শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন

এক্সিট ট্রুডো

  • Update Time : বুধবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ৩.২৮ পিএম

জাস্টিন ট্রুডো কি বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রবণতার শিকারনাকি এক ব্যতিক্রমী ব্যর্থ নেতানাকি এমন কেউ যিনি ইতিবাচক ছাপ রেখে গেছেননা কি তিনটিরই মিশ্রণ?

কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী সোমবার তার লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানপার্লামেন্টের কার্যক্রম ২৪ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত রাখেন এবং আগামী অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের আগে দলের সদস্যদের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে বলেন। ট্রুডো নিজ দলে দেখা দেওয়া বিভাজনের কথা উল্লেখ করেন। সম্প্রতি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের পদত্যাগযিনি দীর্ঘদিন ট্রুডোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেনএবং যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক-আক্রমণের মুখে ব্যয়নীতি নিয়ে মতপার্থক্যকেও অনেকে ট্রুডোর বিদায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন।

ঠিক কী কারণে ট্রুডো ডুবে গেলেনসেই প্রশ্নে দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক সংবাদদাতা মারাইকে ওয়ালশ উল্লেখ করেনট্রুডোর জনপ্রিয়তা অনেক দিন ধরেই কমছিল। ২০১৫ সালে তার ক্যারিশমাউদ্যম ও নারীবাদী অবস্থান বিশ্বজুড়ে নজর কেড়েছিলতখন তিনি লিবারেলদেরকে নির্বাচনী দুরবস্থা থেকে টেনে সরকার গঠনের পর্যায়ে নিয়ে যান। কিন্তু নৈতিকতা-সংক্রান্ত বিতর্ক ও মহামারির ধাক্কায় সে ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ড তার ওয়োক এজেন্ডা” ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কঠোর নিয়মকানুনের সমালোচনা করেছে। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ট্রাকচালকরা অন্টারিওর অটোয়ার রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এসব নিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান।

 

দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের ওয়ালশ আরও লিখেছেন: তিনি বিভেদের রাজনীতির পথ বেছে নেন,” ডালহাউজি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের চেয়ার লরি টার্নবুলের বরাত দিয়ে বলেন, “বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি মাস্ক পরা ও টিকাদানকে নিয়ে এমন একটা অবস্থান নিয়েছিলেনযা কিছু ভোটারকে আকর্ষণ করলেও অন্যদের লজ্জিত করেছিল।” তার সমর্থকদের মতেট্রুডো নতুন কাঠামোয় কানাডিয়ান শিশু কল্যাণ ভাতা চালু করে শিশুদের দারিদ্র্য কমিয়েছেনজাতীয় শিশু যত্ন-ব্যবস্থার সূচনা করেছেনডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করেছেনআর শতাব্দীর অন্যতম বড় বৈশ্বিক মহামারির মধ্য দিয়ে কানাডাকে চালিয়ে নিয়ে গেছেন। আবার সমালোচকদের চোখে তিনি সেই প্রধানমন্ত্রীযিনি সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রায় দ্বিগুণ করেছেন ফেডারেল দেনাদুই দফায় ফেডারেল নীতিশাস্ত্র আইন লঙ্ঘন করেছেনবেশ কয়েকটি বিলাসী ছুটির পরিকল্পনাবিশেষ করে সত্য ও পুনর্মিলনের প্রথম জাতীয় দিবসের ছুটির সময় নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেনআর অভিবাসনসহ সরকারের মৌলিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। দ্য ইকোনমিস্টের মতেতিনি মহামারির পরে ভোটারদের অগ্রাধিকারের জায়গাগুলোমূলত মুদ্রাস্ফীতিবাসস্থান ও অভিবাসনঠিকভাবে পুনর্বিন্যাস করতে ব্যর্থ হনবরং তিনি কনজারভেটিভদের কথিত রূঢ়” পদ্ধতির বিরুদ্ধে নিজের নীতিবাক্য শুনিয়েছেনযা বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি।

