বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:১২ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০৭)

  • Update Time : শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১.০০ এএম

সন্ন্যাসী ঠাকুর

এতদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাদের গ্রামে ছিলেন বলিয়া যখন-তখন তাঁহার সঙ্গে আসিয়া দেখা করিতাম। স্কুলের পড়া নিয়মিত না করিলেও প্রতিদিন স্কুলে যাইতাম এবং পরীক্ষায় পাশও করিতাম। ছুটির সময় মাত্র তাঁহার ওখানে যাইয়া সারাদিন কাটাইতাম।

নতুন আশ্রমে আসার পর আমি সব সময় সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিতে পারিতাম না। একবার শ্রীষ্মের ছুটিতে আমি তিন-চার দিন আশ্রমে কাটাইলাম। আমার পিতা এখানে আসিয়া আমাকে খুঁজিয়া পাইলেন। এখান হইতে আমাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার সময় সন্ন্যাসী ঠাকুরকে বহু অনুযোগ দিলেন। ঠাকুর বলিলেন, “আপনার ছেলে আমার এখানে আসিয়া কোনো খারাপ শিক্ষা পাইতেছে না। স্কুলেও সে রীতিমতো যায়। আমার এখানে আসা যদি আপনি পছন্দ না করেন, তবে আপনার ছেলেকে ঘরে ধরিয়া রাখিবেন। আমাকে বকিতেছেন কেন?”

ইহার কয়েকদিন পরেই আবার আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে রীতিমতো যাওয়া-আসা করিতে লাগিলাম। যোগেশ নাম করিয়া একটি যুবক, সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্ত হইয়াছিল। সে সেটেলমেন্ট আফিসে চাকুরি করিত। একদিন সে আর আমি সন্ন্যাসীর আশ্রম হইতে দূরে একটি বটগাছতলায় ধ্যান করিতে গেলাম। কিছুক্ষণ ধ্যান করিয়া আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।

সকালে উঠিয়া দেখি যোগেশ নদীর ধারে যাইয়া লাফ পাড়িতেছে। সেইদিন হইতে যোগেশ পাগল হইল। সকলেরই ধারণা হইল, সেই বটগাছের তলায় বসিয়া ধ্যান করার জন্যই যোগেশ পাগল হইয়াছিল। আমি যদি ঘুমাইয়া না পড়িয়া তাহার মতোই ধ্যান করিতাম তবে আমিও পাগল হইতাম। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম উজ্জ্বলা নামে একটি মেয়েকে যোগেশ ভালোবাসিত। পাগলামির ঘোরে সে মাঝে মাঝে উজ্জ্বলা, উজ্জ্বলা বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিত।

একবার রানীদিদি সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য নিজের হাতে তৈরি করিয়া ভালো ভালো কিছু খাবার করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। যে-ঘরে মিষ্টির থালা ছিল, আমি সেই ঘরে ঝাঁট দিতেছিলাম। হঠাৎ সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, “তোমার ঝাঁটার ছোঁয়া ওই মিষ্টির থালায় লাগিয়াছে।” আমি যত বলি, না লাগে নাই, তিনি তত বলেন, “লাগিয়াছে, আমি নিজের চক্ষে দেখিয়াছি। এই মিষ্টি তোমাকেই খাইতে হইবে।”

দুঃখে অনুশোচনায় আমার অন্তর ভরিয়া উঠিল। কত আগ্রহ করিয়া রানীদিদি সন্ন্যাসী ঠাকুরে জন্য এইসব খাবার পাঠাইয়াছেন। আমি ছুঁইয়া দিয়া কত বড় অপরাধ করিয়াছি। আবার সেইগুলি যদি আমি খাই তবে রানীদিদি কি মনে করিবেন? সন্ধ্যাবেলায় জলধর-দাদা সমস্ত শুনিয়া আমাকে সেই মিষ্টি খাইতে বারবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুরের তেমন ছোঁয়া-ছুঁয়ির বাছবিচার ছিল না।

কতবার তিনি আমার ছোঁয়া খাবার খাইয়াছেন। বিহারীদার বাসা হইতে মুসলমান পিয়ন যখন খাবার আনিয়া দিত তাহাও তিনি খাইয়াছেন। আমার তো মনে হয় না আমি এই মিষ্টির থালায় ঝাঁটার আঘাত করিয়াছি। এসব কথা সন্ন্যাসী ঠাকুরকে বলিলাম। তিনি উত্তর করিলেন, “আমি তোমার গুরু। আমার আদেশ তোমাকে পালন করা উচিত। তুমি এই মিষ্টি খাও। তোমার কল্যাণ হইবে। আর যদি আমার আদেশ পালন না কর তোমার ক্ষতি হইবে।”

চলবে…

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024