আর্কাদি গাইদার
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
‘হ্যাঁ, সত্যি কথা,’ কথাটা স্বীকার করতে গিয়ে তিষ্কার গলা ধরে গেল। ‘এই সবকিছুতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলুম, বরিস। এখানে আমাদের জায়গা হল না বলে মনটা এত খারাপ হয়ে গিয়েছে, কী বলি। জানিস, আমি-না বাবাকে লুকিয়ে গির্জের তত্ত্বাবধায়ক সিনিউগিনের কাছে পর্যন্ত গিয়েছিলুম, যদি তিনি আমাদের থাকতে দেন। কিন্তু তিনি দিলেন না।’ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে তিকা ফের বললে, ‘ওঁর কী আসে যায়? দিব্যি চমৎকার নিজের বাড়ি আছে ওঁর…’
গলা নামিয়ে একেবারে ফিসফিস করে শেষের কথাগুলো বলল তিষ্কা। তারপর চট করে চলে গেল পাশের ঘরে। মিনিটখানেক পরে আমি যখন সে ঘরে গেলুম, দেখলুম তিকা ওদের বিছানার সঙ্গে বাঁধা একটা বড় পোঁটলায় মুখ গুজে কাঁদছে।
রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে কামরায় ওঠার জন্যে এক বিশাল জনসমুদ্রের প্রচণ্ড ঠেলাঠেলির মধ্যে পড়ে তিঙ্কা আর ওর বাবা কোথায় হারিয়ে গেলেন।
চিন্তিত হয়ে পড়লুম আমি, ‘ইস্, ও তো পিষে যাবে এই ভিড়ে। এত লোক যাচ্ছেই বা কোথায়?’
প্ল্যাটফর্মে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সৈনিক, সামরিক অফিসার আর নাবিকের ভিড়। অবাক হয়ে ভাবলুম, ‘আচ্ছা, এরা না হয় এতে অভ্যন্ত, মিলিটারির লোক। কিন্তু ওরা সব যাচ্ছে কোথায়?’ স্তূপাকার বাক্স, টুকরি আর স্যুটকেসের চারপাশে ভিড় করে ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ওরা’, অর্থাৎ বেসামরিক সাধারণ নাগরিকরা। গোটা পরিবার নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল ওরা।
অনবরত ছোটাছুটি আর উত্তেজনার ফলে কপালে ঘাম জমে উঠেছিল, পরিষ্কার কামানো- মুখ, ক্রুদ্ধ, উত্যক্ত সব পুরুষ মানুষ। ক্লান্ত, উদ্ভ্রান্ত চোখ, সুন্দর কাটা-কাটা মুখচোখওয়ালা মেয়েরা। এত হট্টগোল দেখে ঘাবড়ে-যাওয়া, একগুঁয়ে, রগচটা, আজগবি-ধরনের-টুপি-মাথায় সেকেলে সব মা-মাসিরা।
আমার বাঁ-দিকে মস্ত একটা স্যুটকেসের ওপর চেপে বসেছিলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। সিনেমায় যেমন অভিজাত-বংশীয়া বৃদ্ধা কাউন্টেসদের ছবি দেখা যায় তেমনই দেখতে। তাঁর এক হাতে ছিল একগাদা বিছানার চাদর বান্ডিল-বাঁধা, অন্য হাতে তোতাপাখির খাঁচা একটা।
Leave a Reply