মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
নেপালে জন্ম নেয়া অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা নেপালি মুভিতে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ভারতের বলিউড ও দক্ষিণী মুভিতে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৪২: এ লাভ স্টোরি, বোম্বে, দিল সে, আকেলে হাম আকেলে তুম, মান, অগ্নিস্বাক্ষী, গুপ্ত তার কয়েকটি জনপ্রিয় মুভি। বলা হয় তার সমসাময়িক অন্যতম সুন্দরী অভিনেত্রী তিনি। কিন্তু ভুল জীবনদৃষ্টি তার যাপিত জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন নিজ স্বাস্থ্য ও ক্যারিয়ারকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। একের পর এক ফ্লপ মুভি, ফেসবুকের পরিচয়ে বিয়ে – অল্প দিনেই বিবাহিত সংসারে ভাঙ্গন এবং ওভারিতে ক্যান্সার ধরা পড়ায় আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ভাবে তিনি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েন। কিন্তু এক সময়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মনকে তৈরি করেন। নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা তাকে আরো সাহস জোগায়। প্রায় পাঁচ বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে মনীষা জিতেছেন। নিজেকে একজন ‘ক্যান্সার ক্রুসেডার’হিসাবে বর্ণনা করেন তিনি। সম্প্রতি অভিনয়ের পাশাপাশি মনীষা ছবি আঁকছেন। সব কিছু ছাপিয়ে নিজেকে অনেক বেশি মানবসেবায় নিয়োজিত করেছেন এই অভিনেত্রী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে অনুপ্রাণিত করছেন তার জীবন যুদ্ধের কাহিনী শুনিয়ে। ঢাকা লিট ফেস্টেও তিনি ঘুরে গিয়েছেন। মনীষার জীবন সংগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেয়া তার নানান বক্তৃতা, ইন্টারভিউর ওপর ভিত্তি করে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
জীবনের এমন কিছু ঘটনা হঠাৎ ঘটে যায় যা পুরো চেনা পরিবেশকেই বদলে দেয়। ২০-২৫ বছর আগের কথা। আমি এমন একটি জীবন কাটাতাম যা অনেকের কাছেই ছিল স্বপ্নের মতো। আমি একজন অসাধারণ ও সবার সেরা অভিনেত্রী হতে চাইতাম। আমি জন্মসূত্রে নেপালি। সময়ের বিবর্তনে আমি ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একজন সফল ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসাবে জায়গা করে নিয়েছি। পাঁচটি ভাষায় প্রায় ৮০টি মুভিতে আমি অভিনয় করেছি। সত্যি বলতে কী, এর মধ্যে কিছু ভালো মুভি অন্যগুলো কেবল সংখ্যা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি।
স্বপ্নে যা দেখতাম তারচেয়েও অনেক বেশি পেয়েছি। আমি যখন বাঁধনহারা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন জীবন আমাকে নিয়ে অন্য পরিকল্পনা করছে। এমন এক ঝড় জীবনে এসে পড়লো যা আমার স্বপ্নের জগতকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমি আমার সব কিছুই হারাতে শুরু করলাম।
শুরুতে এই ঝড় এলো নীরবে। আমি একটি খারাপ মুভিতে চুক্তি করলাম যা ফ্লপ করলো। আমি খারাপ সমালোচনার মুখে পড়লাম। এরপর আবার, আবার এবং আবার। একের পর এক নিজের ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে এমন সব খারাপ মুভিতে চুক্তিবদ্ধ করালো যা আমার ক্যারিয়ারে প্রবল ঝাঁকুনি দিলো। কিন্তু তারপরও আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। আমি ভাবলাম আমার কাছে কিছু ভালো মুভি পরিচালকের প্রস্তাব আছে। যাতে অভিনয় করে আবার আমার আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারবো। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না।
আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার এই জীবনধারা আমাকে অনেক খারাপ সঙ্গ জুটিয়ে দিলো। বিরতিহীন ভাবে আমি একের পর এক বাজে সম্পর্ক তৈরি করলাম। আমি এক অশান্তিময় এলোমেলো জীবনে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। এক পর্যায়ে আমি সবখানে প্রত্যাখ্যাত হতে লাগলাম। এর মধ্যে আমি একবারেরই ভেঙ্গে পড়লাম যখন অল্পদিনেই আমার সংসারটিও হারালাম। যদিও আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সন্তানের মা হতে। বিষণœ সময়ে আমার শরীর খারাপ অনুভব করতাম। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম ক্যান্সার আমার দেহে বাসা বেঁধেছে। যা দিনে দিনে গুরুতর আকার ধারণ করছিল।
কাঠমান্ডুতে প্রথম যখন ক্যান্সার ধরা পড়ার খবরটি পেলাম আমি তা বিশ্বাস করতে পারি নি। এধরনের কিছু আমাকে আঘাত করতে পারে তা আমার চিন্তাতেও আসে নি। যদিও আমার পরিবারে ক্যান্সার ছিল। ফলে বিষয়টি বিস্ময়কর ছিল না। কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না। আমার জ্বরের মতো অনুভূতি হচ্ছিল এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। আমি নিয়মিত জিমে যাচ্ছিলাম কিন্তু আমার ওজন কেবল কমছিল। আমি ভাবছিলাম আমার হয়তো বয়সজনিত ক্লান্তি কাজ করছে।
মুম্বাইয়ে আবার পরীক্ষা করালাম। জ্যাসলোক হসপিটালের ডা. সুরেশ আদভানি মৃদুকণ্ঠে আমাকে যখন জানালেন যে আমার ক্যান্সার বেশ অ্যাডভান্স লেভেলের তখন তিনি মাথা নিচু করে রেখেছিলেন। আমার মা আমাকে দ্রুত আমেরিকার নিউ ইয়র্কে স্লোয়ান ক্যাটেরিং হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সবার সহযোগিতায় সব কিছু দ্রুত হয়। আমার মনে হয়েছে আমেরিকা এবং ভারতে ক্যান্সার চিকিৎসার ধরন প্রায় একই। শুধু আমাদের এখানে ভয়টা বেশি কাজ করে।
আমাকে প্রচুর ওষুধ খেতে হতো । যা আমি খেতে চাইতাম না। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতাম যখন আমাকে নিউপোজেন ইনজেকশনটি দেয়া হতো। এটি আমার শ্বেত রক্তকণিকা সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করতো। ব্যথায় অস্থির হয়ে মাকে বলতাম, ‘এতো কষ্টের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’ মা ধমক দিয়ে বলতেন, ‘বাজে বকো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ক্যান্সারের কারণে আমার মাথার সব চুল পড়ে গেল। মাথার চুল যে ঝরে যাবে তা জানতাম। কিন্তু নিজেকে দেখতে কেমন লাগবে, তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। কেমোথেরাপির পর আমার মাথার চুল, ভ্রু, চোখের পাতার লোম ঝরে গিয়েছিল। আয়নায় যখন নিজেকে দেখতাম তখন নিজেকে এলিয়েনের মতো মনে হতো।
গ্ল্যামার জগতের জনপ্রিয় নায়িকার জন্য এটা কতো বড় কষ্টের বিষয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে বিষয়টা শুধু অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো না। যখন নিওরো নানা সমস্যার পাশাপাশি আমার হার্টের স্থায়ী ক্ষতি, কান চিরস্থায়ী ভাবে নষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিলো তখন আমার জীবনটা দুলে উঠলো। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম। সত্যিকারের ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এতো ভয় যা আমি কখনো পাই নি।
