শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৪৯ পূর্বাহ্ন

জাপানি ব্যবসায়ীদের  বড় বাজার হতে চলেছে ভারত 

  • Update Time : বুধবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ৭.০০ পিএম

সারাক্ষণ ডেস্ক 

ভারত বর্তমানে জাপানি কোম্পানিগুলোর অন্যতম সম্ভাবনাময় বাজারে পরিণত হয়েছে বলে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। চীনের বিনিয়োগ-গন্তব্য হিসেবে আকর্ষণ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের এই উত্থান ঘটেছে, যদিও এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের কিছু ঝুঁকি বিদ্যমান।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানায়, আগামী এক থেকে দুই বছরে কোন দেশে জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে, সেই তালিকায় ভারত শীর্ষে রয়েছে। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৮০.৩% প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে তারা ভারতে ব্যবসা বৃদ্ধি করতে চায়, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.৭ পয়েন্ট বেশি।

অন্যদিকে চীনের ক্ষেত্রে এই হার নেমে এসেছে ২১.৭%-এ, যা ২০০৭ সাল থেকে উপস্থাপিত তুলনামূলক তথ্যের সর্বনিম্ন। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে থাইল্যান্ডে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকা জাপানি কোম্পানির সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৮.১ পয়েন্ট কমে ৩৪.১%-এ পৌঁছেছে।

জেট্রোর গবেষণা বিভাগের মাসাশি কোনো জানান, “আমরা ভারতে একধরনের ‘বুম’ দেখতে পাচ্ছি।”

এই সম্প্রসারণ পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে আয় বৃদ্ধির প্রত্যাশা। একই সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতে ২০২৪ সালে অধিকাংশ জাপানি কোম্পানি—মোট ৫৫.০%—তাদের অপারেটিং মুনাফা বাড়বে বলে আশা করছে, যা অন্য যেকোনো অর্থনীতির তুলনায় সর্বোচ্চ।

ভারতে অপারেটিং মুনাফা অর্জনের পূর্বাভাস দেওয়া কোম্পানিগুলোর অনুপাত ৬.৮ পয়েন্ট বেড়ে ৭৭.৭%-এ পৌঁছেছে, যা ২০০৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ।

জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন (জেবিআইসি) গত ডিসেম্বর প্রকাশিত “জাপানের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগের পূর্বাভাস” প্রতিবেদনে জানায়, আগামী তিন বছরে ভারতে বিনিয়োগকে “আশাব্যঞ্জক” বলে মনে করে ৫৮.৭% জাপানি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

এটি আগের বছরের তুলনায় ১০.১ পয়েন্ট বেশি, এবং টানা তিন বছর ধরে ভারত এই তালিকায় প্রথম স্থান ধরে রেখেছে। একই সমীক্ষায় চীনের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, মাত্র ১৭.৪%।

ভারতের অর্থনীতি এখন ব্যাপকভাবে বিকাশমান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার এই দেশটির বাস্তব জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.২%। ২০২৪ সালে এটি ৭.০%-এ এবং ২০২৫ সালে ৬.৫%-এ নেমে আসলেও বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারত এখনো শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখবে।

আইএমএফ আরও ধারণা করছে যে ২০২৬ সালে নামমাত্র জিডিপির দিক থেকে ভারত জাপানকে ছাড়িয়ে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে—যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানির পরেই। ২০২৮ সালে জার্মানিকেও অতিক্রম করে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে।

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আগামীতে দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়ার প্রায় নিশ্চয়তায়, ১৪০ কোটি মানুষের এই দেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদার স্রোতে গা ভাসাতে আগ্রহী জাপানি কোম্পানিগুলো।

তবে কিছু অনিশ্চয়তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকার আগে যে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর ছিল, সেখানে কিছু ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গত সাধারণ নির্বাচনে সংসদে কিছু আসন হারিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আদানি গ্রুপকে ঘিরে ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ওঠা অভিযোগ ভারতে অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

যদিও ভারত সরকারের তথ্যমতে, সামগ্রিকভাবে ২০২৩ সালে ভারতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা কমেছে, কিন্তু জাপানের বিনিয়োগ স্থির গতিতে বেড়েছে। জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যেই জাপানের বিনিয়োগ ২০২২ সালের পুরো বছরের বিনিয়োগকেও ছাড়িয়ে গেছে।

তারপরও ভারতে ব্যবসা পরিচালনা করতে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি সংস্থাগুলো পণ্যের ওপর বাধ্যতামূলক ‘বিউরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস’ (বিআইএস) সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার পরিধি দ্রুতগতিতে বাড়িয়েছে। এই সনদ না থাকলে পণ্য আমদানি করা যায় না।

অনেকের মতে, এটি চীন থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার একটি কৌশল। তবে এর প্রভাব বিস্তৃত পরিসরে পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, জাপানি কোম্পানিগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে উপকরণ তৈরি করে সেগুলো ভারতে পাঠিয়ে পণ্য চূড়ান্তভাবে সংযোজন করে। নতুন করে আরও পণ্যে বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশন প্রয়োজন হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে যে তারা এখন জাপান থেকে ভারতে অংশ-পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না এবং এই কারণে উৎপাদন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছে।

ভারতে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কর সংক্রান্ত জটিল বিধিনিষেধ দীর্ঘদিন ধরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উচ্চ শ্রমিক মজুরি আর কর্মীর দ্রুত চাকরি পরিবর্তনের হারও যোগ হয়েছে।

ভারতে ব্যবসা পরিচালনাকারী জাপানি কোম্পানির সংখ্যা সামান্য করে কমে আসছে, যা হয়তো স্থিতিশীল এক পর্যায়ে আটকে গেছে। অনেকে ভারতে শাখা বা কার্যালয়ের সংখ্যা বাড়ালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ, নতুনভাবে আগত কোম্পানির সংখ্যা ততটা নয়।

জেট্রোর সমীক্ষা অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বাজারে টিকে থাকা জাপানি কোম্পানিগুলো এখন অবশেষে তাদের বিনিয়োগের সুফল পেতে শুরু করেছে।

ভারতে অন্তত ১০ বছর ধরে কার্যক্রম চালানো জাপানি প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর প্রায় ৯০% অপারেটিং মুনাফা অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে, যেখানে ১০ বছরের কম সময় ধরে থাকা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই হার মাত্র প্রায় ৬০%।

লাভজনক অবস্থানে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে—এমন আশঙ্কায় অনেক ছোট ও মাঝারি মাপের কোম্পানি এই বাজারে প্রবেশের ঝুঁকি নিতে দ্বিধায় রয়েছে। ভারতে যে জাপানি কোম্পানিগুলো রয়েছে তার মাত্র ১৫%-এর মতো হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024