আরো বড় যে প্রবণতার কথা বলা যায়তা হলোএই সময়ে ক্ষমতাসীনদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। ২০২৪ সাল ছিল এক বিশাল নির্বাচনী বছরবিশ্বের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোতে ভোট হয়েছেআর অধিকাংশ দেশেই ক্ষমতাসীনরা ভোটের ধাক্কায় হোঁচট খেয়েছে। (২০২৪ সালে ১২টি উন্নত পশ্চিমা দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলএবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল বা প্রার্থী ভোটের ভাগ হারায়গত ১২০ বছরের আধুনিক গণতন্ত্রের’ ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটেনি,” জন বার্ন-মারডক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে লিখেছিলেন।) আর দশ বছরের কাছাকাছি সময় ক্ষমতায় থাকা নেতাদের জন্য প্রায়ই সময়টা কঠিন হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রিয় নেতাদের টিকে থাকার প্রায়সই এই সীমা দেখা যায়,” লিখেছেন দ্য নিউ ইয়র্কারের অ্যাডাম গপনিক। টনি ব্লেয়ারও প্রায় একই সময়ে ব্রিটিশদের আস্থা হারিয়েছিলেন … একসময়ের অপ্রতিরোধ্য মার্গারেট থ্যাচারও দশ বছর পেরোনোর কিছু পর নিজের দলে সমর্থন হারান … অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে বাদ দিলেবড় কোনো গণতান্ত্রিক দেশের দীর্ঘস্থায়ী নেতা বলতে ছিল এফডিআর (ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট)যিনি আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশেষ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেনচার্লস দ্য গলযিনি ফ্রান্সের পঞ্চম রিপাবলিকের স্থপতিতাকেও ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত মোট দশ বছরের বেশি থাকতে দেওয়া হয়নি।

তারপরওট্রুডো জাতীয় পর্যায়ে বিশাল এক শূন্যতা রেখে যাচ্ছেন,” লিখেছেন টরন্টো স্টারের প্রতিবেদক টন্ডা ম্যাকচার্লস। তার মতো স্বতঃস্ফূর্ত তারকাখ্যাতি আর কোনো নেতা দাবি করতে পারবেন নাযদিও ট্রুডো ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে অন্তর্মুখী বলে মনে করেন। তার মন্ত্রিসভার অন্য কেউও বলতে পারবেন না যেতারা ট্রুডোর চেয়ে ভিন্ন কোনো আদর্শে চলেছেনকারণ একই সরকারে থেকেছেন তারা সকলেইধনীদের ওপর বেশি কর আরোপভোক্তা-পর্যায়ে কার্বন ফি চালুমহামারির সময় অধিক সরকারি ব্যয় দিয়ে সাধারণ কানাডিয়ানব্যবসা আর প্রদেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সহায়তা করাএবং পর্যাপ্ত বাসস্থান সরবরাহের আগেই অভিবাসন বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্তগুলোয় সবাই সম্পৃক্ত।

দ্য স্টিল ডিল যে সম্পন্ন হলো না

জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি ইউএস স্টিলকে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন স্টিলের কাছে বিক্রি করার বহুদিনের বিতর্কিত প্রস্তাব আটকে দিয়েছেন। এখন এই দুই কোম্পানি আবার আইনি পদক্ষেপ নিয়ে চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কোম্পানি বিদেশি মালিকানায় যেতে পারেতা পর্যালোচনা করেন সিএফআইইউএস (কমিটি ফর ফরেইন ইনভেস্টমেন্ট ইন দ্য ইউএস) নামের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। বাইডেনের প্রেসসচিব সিএফআইইউএস-এর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেনঅনেক পর্যবেক্ষকও একমত। কমপ্যাক্টে কেনেথ রাপোজা যুক্তি দিয়েছেনদেশের নিজস্ব স্টিল উৎপাদন ক্ষমতা রাখা নিজেই একটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। বাইডেনের সিদ্ধান্ত শুধু একটি কোম্পানি বা এর শ্রমিক নেতাদের রক্ষা করা নয়বরং যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল উৎপাদনের ভবিষ্যৎকেই সুরক্ষা দেওয়া,” লিখেছেন রাপোজা। নিপ্পনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাইডেনট্রাম্পের মতোইবোঝাতে চেয়েছেন যে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোকে দেশে রাখতে হবে।

অন্যরা বলছেনএই পর্যালোচনা প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি রাজনীতিকরণ হয়েছে। ট্রাম্প নিজেই ইতিমধ্যে জানিয়েছিলেন যেতিনিও এই চুক্তি আটকে দিতেন। এখন বাইডেন মূলত জাতীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞাকেই অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের দিকে প্রসারিত করছেনযার ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য নতুন নতুন দরজা খুলে যাচ্ছে,” বলছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ড। শ্রমিক ইউনিয়ন আর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সিএফআইইউএস-কে ব্যবহার করে অযাচিত বিনিয়োগ আটকানোর চেষ্টা করবে। বিদেশি মূলধন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগে আরও সাবধান হবে।

