সন্ন্যাসী ঠাকুর
মনে মনে ভাবিলাম, আমি যদি এই ঘরে আজ রাত্রযাপন করি তবে আমার মরণ নিশ্চিত। আর যদি এখান হইতে বাহির হইয়া বাড়ি যাইতে চেষ্টা করি তবে পথে মরিতেও পারি, বাঁচিতেও পারি। বাহিরের ভূতটা আমাকে আক্রমণ নাও করিতে পারে, আর যদি আক্রমণ করেও, তবে মা-মা বলিয়া ভূতটার সঙ্গে এক হাত লড়াই করিয়াই মরিব। আর এ যদি স্বয়ং মা কালীই আসিয়া থাকেন তবে তাঁহার চরণে লুটাইয়া যা কিছু বর চাহিয়া লইব।
মালকোঁছা দিয়া শক্ত করিয়া কাপড় পরিলাম। হাতে একটা লাঠি লইলাম। হারিকেনের বাতিটি আরও একটু উস্কাইয়া দিয়া দরজার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া বুকে সাহস সঞ্চয় করিয়া কম্পিত হস্তে ঘরের দরজা খুলিলাম। তারপর এক হাতে লণ্ঠন অপর হাতে বাঁশের লাঠিটি লইয়া বাহিরে আসিলাম। চারিদিকে জোছনা ফুটফুট করিতেছে। সেই জোছনার আলোতে দেখিতে পাইলাম, হাজরা গাছটির সামনে সন্ন্যাসী ঠাকুর-কথিত সেই ব্রাহ্মণকন্যাটি নদীর দিকে মুখ করিয়া বসিয়া আছে। তখন আর আমার ভয় নাই। মনে মনে ভাবিলাম, মা মা বলিয়া এই মেয়েটির পায়ে লুটাইয়া পড়িব। সে হয়তো আমাকে কোনো বর দিয়া যাইবে।
আমি উঠানের দরজা পার হইয়া সেই শেওড়া গাছটির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
নিকটে আসিয়া দেখি, সেখানে একটি গাছ। ভয়ের চোটে গাছটিকে দূর হইতে সেই ব্রাহ্মণকন্যার মতো দেখিয়াছিলাম। কিন্তু গাছটির কাছে আসিয়া আমাকে নিদারুণ ভয়ে পাইল।
এটি গাছ না হইয়া যদি সেই ব্রাহ্মণকন্যাটি হইত তবে আমি এত ভয় পাইতাম না। মনের কল্পনার এই দ্রুত পরিবর্তন আমার দেহ ও মনে নিদারুণ ভয়ের সঞ্চার করিল। কিন্তু পূর্ব-বিশ্বাসমতো কিছুতেই আমি চিৎকার দিব না। কাঁপিতে কাঁপিতে বাড়ির দিকে পা বাড়াইলাম। খোদা বক্সের বাড়ির সামনে দিয়া হালট। তারপরে ফাঁকা কয়েকটা জায়গা পার হইলেই বচন মোল্লার বাড়ি। সেখান হইতে ঘন কলাগাছের মধ্য দিয়া সরু পথ। সেই পথ আমাদের বাড়ির উত্তর দিক দিয়া চলিয়া গিয়াছে। বাড়ি আসিলে আমাকে দেখিয়া মা কতই খুশি হইলেন।
সেদিন চিতই পিঠা আর গুড়ের হালুয়া তৈরি হইয়াছিল। তাহা আমাকে খাইতে দিয়া মা বলিলেন, “তুই কোথায় যাস, আর কোথায় থাকস? তোর চিন্তায় আমার ঘুম আসে না।” আমাকে নানারকম অত্যাচার ও পীড়ন করিয়া অভিভাবকেরা যখন দেখিলেন, কিছুতেই আমাকে শাসনে আনিতে পারিলেন না তখন তাহারা আমার ভবিষ্যৎ বিষয়ে এক রকম হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। আমি কখন কোথায় থাকি, কি করি, কেহ আর কোনো খোঁজ লইতেন না।
চলবে…
Leave a Reply