব্যর্থতার মাঝেও তার সাফল্য এসে ধরা দেয়। তিনি এমন সাফল্য পান কলেজ জীবনে প্রেম করে। তার প্রেমিকা ঝাং ইং পরে তার জীবনসঙ্গী হন। জ্যাক মাকে কেন পছন্দ করলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ঝাং ইং বলেন, ‘ও খুব হ্যান্ডসাম নয় কিন্তু ও এমন সব কাজ করতে পারে যা হ্যান্ডসাম মানুষরাও করতে পারে না। আর এ জন্যেই আমি ওকে পছন্দ করি।’
চাকরি করতে করতে এক সময় জ্যাক মার মনে হলো এই কাজ আসলে তার জন্য নয়। তিনি ব্যবসা করতে চান। ছাত্রজীবনে তিনি একবার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ পান। বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করার প্রবল বাসনা তার সব সময় ছিল। তিনি প্রথমে একটি অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু সেখানে তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। রাস্তায় মাল বহন করে অর্থ আয় করতেন তিনি। তবে তার অনুবাদ অগ্রহের কারণে একজন অনুবাদক হিসাবে চায়নিক কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে এক বন্ধুর মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হন জ্যাক মা। প্রবল আগ্রহ তিনি ইন্টারনেটে চায়না সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে কিছুই পেলেন না। কারণ চায়না তখন জগত থেকে আলাদা। এই ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
তিনি চায়নায় এসে ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা শুরু করতে চাইলেন। দেশে এসে ইয়োলো পেজ জাতীয় একটি ওয়েবসাইট শুরু করেন। পরে তিনি এটি সরকারের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর তিনি চায়নিজ সরকারের একটি ইন্টরনেট প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। কিছুদিন কাজ করে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন এবং ইন্টরনেটের মাধ্যমে দ্রব্য কেনাবেচার চিন্তা করেন। তার কথা শুনে অধিকাংশ ব্যক্তিই বিস্মিয় প্রকাশ করেন। তারা বলেন চায়নায় এখনো সে ধরনের অবকাঠামো তৈরি হয় নি।
জ্যাক মা বলেন, ‘আমার বাবা ধনী ছিলেন না। আমার কোনো ক্ষমতাধর চাচা- মামা ছিলেন না। এমনকি ব্যাংকে কোনো জমানো অর্থ ছিল না। আমরা শুধু কাজ করে গিয়েছি একটি টিম হিসাবে। ১৯৯৯ সালে বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে দুই হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে আমার বাসায় শুরু করি আলিবাবা ডট কম। শুরুতে প্রায় সবাই এই কোম্পানি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। আমরা যখন আলি পে শুধু করি তখনও অনেকেই বলেছিল এটা হচ্ছে এ যাবৎকালের সবচেয়ে স্টুপিড আইডিয়া। কিন্তু আমরা পথ ছেড়ে যাই নি।’
নতুন উদ্যাক্তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেকেই উদ্যোক্তা হতে চান। কিন্তু উদ্যোক্তা হতে যে চেষ্টা সেটা তারা করেন না। তারা চমৎকার একটি আইডিয়া নিয়ে রাতে ঘুমাতে যান কিন্তু পরদিন সকাল বেলা আবার পুরানো কাজে অফিসে রওনা হন।’
তরুণদের প্রতি জ্যাক মার পরামর্শ, ‘আমি তরুণদের বলবো, বিশ বছরের আগে একজন ভালো ছাত্র হও। যদি উদ্যোক্তা হতে চাও তাহলে এই সময় কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করো। ত্রিশ বছরের আগে কাউকে অনুসরণ করো। কোনো একটি কোম্পানিতে কাজ করো। ভালো হয় ছোট কোম্পানিতে কাজ করলে কারণ বড় কোম্পানিতে কাজ করলে তুমি হবে একটি বড় মেশিনের অংশ সেখান থেকে শেখার সুযোগ কম থাকবে। বরং ছোট কোম্পানিতে কাজ করলে তার খুঁটিনাটি যেমন জানতে পারবে তেমনি তুমি পারবে একটি স্বপ্ন কীভাবে বেড়ে ওঠে সেটা জানতে। কীভাবে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় সেটা দেখতে পাবে। এই সময় কোন কোম্পানিতে তুমি কাজ করলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কোন বসকে তুমি অনুসরণ করছো সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভালো বস তোমাকে সবকিছুই হাতে কলমে শেখাবেন। ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে তোমাকে পরিষ্কার ভাবে জানতে হবে তুমি কোন ক্ষেত্রে কাজ করতে চাও। সে ক্ষেত্রে নিজেকে তৈরি করতে হবে। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে তোমাকে এমন সব কাজ করতে হবে যেটাতে তুমি ভালো। এই সময় নতুন কিছুতে না যাওয়াই ভালো। সেখানে ব্যর্থও হতে পারো। তাই এই সময় দেখতে হবে যে জিনিসটি তুমি পারো সেটাকে কীভাবে আরো বড় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে তরুণদের জন্য কাজ করো। কারণ তারা তখন তোমার চেয়ে ভালো করবে। তাদের পেছনে বিনিয়োগ করো। তাদেরকে কাজে লাগাও।’
জীবনে অনেক ব্যর্থতার মুখে পড়লেও জ্যাক মা বিশ্বাস করেন, ‘কখনো হাল ছেড়ো না, আজকের দিনটি কঠিন হতে পারে, কাল হয়তো আরো খারাপ কিছু ঘটতে পারে কিন্তু পরশু ঠিক মেঘলা আকাশে সূর্য উঠবে।’
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply