বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:০৪ অপরাহ্ন

শহুরে রোপওয়ে কি ভবিষ্যতের জন্য ভালো? 

  • Update Time : শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫, ৭.০০ পিএম

সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

বারাণসী, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও অবিরত বসবাসকারী নগরী, তার সংকীর্ণ অলি-গলি, ব্যস্ত বাজার, খাবার, দৃশ্য ও শব্দের জন্য সুপরিচিত—সব মিলিয়ে এটি এক অনন্য সংবেদী অভিজ্ঞতা দেয়। কিন্তু শিগগিরই ৪৫ মিটার উঁচু থেকে এই শহরের অলিগলি দেখার সুযোগ মিলবে, কারণ ভারতে প্রথম শহুরে রোপওয়ে ব্যবস্থার পরীক্ষামূলক যাত্রা ফেব্রুয়ারি মাসে বারাণসীতে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রতি দিন সর্বোচ্চ পর্যটক-সংখ্যা ২ লক্ষে পৌঁছাতে পারে, তাই এই কেবল কার ব্যবস্থা স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের অনেকটাই সহায়তা করবে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ। বারাণসী ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বারাণসী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ভাইস-চেয়ারম্যান পুলকিত গার্গ জানিয়েছেন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গদোলিয়ায় পৌঁছাতে যেখানে সাধারণত ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে, রোপওয়ে ব্যবস্থায় সময় লাগবে মাত্র ১৫ মিনিট।

৩.৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রোপওয়ে ব্যবস্থা গদোলিয়া চৌক, গিরজা ঘর, রথ যাত্রা, কাশী বিদ্যাপীঠ (ভারতমালা মন্দির) এবং বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে থামবে। এটি এক ঘণ্টায় একদিকে ৩,০০০ মানুষ পরিবহন করার মতোভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। দিনে ১৬ ঘণ্টা চালু থাকলে এই রোপওয়ে ব্যবস্থায় প্রতিদিন ৯৬,০০০ মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। গার্গের মতে, এ বছরের প্রথম ভাগেই এর কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার একটি সহযোগী সংস্থা ন্যাশনাল হাইওয়েজ লজিস্টিকস ম্যানেজমেন্ট (এনএইচএলএমএল) এই প্রকল্প তৈরি করছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের অধীনে হাইব্রিড অ্যানুইটি মডেলে। এনএইচএলএমএল বর্তমানে প্রায় ২০০টি রোপওয়ে প্রকল্প তৈরির কাজ করছে। এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশের কুলু, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনের মহাকালেশ্বর মন্দির এবং হরিয়ানার দোসি হিলসে তিনটি প্রকল্পের টেন্ডার ডাকা হয়েছে জাতীয় রোপওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম—পার্বতমালা প্রকল্পের আওতায়।

ভাড়া এখনো অফিসিয়ালভাবে নির্ধারিত না হলেও গার্গ বলেছেন, অন্যান্য মেট্রো শহরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দাম রাখা হবে। অন্যদিকে এনএইচএলএমএল-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বারাণসীতে প্রচলিত অটোরিকশা ভাড়ার কাছাকাছি টিকিট মূল্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্টেশনগুলোর ভেতরে থাকা বাণিজ্যিক জায়গার আয় থেকে টিকিটের দাম নাগালের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন গার্গ। তিনি বলেন, “প্রতিটি স্টেশনে অন্তত ২,০০০-৩,০০০ বর্গমিটার বাণিজ্যিক জায়গা থাকবে।”

প্রধানমন্ত্রী ও বারাণসীর সংসদ সদস্য নরেন্দ্র মোদি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এই রোপওয়ে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার পর পরিকল্পনা ছিল গত বছরের মাঝামাঝি বাণিজ্যিক পরিষেবা শুরু করার। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি পিছিয়ে যায়। গার্গ জানান, সর্বশেষ জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত সমস্যা মাত্র গত সপ্তাহেই মিটেছে। বেশির ভাগ কাজ সরকারি জমিতে হওয়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণে খুব বেশি খরচ হয়নি, মাত্র ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

রোপওয়ে চালু হলে বারাণসী বিশ্বের সেইসব শহরের কাতারে যোগ দেবে, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকার শহরগুলোর সারিতে, যেখানে এরকম বায়বীয় গণপরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে।

ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে যেসব রোপওয়ে রয়েছে, সেগুলো সাধারণত পর্যটনকেন্দ্রিক আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে। সেগুলো এখনো বড় আকারের গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে ওঠেনি। যদিও রোপওয়ে, কেবল কার এবং এরিয়াল ট্রামের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, এদের সবই মূলত বায়বীয় লিফটের অন্তর্গত।

কলোম্বিয়ার মেডেলিন ছিল প্রথম শহর, যেখানে ২০০৪ সালে মেট্রো নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করে গণপরিবহন কেবল কার চালু হয়। ২০২২ সাল নাগাদ এই নেটওয়ার্ক ছয়টি লাইনে ১৪ কিলোমিটারে বিস্তৃত হয় এবং বছরে ২২ কোটি যাত্রীর বেশি বহন করে। এর মধ্যে প্রধান একটি লাইন প্রতিদিন ৪৪ হাজার যাত্রী বহন করে। মেক্সিকো সিটিতে প্রায় ২৪.৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এমন একটি ব্যবস্থা রয়েছে, যা দুইটি লাইনে বিভক্ত; প্রতিদিন গড়ে ১,৩৫,০০০ মানুষ যাতায়াত করেন, বিশেষত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে।

বলিভিয়ার “মি টেলেফেরিকো (আমার কেবল কার)” বিশ্বের বৃহত্তম ও উচ্চতম কেবল কার ব্যবস্থা, যা এল আলটো ও লা পাজ শহরকে সংযুক্ত করেছে এবং চারপাশের বৃহত্তর নগর এলাকায় পরিবহন সহজতর করেছে। সেখানে ১০টি লাইনে প্রতিদিন ৩ লক্ষ যাত্রী চলাচল করেন, যেখানে একটি প্রধান লাইন একাই ৬৫ হাজারের বেশি যাত্রী বহন করে। আগে এই দুই শহরের মধ্যে বাসে যাতায়াতে যেখানে প্রায় এক ঘণ্টা লাগত, এখন কেবল ১৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায়, তাও তুলনামূলক সস্তা ভাড়ায়।

নিউ ইয়র্ক, আলজেরিয়ার কন্সট্যান্টাইন, ইসরায়েলের হাইফা, বেলজিয়ামের নামুর—এই শহরগুলিতেও একই ধরনের কেবল কার বা এরিয়াল ট্রাম থাকলেও সেগুলো দক্ষিণ আমেরিকার শহরগুলোর মতো বিস্তৃত বা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত নয়। ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে রুজভেল্ট আইল্যান্ড থেকে ম্যানহ্যাটন পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের একটি এরিয়াল ট্রামওয়ে চালু হয়, যা প্রতিবছর ২০ লক্ষের বেশি যাত্রী বহন করে।

সংযোগ বৃদ্ধি

মেডেলিন, লা পাজ বা ভেনেজুয়েলার কারাকাসে কেবল কার ভালো সাড়া পেলেও ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ উপলক্ষে চালু করার পর তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। অথচ একই অঞ্চলে অন্য শহরগুলোতে এধরনের ব্যবস্থা সুফল দিয়েছে—যেমন পরিবহন-সমাধান ছাড়াও সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও সাহায্য করেছে।

বারাণসীতে গার্গ জানিয়েছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাস্তা প্রশস্ত করা বা ফ্লাইওভার বানানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ ছাড়া দূষণ ও যানজট কমানোর ক্ষেত্রে রোপওয়ে ভালো সমাধান দিতে পারে। একই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণও তুলনামূলক কম করতে হয়—এক্ষেত্রে মাত্র ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। “একমাত্র বিকল্প ছিল পাতাল মেট্রো তৈরি করা, কিন্তু শহরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিবেচনায় মাটি খুঁড়ে কাজ করায় বড় ঝুঁকি ছিল,” বলেছেন তিনি।

উল্লেখ্য, বারাণসী টোয়োটা মোবিলিটি ফাউন্ডেশনের ৯ মিলিয়ন ডলারের ‘সাসটেইনেবল সিটিজ চ্যালেঞ্জ’-এ ডেট্রয়েট ও ভেনিসের পাশাপাশি স্বাগতিক শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় সারাদেশ ও বিদেশ থেকে পাঠানো নানা উদ্ভাবনী প্রস্তাব বাছাই করা হচ্ছে, যার মধ্যে থাকবে ভার্চুয়াল সিমুলেশনের মাধ্যমে ভিড় নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি—বিশেষ করে মহাশিবরাত্রি বা দীপাবলির মতো উচ্চ জনসমাগমের দিনে।

বারাণসীর জন্য সমাধানগুলো বেছে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত এক স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, “রেলস্টেশন ও হাইওয়ের সঙ্গে পুরনো মন্দির-শহরকে যুক্ত করার জন্য রোপওয়ে অত্যন্ত কার্যকর পরিবহন মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হতে চলেছে।”

ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথরিটির (এনএইচএআই) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বারাণসীর আর্থিক কাঠামো যদি সফল প্রমাণিত হয়, তাহলে দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে—যেমন দিল্লির চাঁদনি চক বা হায়দরাবাদের পুরনো শহর অঞ্চলে—এ ধরনের রোপওয়ে ব্যবস্থা চালুর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024