সন্ন্যাসী ঠাকুর
আম পাড়িয়া আনিলাম। লোহার বল্টুর সেই শিবের সামনে আমার চৌর্যবৃত্তি-আহরিত আমগুলি টানাইয়া ভোগ দিলাম। লোহার ঠাকুর এজন্য কোনোই উচ্চবাচ্য করিল না। সন্ধ্যা হইলে আগের মতোই ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া সেই ঠাকুরকে পূজা করিতে বসিলাম। কলেরার দিন বলিয়া পথে-ঘাটে লোকের আনাগোনা নাই। চারিদিক নীরব থমথম।
আগেই বলিয়াছি, সন্ন্যাসী ঠাকুরের ছোট ঘরখানার সামনে একটি উঠান ছিল। সেই উঠানের পাশে একটি দরজা। দরজার পাশে একটি দীর্ঘ বাঁশ পোঁতা। সেই বাঁশের আগায় একটি গেরুয়া রঙের পতাকা উড়িত। এই ঘর হইতে প্রায় দুইশত গজ দূরে শ্মশানের জল্লাদের বাড়ি। তার নাম ছিল ঝপু। সেখানে সে তাহার স্ত্রী জানকী আর ছেলে হাজারীকে লইয়া থাকিত। সন্ন্যাসী ঠাকুর বিপদে-আপদে তাহাদের ডাকিলে তাহারা আসিয়া সাড়া দিত।
রাত তখন আটটা কি নয়টা হইবে। আমি মাটিতে উবু হইয়া চৌকির উপরের লোহার বল্টুর শিবকে ধূপ-ধুনা দিতেছি, এমন সময় উঠানের দরজায় বাঁশটি ধরিয়া কে যেন বহুক্ষণ ঝাঁকানি দিল। আমার হাত হইতে ধূপের পাত্রটি পড়িয়া গেল। ভয়ে আমার বুক ঘনঘন কাঁপিতে লাগিল। সামনের চৌকির সঙ্গে বুক লাগাইয়া আমি সেই কাঁপুনি থামাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এমন সময় ঘরের বেড়ায় কে যেন দুই-তিনটি থাপড় মারিল। আমি জানিতাম ভয় পাইয়া চিৎকার করিলে আর রক্ষা নাই। তখনই অজ্ঞান হইয়া মরিতে হইবে। তাই চিৎকার করিবার ইচ্ছা হইলেও আমি নিজেকে দমন করিলাম। ভাবিলাম, মা কালী পরীক্ষা করিবার জন্য আমাকে এরূপ ভয় দেখাইতেছেন। আমি নিশ্চয়ই ভয়কে জয় করিব।
কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মনে সাহস ফুরাইয়া যাইতেছে। বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম; একবার সন্ন্যাসী ঠাকুরের গায়ের উপর বসিয়া কে যেন আগুনের নিশ্বাস ছাড়িয়া গিয়াছিল। সেই অশরীরী লোকটি যদি আজ আসিয়া আমার বুকের উপর চড়িয়া বসে তখন তো আমি চিৎকার না দিয়া থাকিতে পারিব না। আর চিৎকার দিলেই তো আমার রক্ষা নাই।
এই ঘরের অদূরে ঝপু জল্লাদের বাড়ি। আমি প্রাণপণে ঝপু ঝপু করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। কিন্তু কার ডাক কে শোনে! আমারই কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হইয়া আমার চারিদিকে আরও ভয়ের ছায়া বিস্তার করিতে লাগিল।
চলবে…
Leave a Reply