বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০৬)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১.০০ এএম

সন্ন্যাসী ঠাকুর

খুব ধরিয়া পড়িলে সন্ন্যাসী ঠাকুর অসুখে-বিসুখে রোগীদিগকে নানা গাছ-গাছড়ার ঔষধ বলিয়া দিতেন। তাঁহার নিকট হাতের লেখা একখানা খাতা ছিল। তাঁহার সুদীর্ঘ জীবনে নানা পথে নানা লোকের কাছে যেসব ঔষধের কথা শুনিয়াছেন, তাহার যেগুলি ফলপ্রদ হইত সেগুলি তিনি সেই খাতায় লিখিয়া রাখিতেন। এগুলি তাঁহার নিজেরও প্রয়োজনে লাগিত।

পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরিতে অসুখ হইলে ডাক্তার কবিরাজ পাওয়া যায় না। তখন নিজের চিকিৎসা নিজেকেই করিতে হয়। এইজন্য গুরু-পরম্পরায় সন্ন্যাসীরা বহু ঔষধের গাছ-গাছড়ার খবর জানেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁর খাতাখানা দেখিয়া মাঝে মাঝে সমবেত রোগীদের দু’একটি ঔষধ দিতেন। অম্লশূলের একটি ঔষধের কথা আমার মনে আছে। আবির, যোয়ানের গুঁড়ো, খাই-সোডা সমপরিমাণে লইয়া কলাগাছের খোলার রস তাহাতে মিশাইয়া রৌদ্রে দিতে হইবে।

শুকাইলে আবার কলার খোলার রস দিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া কড়ির চাইতে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করিতে হইবে। এই বড়ি আহারের পর ও শয়নের আগে নিয়মিত খাইলে অম্বলের ব্যথা সারে। হাঁপানি, আমাশয়, কাশি প্রভৃতি নানা রোগের আরও অনেক ঔষধ তিনি জানিতেন। তাঁহার মৃত্যুর পর সেই ঔষধের খাতাখানা কাহার হাতে পড়িয়াছে, জানি না।

সেই খাতাখানায় তাঁহার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা-ভরা ঔষধপত্র লেখা ছিল।

আমার ছোট ভাই নুরুদ্দীন যখন দুই-তিন মাসের, তখন তাহার খুব অসুখ হয়, পেট ফাঁপিয়া ঢোল হইয়া ওঠে। ডাক্তার বলিয়াছিলেন, তাহার আর বাঁচিবার আশা নাই। এই ভাইটিকে আমি বড়ই ভালোবাসিতাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরকে বলিলাম, “আপনি আসিয়া আমার ভাইটিকে দেখিয়া যান।” তিনি আসিয়া আমার ভাইটিকে দেখিয়া কিসব মন্ত্র পড়িয়া ফুঁ দিলেন। আমার পিতাকে বলিলেন, “এ ছেলে মরিবে না, বাঁচিবে।” সত্যসত্যই আমার ভাই সারিয়া উঠিল।

তিনি ভালো হস্ত-রেখা পড়িতে পারিতেন। আমার হাত দেখিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, বয়সকালে আমি খুব বড় একটা কিছু হইব। তাঁহার মতো সাধু হইব, ইহাই হয়তো তাঁহার আশা ছিল। সাধু হইবার জন্য কতই না তপস্যা ও কৃষ্ণসাধনা করিয়াছি। কিন্তু ভবিতব্যকে কে খণ্ডাইতে পারে? সাধু না হইয়া আমি হইলাম কবি। তাঁহার উপদেশ ছিল কোনো স্ত্রীলোকের মুখের দিকে চাহিবে না। কোনো সুন্দরী মেয়ের কথা ভাবিবে না। কোনো মেয়েকে দেখিলে আমি তার মুখের দিকে চাহিতাম না। কিন্তু এক নজর দেখিয়াই তাহার চেহারা আমার মনে অঙ্কিত হইয়া যাইত। আমি যখন ধ্যানে বসিতাম এই চেহারাগুলি যতই না-ভাবিতে চেষ্টা করিতাম ততই তাহারা আমার ধ্যানের কালো পর্দায় আসা-যাওয়া করিত।

আমাদের শ্মশানঘাট ছাড়িয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর ফরিদপুর শহরে চৌধুরীবাড়ির কালীতলার কাছে একটি পুরাতন বাসায় আসিয়া আশ্রয় লইলেন।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024