ডানপন্থী আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে জ্যাক কুপার লিখেছেন: এই চুক্তিটি প্রথম থেকেই রাজনৈতিক ছিল। ইউএস স্টিল ও নিপ্পন স্টিলেরও এর জন্য কিছুটা দায় নিতে হবে। তারা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পেনসিলভানিয়ায় চুক্তি ঘোষণা করেযখন সেখানকার প্রাইমারি নির্বাচনের প্রচারণা তুঙ্গে। শুরু থেকেই তাদের রাজনৈতিক কৌশল যথেষ্ট দৃঢ় ছিল না। … শেষ পর্যন্ত ফলাফল যাই হোক না কেনকোম্পানিগুলো বুঝে গেছে যে অর্থনৈতিক যুক্তি ও আইনি বিধান এখন দ্বিতীয় স্তরে চলে গেছেমূল ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিদেশি কোম্পানি আর ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান ব্র্যান্ডকে জড়িয়ে যে কোনো লেনদেনবিশেষ করে ঐতিহ্যগত ম্যানুফ্যাকচারিং খাতেঅবশ্যই রাজনৈতিক ধাক্কা খাবে। গাড়ি ও চিপ নির্মাতারা সতর্ক দৃষ্টিতে এটা দেখছেভাবছে এ বার কি তাদের পালা?”

ফরিদের বিশ্লেষণ

রবিবারের জিপিএস অনুষ্ঠানে ফরিদ যুক্তি দিয়েছেন যেবৈশ্বিক বিরোধী-ক্ষমতাসীন প্রবণতা মূলত প্রগতিশীল সরকারগুলোর সংকটকারণ মধ্য-বামপন্থী দলগুলোকেই জনতার অসন্তোষ বেশি বহন করতে হচ্ছে। ভোটাররা মনে করছে তারা অনেক বেশি কর দিয়েছেঅনেক নিয়মকানুনের মধ্যে পড়েছেতবু ফল ভালো হয়নি।

২০২৫ সালের অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি

রবিবারের জিপিএসে বিনিয়োগকারী ও ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর লেখক রুচির শর্মা ২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে নজর দেওয়ার কিছু উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেন। পরের দিনশর্মা তার শীর্ষ ১০ পূর্বাভাস” ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশ করেন।

তার তালিকাটি মোটামুটি এ রকম: ১) যুক্তরাষ্ট্র ও এর শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে সরে যাওয়ার মাধ্যমে কনট্রেরিয়ান ইনভেস্টিং’-এর ফিরে আসা২) প্রযুক্তি ও অর্থখাতের মতো হট সেক্টর’-এ ভিড়ের বিনিয়োগ ধাক্কা খাওয়া৩) উচ্চ ঘাটতি ও বেশি ঋণ সরকারী বন্ডের জন্য চাপ সৃষ্টি করা৪) প্রচণ্ড উদ্দীপিত’ মার্কিন অর্থনীতি অন্য দেশের তুলনায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা৫) কম আলোচিত জাতিগুলো নতুনভাবে তারকাখ্যাতি পাওয়া৬) চীন আবার বিনিয়োগযোগ্য’ হয়ে ওঠা৭) বিগ টেক তাদের এআইসংক্রান্ত অবকাঠামোয় অতিরিক্ত ব্যয় করে ফেলা৮) ট্রাম্প-নেতৃত্বাধীন আরও সুরক্ষাবাদী আমেরিকাকে ফাঁকি দিতে অন্যরা বিকল্প বাণিজ্য চ্যানেল খুঁজে নেওয়া৯) ব্যক্তিমালিকানাধীন মূলধন বা প্রাইভেট ক্যাপিটালের অতিরঞ্জিত কিছু উদ্যোগের ওপর আরও নিবিড় বিশ্লেষণ’ দেখা দেওয়াআর ১০) জনপ্রিয় ওজন কমানোর ওষুধগুলো শেষ পর্যন্ত অতি-আশাবাদের ফাঁদ’ হিসেবে দেখা দেওয়া।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024