বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:০২ অপরাহ্ন

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক ২০২৫ সালে সুষ্ঠু রাখতে হবে

  • Update Time : শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫, ৫.৫৫ এএম

রিনতারো নিশিমুরা ও জিনওয়ান পার্ক

দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল ২০২৪ সালের মে মাসে সিউলে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে করমর্দন করেন।

রিনতারো নিশিমুরা টোকিও-ভিত্তিক দ্য এশিয়া গ্রুপের একজন সহযোগীযা একটি কৌশলগত পরামর্শক সংস্থা। জিনওয়ান পার্ক প্যাসিফিক ফোরামে জেমস এ. কেলি কোরিয়া ফেলো (ননরেসিডেন্ট)।

মাত্র তিন মাস আগেও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিদ্যমান ঐতিহাসিক টানাপোড়েন (জাপানি উপনিবেশ আমলে কোরিয়ান উপদ্বীপ দখল) অতিক্রম করতে গিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করছিল। যুক্তরাষ্ট্রও খুশি ছিলকারণ তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল।

কিন্তু তারপর থেকেবিশেষত রাজনৈতিক ক্ষেত্রেঅনেক কিছু ঘটেছেযা ইতিবাচক গতি ব্যাহত করতে পারে।

জাপানে গত অক্টোবরের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টি জোট নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পরদেশটি তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি সংখ্যালঘু সরকার পেয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপকারণ রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল সামরিক আইনের ঘোষণা দিয়ে আবার তা প্রত্যাহার করায় তাকে অভিশংসনের মুখে পড়তে হয়েছে। তাছাড়াডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার সূচক।

২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সালের শেষভাগ পর্যন্তসাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাদক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল ও বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়েদুই প্রতিবেশী এশীয় দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে তিনপক্ষীয় সম্পর্কউভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল।

বিশেষ করে ২০২৩ সালের আগস্টে ক্যাম্প ডেভিডে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক তিনপক্ষীয় সম্মেলন ছিল অন্যতম প্রধান সাফল্য। ওই সম্মেলনে নতুন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ব্যবস্থা গঠন করা হয় এবং উত্তর কোরিয়া থেকে প্রযুক্তি ও সাপ্লাই চেইন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিসর বাড়ে।

তিন দেশের সম্পর্কের এই অগ্রগতির পেছনে ছিল জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি। ২০২৩ সালের মার্চে কিশিদা ও ইউন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানি কোম্পানিগুলোতে কোরীয়দের শ্রমে বাধ্য করার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছান। একই সঙ্গে তারা নিয়মিত প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যায়ের আলোচনাও পুনরায় শুরু করেন এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য একটি নতুন কাঠামো চালু করেন।

কিশিদা ও ইউন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিষয়ে যৌথ কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়েও আলোচনা করেন এবং সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পণ্য রপ্তানিতে পাঁচ বছর ধরে চলা বিধিনিষেধ তুলে নেন। এভাবে উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার পথ খুলে যায়।

দ্বিপাক্ষিক সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও একত্রে কাজ করেছে। ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো নিয়মিত বৈঠক করেছেযেখানে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও অগ্রসর প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোতে সহযোগিতার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ জনগণের মধ্যেও পারস্পরিক সম্পর্কে সমর্থন বেড়েছে। জুনে ইয়োমিউরি শিমবুন ও হানকুক ইলবো-এর যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়জাপানে ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পক্ষে মত দিয়েছেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় পরপর দ্বিতীয় বছরের মতো ইতিবাচক মতামত বেড়েছে।

তবে সার্বভৌমত্ব ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রগুলোতে সম্পর্ক এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল বলা যায় না। তবু উভয় দেশেই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে যে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা তাদের নিজ নিজ স্বার্থেই দরকার।

এখন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক সঙ্কট এই অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। গত মাসে জাতীয় পরিষদ প্রেসিডেন্ট ইউনকে অভিশংসিত করায় সিউলে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে এবং সাংবিধানিক আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সম্ভাব্য বসন্তকালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক আপাতত স্থগিত রয়েছে।

অল্প সময়ের জন্য জারি করা সামরিক আইন-সংক্রান্ত বিতর্কের জেরে জাপানের পক্ষ থেকে ইশিবা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেন নাকাতানি দক্ষিণ কোরিয়া সফর বাতিল করেছেন। জাপানে এখন শঙ্কা বেড়েছে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবারও সেই টানাপোড়া সময়ে ফিরে যেতে পারেযেমনটি শিনজো আবের রক্ষণশীল প্রশাসন ও মুন জে-ইনের প্রগতিশীল সরকারের সময়ে ঘটেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাবেন। তবে তিনি অনেক রাজনৈতিক চাপে রয়েছেন। আইনসভার নিয়ন্ত্রণে থাকা বিরোধী দলগুলোর প্রবল চাপ মোকাবিলা করে তাকে প্রশাসনের অর্জনসমূহ রক্ষা ও বিরোধীদের আনা অভ্যন্তরীণ অনেক ইস্যু সামলাতে হচ্ছে।

এছাড়া আগামী সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা। দেশের ভাবমূর্তি ইতোমধ্যে ঝুঁকির মুখেতার ওপর ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরায় দক্ষিণ কোরিয়ান পণ্যে শুল্ক বা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মার্কিন সেনাবাহিনীর বিষয়ে নতুন আলোচনার সম্ভাবনা নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে। ফলে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে পেছনে পড়তে পারে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর অগ্রগতিও ধীর হতে পারে।

আরো জটিল হয়ে উঠছে যেবিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি (ডিপি) যদি আবার ক্ষমতায় আসেতাদের জাপানবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ইউনের তুলনায় অনেক বেশি সন্দেহপ্রবণ। ডিপি ও এর নেতা লি জে-মিয়ং বরাবরই ইউনের জাপানঘেঁষা” নীতির সমালোচনা করে আসছেন। তারা যুক্তি দেয় যে ইউন প্রশাসনের অস্বাভাবিক” জাপানকেন্দ্রিক কূটনীতি উত্তর কোরিয়াচীন ও রাশিয়াকে বিরূপ করে তোলে। প্রথম অভিশংসন প্রস্তাবে তারা এই ইস্যুটি তুলে ধরলেও দ্বিতীয় প্রস্তাব থেকে তা সরিয়ে নেয়।

লি জে-মিয়ংয়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটা তার চলমান মামলা-মোকদ্দমার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে। তবু তাদের যদি আবার ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ আসেতাহলে যুদ্ধকালীন শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত কিশিদা-ইউন চুক্তি ও অন্যান্য ঐতিহাসিক বিষয়ে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া সমঝোতা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলে প্রযুক্তি-নির্ভর গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা থাকলেও বেসরকারি খাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রয়েছে। বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে দক্ষ জনবলের প্রতিযোগিতা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াতে পারে।

আগামী বছরে সরকারি পর্যায়ে সম্পর্ক খারাপ হলে ওইসব গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০১৯ সালে যে ধরনের পারস্পরিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও ট্রেড ওয়াইট লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলসেরকম পরিস্থিতি আবার দেখা যেতে পারে।

এভাবে সামনে অনেক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেওউভয় দেশেই এখন সম্পর্ক সংহত রাখার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। যত বাধাবিঘ্নই থাকুকআমাদের মনে রাখতে হবেজাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্বার্থ ও উদ্বেগ ক্রমশ মিলিত হচ্ছে। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটেদুই দেশের সহযোগিতার গুরুত্ব অনেক।

২০২৫ সালে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ৬০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। এই দীর্ঘও প্রায়ই বন্ধুরযাত্রায় এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। আজকের নেতৃবৃন্দকে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার ইতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরতে হবেযাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া যায় এবং তারা অতীতের শৃঙ্খলে আটকে না থাকে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024