বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:১৫ পূর্বাহ্ন

কেন কিছু মানুষ ভূমিকম্প টের পান না?

  • Update Time : বুধবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ২.২৩ পিএম
বড় ধরনের ভূমিকম্প না হলে অনেকেই টের পান না

মরিয়ম সুলতানা

“কখন ভূমিকম্প হইছে তার কিছুই জানি না আমি”, “ভূমিকম্পের দেড় ঘণ্টা আগে আমি ঘুম থেকে উঠে পড়েছি আজ, কিন্তু তারপরও কিছুই অনুভব করিনি”, “ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে এসে দেখছি দেশে ভূমিকম্প হয়ে গেছে”–– মঙ্গলবার সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এদিন সকাল সাতটা পাঁচ মিনিটে যখন ভূমিকম্প অনুভূত হয়, তখন অনেকেই ঘুমে ছিলেন।

উৎপত্তিস্থল তিব্বতে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে সাত দশমিক এক।

এবারের ভূমিকম্প বাংলাদেশে তেমন তীব্র ছিল না তবে আগেও বিভিন্ন সময় দেখা গেছে যে যখনই কোনো ভূমিকম্প হয়, তখনই কেউ না কেউ এই ধরনের কথাবার্তা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেন বা আলাপ-আলোচনা করেন।

একই সময়ে একই স্থানে থাকার পরও কেন সবাই ভূমিকম্প অনুভব করে না?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ সংবেদনশীলতা ও ব্যক্তির অবস্থান।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার সকালে ভূমিকম্পের সাথে সাথে গুগল অ্যালার্ট

যে কারণে অনুভূতির তারতম্য

“আপনি কত তলায় আছেন, তার ওপর এটি নির্ভর করছে। আপনি যত উপরের দিকে থাকবেন, আপনার ঝাঁকুনিটা অনুভব করার সম্ভাবনা তত বেশি। যত নিচে থাকবেন, এটি অনুভব করার সম্ভাবনা তত কম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন।

তবে এখানে আরেকটি বিষয় হলো–– “কিছু কিছু মানুষ গতি খুব ভালো অনুভব করতে পারে।”

তার মতে, যারা ভূমিকম্প টের পায় না তাদের সেনসিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা কম।

“অনেকে আছেন, যারা উচ্চতা নিতে পারেন না। ছাদ থেকে নিচে তাকাতে পারেন না। কারণ তারা উচ্চতার বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। মোশন বা গতির ক্ষেত্রেও তাই,” বলছিলেন তিনি।

এক্ষেত্রে কেউ কেউ সংবেদনশীল হবেন, সেটি স্বাভাবিক হলেও “ভূমিকম্পের সময় ব্যক্তি কোন অবস্থায় ছিল, তার ওপরেও তার টের পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে,” বলে জানান মি. হোসেন।

উদাহরণস্বরূপ তিনি মঙ্গলবার সকালের ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করেন।

“আজ যিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তার ভূমিকম্প টের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেউ যদি চলাচলের মাঝে থাকে, তার টের পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যিনি রান্না করছেন বা দৌঁড়াচ্ছেন তিনি টের না পেলেও যিনি চুপচাপ টেবিলে বসে কাজ করছেন, তার টের পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি,” বলছিলেন মি. হোসেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানাও একই কথা জানান বিবিসি বাংলাকে।

তিনি জানাচ্ছিলেন যে সাধারণত খুব কম মাত্রার ভূমিকম্প হলেও তিনি তা অনুভব করেন। কিন্তু তার বাসা নয় তলায় হওয়া সত্ত্বেও আজকের ভূমিকম্প তিনি অনুভব করেননি।

“এর কারণ, তখন বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর জন্য আমি নিজেই দৌঁড়াদৌড়ি করছি। আমি স্থির থাকলে আমি অবশ্যই অনুভব করতাম,” বলেন এই আবহাওয়াবিদ।

“আজ নিচ তলায় দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কেউ ভূমিকম্প অনুভব করেছে। আট-নয় তলার অনেক বাসিন্দাও কিন্তু আবার ভালোই ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন। মূলত, টিভি দেখছেন, তিনি হয়তো অনুভব করছেন। কিন্তু যিনি রান্না করছেন তিনি হয়তো ফিল করছেন না।”

তিনি আরও বলেন, যে এলাকায় ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানবার সবাই-ই স্বাভাবিকভাবে এটি অনুভব করে। কিন্তু দূরের ক্ষেত্রে এটা হয়– কেউ টের পায়, কেউ পায় না।

