স্বদেশ রায়
চিন্ময় কুমার দাসকে ( চিন্ময় প্রভু) নিম্ম আদালত জামিন দেয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে এটা জামিন যোগ্য মামলা নয়। অপরদিকে যদিও চিম্ময় দাসের আইনজীবিকে ভালোভাবে কথা বলারও সুযোগ দেয়া হয়নি- তারপরেও তরুণ ওই আইনজীবি অনেক ধৈর্য নিয়ে আদালতকে জানান, এই মামলা কোন মতেই রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা নয়, কারণ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হয় রাষ্ট্রকে।
বাস্তবে চিম্ময় দাসের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলো বিএনপির এক কর্মী। এবং ওই মামলা করার জন্যে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিস্কারও করছে। যেহেতু সে দলের কর্মী হিসেবে মামলা করেছে এবং বিএনপি তাকে বহিস্কার করেছে- এর পরে ওই মামলা থাকে কিনা সেটাও যেমন প্রশ্ন, তেমনি মূল প্রশ্ন রাষ্ট্র নিজে কি চিম্ময় দাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে?
এছাড়াও আরো একটি বিষয় চিম্ময় দাসের জামিনের আবেদন নিয়ে যখন তাঁর আইনজীবি আদালতের উদ্দেশ্য তার জামিনের সপক্ষে বক্তব্য রাখতে থাকেন, ওই সময়ে এজলাসে একদল আইনজীবি ঢাকা না দিল্লি, ঢাকা না দিল্লি বলে স্লোগান দিতে থাকে। আদালত বা আদালত পুলিশ তাদেরকে কোনরূপ নিরস্ত করেনি। এই আচরণ দুটো বিষয় সামনে নিয়ে আসে, ওই আইনজীবিদের ওই আচরণ করতে দেবার ভেতর দিয়ে প্রথমত প্রমানিত হয়, মামলাটি রাজনৈতিক। দ্বিতীয়ত্ব, চিম্ময় দাসের জামিনের আবেদনে ঢাকা না দিল্লি স্লোগান দিয়ে ঈংগিতে চিম্ময় দাসকে ভারতের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের সেই পুরানো রাজনীতি অর্থাৎ ভারত বিরোধী রাজনীতি বা এ ভূখন্ডের হিন্দুদের ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে একটা মিথ্যে অপবাদ দেয়া।
কিন্তু এই ২০২৪ এসেও এই মিথ্যে অপবাদ দেবার আগে একবার অন্তত সচেতন সকলের চিন্তা করা উচিত এই ভূখন্ডের হিন্দুদের দেশপ্রেম নিয়ে আর কত অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে? কারণ, এ দেশের ভাষা আন্দোলনের আইনগতভাবে সূচনা করেছিলেন পাকিস্তান পার্লামেন্টে ধীরেন্দ্রনাথ দও। যিনি ভারতে চলে গেলে হয় মূখ্যমন্ত্রী থাকতেন না হয় কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীত্ব পেতেন। জওয়াহেরলাল নেহরু বার বার তাকে সেই দায়িত্ব নেবার জন্যে বললেও তিনি নিজ মাতৃভূমি ফেলে যাননি। আর তিনি যখন পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা করার এমনকি পোস্টাল বিষয়গুলোতেও বাংলা ব্যবহারের দাবী জানান- সে সময়ে অধিকাংশ পূর্ববাংলার পার্লামেন্ট মেম্বর হয় নীরব ছিলেন না হয় বিরোধীতা করেছিলেন। তার এ ভূমিকা আজকের প্রজম্ম এমনিক আমাদের যারা বর্তমানে সরকারে আছেন তারা যে জানেন না তা তাদের আচরণও কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়। তারা এ দেশের অনেক ফাউন্ডিং ফাদার খুঁজছেন কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে খুঁজে পাননি। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ এর ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণ পড়লে জানতে পাবেন, সেখানে তিনি স্পষ্ট বলছেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সময়ে পার্লামেন্টে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবী জানান সে সময় আমাদের মুসলিম পার্লামেন্ট সদস্যরা কোথায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিকভাবে সত্য স্বীকারের পাশাপাশি বদরুদ্দিন ওমরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও সে ইতিহাসের ব্যখা নিয়ে তাঁর যতগুলো বই আছে এর কিছু অংশ পড়লেও অন্তত বুঝতে পারবেন- কে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত -আর কী করেছিলেন তিনি তার মাতৃভূমির জন্যে? অশতিপর এ মানুষটি কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হয়েছেন। তার রক্ত, হাড় ও মাংস তার প্রিয় জম্মভূমির মাটিতে মিশে আছে। অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারা দেশে এখন শহীদের নামের ফলক যেগুলো অবশিষ্ট আছে- সেগুলোর দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে প্রত্যেকটিতে কতজন হিন্দু শহীদের নাম।
