সন্ন্যাসী ঠাকুর
কথা বলিতে বলিতে জলধর-দাদা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সম্প্রতি দাদার জামিন দেওয়া একটি আসামি কোর্টে হাজির হয় নাই। কোর্ট দাদার কাছে জামিনের টাকা তলব করিয়াছেন।
দাদা বলিলেন, ভাইটি। রাগ করিও না। তোমাদের মুসলমান জাতিটিই খারাপ। এই কোর্টের হাকিম মুসলমান। আরও তিনবার এইরূপ তিনজন আসামি কোর্টে হাজির হয় নাই। সেই তিনবার সে আমাকে মাফ করিয়াছে। কিন্তু এবার এত অনুনয়-বিনয় করিলাম, বেটা কিছুতেই আমাকে জামিনের টাকা হইতে মুক্তি দিল না। দেখ তো। তুমি নি তোমার জাত-ভাইকে বলিয়া-কহিয়া এবারের মতো আমাকে মাফ দেওয়াইতে পার? নহিলে আমাকে জেলে যাইতে হইবে।”
মনে মনে ভাবিলাম, তিনবার যে-মুসলমান হাকিমটি দাদাকে এইভাবে মাফ করিয়াছেন, এবার মাপ না করায় তিনি তো খারাপই, সেইসঙ্গে তাঁহার মুসলমান জাতও দাদার কাছে খারাপ বলিয়া মনে হইতেছে। অত্যধিক দারিদ্র্য মানুষের মনকে যে কত সংকীর্ণ করিয়া দেয় দাদার এই উক্তিটি তাহার প্রমাণ। তখন আমার মন কিছুটা মুসলিম লীগ ভাবাপন্ন। তবু দাদার এই কথার কোনোই প্রতিবাদ করিলাম না। প্রতিবাদ করিলেই বা কি হইবে? এত বয়সে দাদার মতের কি পরিবর্তন করাইতে পারিব? দাদার কাছে এক সময়ে যে স্নেহ-মমতা পাইয়াছি তাহার বিনিময়ে দাদার এই সমালোচনাটুকুও হজম করিলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, সেই মুসলমান হাকিমকে বলিয়া-কহিয়া সেবারের মতোও দাদাকে জামিনের টাকা হইতে রেহাই দেওয়াইয়াছিলাম। তখন দাদা সেই হাকিমের প্রতি এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁহার মত পরিবর্তন করিয়াছিলেন।
কলিকাতা আসিয়া রানীদিদির একটি ছেলে হইয়াছে। বারো-তেরো বৎসর বয়স। ছেলেটি স্কুলে যায়। কিছু কিছু কবিতাও লেখে। আমি তাহাকে খুব উৎসাহ দিলাম।
ইহার পরে কোনো কোনো রবিবারে আমি নিকটস্থ রাজার হইতে ভালোমতো মাছ-তরকারি কিনিয়া রানীদিদির অতিথি হইতাম। হাতে করিয়া কিছু দিতে গেলে হয়তো লইবেন না। তাই বাজার করিবার এই কৌশল। আমার আনা মাছ-তরকারি পরিপাটি করিয়া রাঁধিয়া রানীদিদি আমাকে খাওয়াইতেন। হোস্টেলের একঘেয়ে খাবার হইতে মাঝে মাঝে রানীদিদির বাসায় যাইয়া গৃহ-সুখের আস্বাদ পাইতাম।
ইহার কিছুদিন পরে দাদা মারা গেলে রানীদিদিরা এই বাসা ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া যান। অনেক চেষ্টা করিয়াও আর রানীদিদিদের ঠিকানা পাই নাই। শুনিয়াছি পিতার মৃত্যুর পর রানীদিদির ছেলে অল্প বয়সে পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া কোনো ইলেকট্রিক অফিসে সামান্য বেতনে চাকরি লয়।
সন্ন্যাসী ঠাকুর ও তাঁর ভক্তমণ্ডলীর কাহিনী এখানেই শেষ করিলাম। কিন্তু যে-চরিত্রগুলি আমার জীবনের রঙ্গমঞ্চে নিয়ত যাওয়া-আসা করিতেছে তাহাদের কাহিনী কি শেষ হইতে পারে? আজও আপদে-বিপদে সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের সৌম্য মূর্তিখানি ভাবিতে আমার বেশ ভালো লাগে। অনেক সময় ধ্যান-নয়নে দেখিতে পাই, সুদূর বন্ধুর হিমালয়ের পথ-সেই বদরিনারায়ণ-লছমনঝোলা পার হইয়া আজানুলম্বিত-বাহু গৌরমূর্তি এক সন্ন্যাসী ঠাকুর হাঁটিয়া চলিয়াছেন মানস-সরোবরের পথে। সেই রানীদিদি, তার দুইজন অল্পবয়সী জা আর আমার বৌদিদি সুহৃদদার স্ত্রী এঁরাও যেন সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছেন।
চলবে…
Leave a Reply