ভূমিকম্পপ্রবণ প্লেট

বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে

আজ সারা দেশে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, এর উৎপত্তিস্থল তিব্বতের শিগেৎসে শহরে। সেখান থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দূরত্ব ৬১৮ কিলোমিটার বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এর আগেও বাংলাদেশে গত তেসরা জানুয়ারি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো। তবে সেটি ছিল মাঝারি মাত্রার, আজকের মতো এতটা তীব্র ছিল না।

চলতি বছরের শুরুতেই হওয়া ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও ছিল বাংলাদেশের বাইরে।

রিখটার স্কেলে পাঁচ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের হোমালিন এলাকায়, ঢাকার সাথে যার দূরত্ব ৪৮২ কিলোমিটার।

কয়েকশো কিলোমিটার দূরের দেশে হওয়া পরপর দু’টি ভূমিকম্প বাংলাদেশে বসে এতটা জোরালোভাবে অনুভব করতে পারাটা কি কোনো চিন্তার কারণ?

জানতে চাওয়া হয়েছিলো আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানার কাছে।

“এই দু’টোর কোনোটাতেই বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়েনি। ঝাঁকুনি অনুভব করেছে কেবল। তবে আজকের মাত্রা যদি আরও বেশি হতো, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে পারতো। স্থায়িত্ব বা ম্যাগনিটিউড আরও বেশি হলে ঝাঁকুনি আরও বেশি হতে পারতো। ভবনে ফাটল ধরতে পারতো,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা—এ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বড় বড় ফল্ট আছে।

ভূমিকম্পে হাজারো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে তিব্বতে

মূলত, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।

সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।

যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।

বাংলাদেশ অঞ্চলে ভূমিকম্পের অন্যতম উৎস হলো ডাউকি ফল্ট, যেটি শেরপুর থেকে শুরু জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে বিস্তৃত।

“এসব কারণে বাংলাদেশ খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই ভূমিকম্প অনুভব করার জন্য যে নিজের দেশেই উৎপত্তি হতে হবে, এমন না। এর প্রমাণ তো এবার পাওয়াই গেল। ৬১৮ কিলোমিটার দূরের ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ভালোই ঝাঁকুনি খেয়েছে। মিয়ানমারের পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্পও ঢাকার মানুষ টের পাচ্ছে। ওইসব এলাকার বড় ভূমিকম্প আমাদের জন্য হুমকির,” বলছিলেন আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা।

তার মতে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, ভারত, নেপালের অবস্থান ওই তিন ফল্ট লাইনের আশেপাশে।

“তাই, মিয়ানমারের পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প আমরা অনুভব করি। আর যদি সেখানে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তখন আমাদের ওপর সেই প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর ভারত বা নেপালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ওই সম্ভাবনা আরও বেশি,” জানাচ্ছিলেন তিনি।

যদিও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেনের মতে, “আমাদের দেশ জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ না। আমরা মডারেটলি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ।”

“কিন্তু সেই অনুযায়ী আমাদের তো প্রস্তুতি নাই। আমাদের বিল্ডিং কোড মানা হয় না।”

ঘনবসতি ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নিয়ে তৈরি হওয়া অসংখ্য ভবনের কারণে ঢাকাকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়

কীভাবে ভূমিকম্প পরিমাপ করা হয়?

মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল নামেও ভূমিকম্প পরিমাপ করার একটি স্কেল আছে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র হিসেবে পরিচিত রিখটার স্কেলকে প্রতিস্থাপন করেছে।

ভূমিকম্পের মাত্রা বোঝাতে যে সংখ্যাটি দেয়া হয়, তা দিয়ে ফল্ট লাইন কতটুকু সরেছে এবং যে গতি এই সরানোর পেছনে কাজ করেছে সেটি নির্দেশ করে।

দুই দশমিক পাঁচ বা তার কম কম্পন সাধারণত অনুভূত হয় না, তবে যন্ত্রে ধরা পড়ে। পাঁচ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয় এতে সামান্য ক্ষতি হতে পারে। সাত দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্প বেশ শক্তিশালী বলে ধরা হয় এবং এতে মারাত্মক ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়।

আট মাত্রার বেশি কোনও ভূমিকম্প যে কোনো কিছুর ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে এবং এর কেন্দ্রে থাকা অবকাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে।

দুটি টেকটোনিক প্লেট বা সাবপ্লেট পরস্পরের দিকে অগ্রসর হলে একটি আরেকটির নিচে প্রবেশ করে। সাধারণত ভারি পাতটি হালকা পাতের নিচে প্রবেশ করে এবং যে সীমানা বরাবর প্রবেশ করে তাকে সাবডাকশন জোন বলে

বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন, সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দু’টো ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024