এমনকি এই ভূখন্ডকে স্বাধীন করার জন্যে ১৯৭০ সালে যে প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আনে- পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ- সে প্রস্তাবটি ওই সংগঠনের যে সাংগঠনিক সম্পাদক এনেছিলেন তার নাম স্বপন চৌধুরি। তার পঠিত প্রস্তাবে সেদিন বলা হয় এ ভূখন্ড হবে “স্বাধীন সামাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ”। যদিও প্রস্তাবটি তার ব্যক্তিগত ছিলো না, তার সংগঠনের ছিলো। এবং এই প্রস্তাবের পেছনে ওই সংগঠনের প্রাক্তন নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি প্রমূখের চিন্তাধারা কাজ করেছিলো- তারাপরেও সেখানে জড়িয়ে আছে স্বপন চৌধুরির নাম। এবং সেটা যে তিনি তার বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তার প্রমান, বীর চট্টলার এই বীর-সন্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন।
এমনকি ২০২৪ এ এসে প্রথমে চাকুরির অধিকার ও পরে বৈষম্য বিলোপের অধিকার চেয়ে যে আন্দোলন হলো সেখানেও দেখা যাচ্ছে শিল্পী রাহুল আনন্দ থেকে হাজার হাজার হিন্দু ছেলে মেয়ে অংশ নিয়েছিলো।
কিন্তু এ সব কিছুর পরিনাম কি হচ্ছে? আন্দোলন শেষে উৎসব হিসেবে রাহুল আনন্দ’র বাড়ি পুড়ছে। আর বিবিসি’র ডকুমেন্টারিতে দেখা যাচ্ছে সুকান্ত বর্মন ও বনমালী বর্মন দুই ছাত্র যারা একটিভলি ২০২৪ এর আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। আন্দোলন শেষে তারা দেখতে পেলো, হাজার হাজার হিন্দুর বাড়ি ঘর পুড়ছে, মা বোন ইজ্জত রক্ষার জন্যে ঝোপে ঝাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে। তাই যারা জম্মের পর থেকে নিজেদেরকে সংখ্যালঘু মনে করেনি, যারা তাদের আর পাঁচ জন বন্ধুর মতো ২০২৪ এর আন্দোলনে গিয়েছিলো- অধিকতর ন্যায় বিচারের সমাজের জন্যে- তারা বিবিসির ৩ জানুয়ারি রিলিজ হওয়া ডকুমেন্টারির শেষে এসে বলছে, “এখন আমরা বুঝতে পারছি, আমরা এদেশে সংখ্যালঘু”।
বাংলাদেশের ২ কোটি হিন্দু কিন্তু মেনে নিয়েছে যে তারা শতভাগ রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার এখানে বাস্তবে পাবে না। তারপরেও তারা অন্তত নিরাপদে এখানে থাকতে চায়। আর একটি নতুন প্রজম্ম যা আমি আমার আগের একটি লেখায়ও উল্লেখ করেছি, তারা এ দেশে থাকতে চায় তাদের জম্মভূমি হিসেবে অধিকার নিয়ে।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাভাষার অধিকারের আন্দোলনের সূচনার মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে বীজ বপন করেছিলেন- তখনও তিনি নিজেকে সংখ্যালঘু মনে করেননি। কারণ, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার প্রথম ভাষনেই বলেছিলেন, আজ থেকে এই দেশ শুধু মুসলমানের নয়- এ দেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্টান সকলের ( যদিও তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি)। তাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেদিন সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন। স্বপন চৌধুরি স্বাধীনতার প্রস্তাব তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এনেছিলেন একটি সকলের বাংলাদেশ সৃষ্টির অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
আর আজ চিম্ময়কে আন্দোলন করতে হচ্ছে একজন হিন্দু হিসেবে। কেন এই পিছিয়ে যাওয়া, কেন এই দুর্ভাগ্য- এ নিয়ে লিখতে গেলে হাজার পৃষ্টায়ও শেষ হবে না। এবং দুর্ভাগ্যর কারণও জানেন এমন বহু মানুষ আছেন যারা আরো ব্যখা করে লিখতে পারবেন। এমনকি চিম্ময় যে আট দফা দাবী নিয়ে হিন্দুরা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সেজন্য মাঠে নেমেছে- সে চিম্ময়ও জানে কেন আজ আলাদা করে শুধু দুই কোটির বেশি হিন্দুদের নিরাপদে অধিকার চাইতে হচ্ছে তাকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।
নিজেদেরকে পরিপূর্ণ নাগরিক থেকে এতটা নামিয়ে শুধু নিরাপদে থাকার ও তার সঙ্গে সামান্য কিছু অধিকার চেয়ে মাঠে দুটো জনসভা করার পরে- আজ তাকে যদি দেশদ্রোহী হিসেবে জেলে থাকতে হয়, তাহলে সেখানে মানুষের যেমন দুফোঁটা চোখের জলও শুকিয়ে যায়; তেমনি রাষ্ট্র’র চরিত্রও কি প্রশ্নের মুখে পড়ে না? এমনকি ইতোপূর্বে এদেশে এমন ঘটনা ঘটলে সিভিল সোসাইটি যেভাবে কথা বলতো, তাও যখন প্রায় শূন্যের কোঠায়- আর এমন সময়ে স্বাভাবিকই চিম্ময় একটি অভাগা মানব শ্রেনীর প্রতীক হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জম্মের সঙ্গে অনেক রক্ত জড়িত। অনেক সম্পদ হারানোর ইতিহাস সেখানে জড়িত। তাই এই রাষ্ট্রকে কখনই মানায় না সে একটি মানব সম্প্রদায়কে ধর্মের নামে অভাগা শ্রেণী তৈরি করবে। বরং এ রাষ্ট্র’র জম্মের স্পিরিটই বলে, চিম্ময় এই ভাগ্য বরণ করতে পারে না। তাই চিম্ময় প্রকৃত বিচার পাক এই আশা প্রতিটি সচেতন মানুষের হোক এদেশে।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply