বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৩০ পূর্বাহ্ন

কীভাবে ভারতীয় শিল্পীরা খ্রীষ্টের জন্মকে কল্পনা করেছেন

  • Update Time : শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২৫, ৪.৪২ পিএম

শেরিল্যান মোল্লান

খ্রীষ্টের জন্ম – যা বাইবেলের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা – পশ্চিমা শিল্পীরা বহু শতাব্দী ধরে তাঁদের নিজস্ব সৌন্দর্য-দর্শন ও শিল্পরীতি প্রয়োগ করে ক্যানভাসে এঁকেছেন। খ্রিস্টীয় শিল্পের সর্বাধিক পরিচিত এসব কাজ বিশ্বের কাছে এই ঘটনার ধারণা রূপায়িত করেছে। ফলেবাইবেলের এই আখ্যানকে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রভাব এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে এর বাইরের শিল্পীগণ যেন কার্যত প্রান্তিক হয়ে পড়েছিলেন।

তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় শিল্পীরাও নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে যীশুর জন্ম এবং অন্যান্য খ্রিস্টীয় বিষয়কে চিত্রিত করেছেন। কেউ করেছেন সচেতনভাবেকেউ বা অজান্তেইকিন্তু সব মিলিয়ে তারা এই ঘটনার ব্যাখ্যায় এক নতুন মাত্রা এবং নতুন অর্থ নিয়ে এসেছেন।

ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের কিছু চিত্রকর্মে খ্রীষ্টের জন্ম অন্য এক স্বতন্ত্রস্থানীয় পরিবেশে রূপ লাভ করেছে।

মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে উত্তর ভারতে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। আকবর তাঁর দরবারে যাজক-সংঘকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা তাঁদের সঙ্গে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং খ্রিস্টীয় বিষয়বস্তুর ইউরোপীয় শিল্পকর্ম নিয়ে আসেন। দরবারের চিত্রশিল্পীরাও এগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। শুধু তাই নয়আকবর এবং তাঁর উত্তরসূরিরা খ্রিস্টীয় বিষয় নিয়ে চিত্রকর্ম আঁকানোর বরাত দেনযেখানে অনেক সময়ে ইসলামী শিল্পরীতির ছোঁয়াও মিশে যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবেত্তা নেহা ভারমানি জানানএকটি মুঘল চিত্রকর্মে রাজার আসনে জাহাঙ্গীরকে দেখানো হয় যীশুর জন্মের দৃশ্যেযেখানে সাধারণত কুমারী মেরিযোসেফ এবং শিশু যীশু থাকেন। তিনি বলেন, “মুঘল শাসকরা নিজেদের ন্যায়পরায়ণ শাসক বলে ভাবতেনযাঁরা তাঁদের সাম্রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম। তাঁরা নিজেকে সার্বজনীন’ শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় সহাবস্থান সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই একটি অংশ।

নিম্নের ১৮শ শতকের একটি চিত্রকর্মে মুঘল শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্যযেমন সুস্পষ্ট রেখাচিত্রউজ্জ্বল রংপ্রকৃতিনির্ভরতা এবং অলঙ্করণ শৈলী স্পষ্ট দেখা যায়।

জামিনি রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালেবর্তমান পশ্চিমবঙ্গে। তিনি বাঙালি লোকশিল্প এবং কালীঘাট চিত্রকলার উপাদান মিলিয়ে নিজস্ব এক শিল্পরীতি গড়ে তোলেন। আর্ট সমালোচক ডব্লিউজিই আর্চার একবার মন্তব্য করেছিলেন যে জামিনি রায়ের ছবিতে যীশুর অবয়ব নাকি সাঁওতালদের আদলে আঁকা হয়েছে।

কলা বিষয়ক সংস্থা ডিএজি-এর সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর আশীষ আনন্দ বলেন, “যীশুর জীবন ও ত্যাগ জামিনি রায়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই খ্রিস্টীয় বিষয় নিয়ে তাঁর ছবিযেমনটি তিনি হিন্দু পৌরাণিক বিষয়েও এঁকেছেনএকই সঙ্গে লোকজ এবং আধুনিকতার ফিউশন— যেটিকে তিনি নিজের সিগনেচার স্টাইল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

১৯০২ সালে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গোয়ায় জন্ম নেওয়া অ্যাঞ্জেলো দে ফনসেকা পূর্ব ও পশ্চিমের মিশেলেতাঁর স্বতন্ত্র গোয়ান দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে খ্রিস্টীয় চিত্ররীতি সৃষ্টি করেন। তাঁর চিত্রে মেরিকে কেবল সাদা চামড়ারনীলবস্ত্র পরা ইউরোপীয় অবয়বে দেখা যায় না। বরংতিনি ভারতীয় ভাবধারায় শ্যামবর্ণশাড়ি পরাএবং গলায় মঙ্গলসূত্র পরে আছেন।

এই সব চিত্রে বাইবেলের দৃশ্য ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ফুটে ওঠেস্থানীয় মোটিফ ও উপাদান ব্যবহারে ভারতীয় দর্শকদের কাছে বিষয়টি আর-ও কাছের হয়ে ওঠে।

শিল্পের মাধ্যমে ফনসেকা পশ্চিমা সৌন্দর্য ও শিল্পশৈলীর একচ্ছত্র আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন। গোয়ার জাভিয়ার সেন্টার অব হিস্টোরিকাল রিসার্চের ডিরেক্টর রিনাল্ড ডিসুজা বলেন, “ফনসেকা চেয়েছিলেন খ্রিস্টীয় ধর্মকে – যা সাধারণত পশ্চিমা ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবেই পরিচিত – ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা করতে। এই আশার থেকেই তাঁর জলরঙ চিত্রে খ্রিস্টীয় বিষয়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024