আমি আমার দিনগুলোকে জীবনের শেষদিন মনে করতে লাগলাম এবং ভয়ঙ্কর ও অজানা মৃত্যুভয় আমাকে আক্রান্ত করে ফেললো। যখন তীব্র মৃত্যুভীতি আমাকে আঁকড়ে ধরলো তখন আমার মনে প্রশ্ন এলো, যদি সত্যিই আমার জীবনের দিনগুলো শেষ হয়ে আসে তাহলে যে জীবন আমি কাটিয়েছি তা নিয়ে কি আমি গর্বিত হবো? আমার মনে উত্তর পেলাম, অবশ্যই না। আমি নিজেই আমার জীবনকে নষ্ট করেছি। আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন কাটিয়েছি। আমার স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ার কোনো কিছুর দিকেই লক্ষ রাখি নি। এমন কী যে মানুষগুলো আমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছে তাদের দিকে ফিরেও তাকাই নি।
আমার অসুখের মধ্য দিয়ে আমি মৃত্যুকে প্রায় ছুঁয়ে দেখেছি। এই বিষয়টি আমার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এখন প্রতিটি সূর্যাস্ত, প্রতিটি হ্যান্ডশেক আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের কঠিন দিনগুলোই আমাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দান করেছে। এজন্য কঠিন দিনগুলোর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
রোগমুক্তির কয়েকটি দিক আছে। স্বাস্থ্যকর খাবার ও ব্যায়াম। আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে রোগের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। ওয়াননেস ইউনিভার্সিটিতে আমি মেডিটেশনের কোর্স করেছিলাম। যা আমাকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে সাহায্য করেছে। আমার পরিবার দমচর্চা এবং মেডিটেশনের উপকারিতায় বিশ্বাসী। আমার অসুখের সময় এই বিষয়ে তারা সহযোগিতা করে। এসময়ের একটি কথা অবশ্যই বলতে হবে। ওয়াননেস ইউনিভার্সিটির মেডিটেশনের গুরু নামানজী আমাকে সব সময়ই প্রেরণামূলক কথা বলতেন। শুরুতে আমি যখন মৃত্যুভয়ে তীব্র আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছি তখন তিনি স্কাইপিতে কথা বলেন।
গুরু আমার কাছে জানতে চান, ‘তুমি কিসের ভয় পাচ্ছো?’
আমি সংক্ষেপে উত্তর দিই, ‘মৃত্যুর।’
তিনি জানতে চান, ‘মৃত্যু কী তুমি জানো?’
উত্তর দিলাম, ‘আমি জানি না।’
‘যা সম্পর্কে কিছুই জানো না, তাকে নিয়ে এতো ভয় কিসের তোমার!’
গুরুর এই একটি কথা আমার চিন্তার জগত বদলে দিলো। আমার মন ও চিন্তাকে অনুসরণ করতে বললেন তিনি। ক্যান্সারের সময় প্রতিদিন আমাকে ভয় তাড়া করে বেড়াতো কিন্তু আমি তার মুখোমুখি হয়েছি। আমি ক্যান্সার জয় করতে চেয়েছি। আমি জীবনকে ছেড়ে দেয়ার বদলে জীবনে জয়ী হতে চেয়েছি।
পরিবারের পরামর্শে অনেক কষ্ট হলেও আমি প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হেঁটেছি। এটা হসপিটালের রুমে হোক বা করিডোরে। বাবা আমাকে সঙ্গ দিতেন। এই শারীরিক পরিশ্রম আমাকে সাহস জুগিয়েছে। এক সময় আমি বাইরে হাঁটা শুরু করলাম। একজন নারী যার মাথায় কোনো চুল নেই, চোখে ভ্রু নেই -তার দিকে মানুষ কীভাবে তাকাবে ভাবতে অস্বস্তি লাগতো। কিন্তু যখন বের হলাম তখন দেখলাম কিছু বিস্ময় ভরা মুখ আমার দিকে তাকালেও বিষয়টি আমার মধ্যে তেমন কোনো কাজ করছে না। কারণ আমার মনে হলো, একমাত্র ব্যক্তিটি হচ্ছি আমি নিজে, যে আমার চেহারা নিয়ে চিন্তিত। অন্য কেউ নয়। তাই আমি আমার কাজ করে যেতে লাগলাম।
ক্যান্সার থেকে পুরো মুক্ত হতে আমার সাড়ে চার বছর লেগেছে। প্রভু আমার ওপর দয়া করেছেন। আমাকে আবার একটা নতুন জীবন দান করেছেন। এখন এমন একটি দিন যায় না, যেদিন আমি মনে করি না যে আমি মরতে বসেছিলাম। এখন প্রতিটি দিন আমার শুরু হয় শপথের মধ্য দিয়ে এবং আমি মনে করি এই জীবন আমার প্রভুর দেওয়া উপহার। জীবনের কয়েকটি জিনিসকে আমি বেশি গুরুত্ব দিতে শিখেছি। এগুলোকে আমি জীবনের উপহার মনে করি। এর প্রথমটিই হলো সুস্বাস্থ্য। আমি সুস্থ দেহের গুরুত্ব উপলব্ধি করি যখন ক্যানসারে ডুবে ছিলাম। এখন নিয়মিত শরীরের যতœ নিই। বিভিন্ন ভাবে খোঁজ নিয়ে, বই পড়ে আমি আমার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার চেষ্টা করছি।
পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন অনেক বেশি আন্তরিক, বিশ^স্ত, মমতাময় ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। কারণ পরিবারের সদস্যরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে সহযোগিতা করে এসেছেন, পাশে থেকেছেন। আমি দেখতাম আমার বাবা, মা, ভাই অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমার সময় কাটতে লাগলো বেশি। আমি যেন আমার ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম।
বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে আমার ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এক সময় লাগামছাড়া বিশাল সংখ্যক বন্ধু আমার ছিল। এখন আমি অনুভব করি কেবল যার সঙ্গে গভীর মানসিক বন্ধন আছে কেবল তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করি। এটা সত্য যে, আমার মন খারাপ হয়েছিল যখন দুঃসময়ে অনেক বন্ধুকে কাছে চেয়েছিলাম কিন্তু তাদের একবারেই দেখা পাই নি। একই সঙ্গে আমার মনে প্রশ্ন জন্মালো, ‘আমি কি তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছি? বা তাদের প্রয়োজনে একই আচরণ করেছি?’ এই ভাবনাটি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আমার পদ্ধতি বদলে দেয়। আমি তাদের খারাপ সময়ে পাশে থাকার কথা ভাবি। অধিকার ও আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে পারি, ‘তোমার প্রয়োজনে আমি রাত বারোটার সময়ও হাজির হতে রাজি আছি।’ আপনার জীবনে ২০,০০০ বন্ধুর প্রয়োজন নেই, দুই তিনজন প্রকৃত বন্ধু থাকলেই যথেষ্ট যারা প্রয়োজনে কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়াবে।
কাজের ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি আমি একজন অভিনয়শিল্পী। এটাই আমার শক্তি। তাই শিল্পী হিসাবে গড়ে উঠতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই, যেন আমি কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারি। এখন আমি অনেক সতর্কতার সঙ্গে মুভির চরিত্র বাছাই করি। আগের মতো বাছবিচার ছাড়া কোনো কাজ এখন করি না।
আমার এই কঠিন সময়ে আমি আরেকটি বাক্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তা হলো নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার গুরুত্ব। এ বিষয়ে একটি ঘটনার কথা বলতে হয়। যখন আমেরিকার হসপিটালে আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শুয়ে থাকতাম। তখন খুব বেশি মানুষ আমাকে দেখতে আসতেন না। একজন ভদ্রমহিলা প্রতি রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে আমার কাছে আসতেন। হসপিটালের একটি সাধারণ চেয়ারে তিনি সারাদিন আমার মাথার কাছে বসে থাকতেন। তিনি একজন ডাক্তার, নিউ ইয়র্কের কর্নেল হসপিটালের প্যাথলজিস্ট। তার নাম ডা. নবনীত নারুলা। আমি জানতাম তিনি খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। একদিন কৌতুহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, ‘আপনার সঙ্গে আগে আমার কোনো বন্ধুত্ব ছিল না। এমন কি আপনি যে আমার অভিনয়ের ভক্ত সেটাও মনে হয় নি। তাহলে আমার জন্য আপনার মূল্যবান সময় কেন ব্যয় করছেন?’
তিনি খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, ‘মনীষাজী, আমি আজ যেটা করছি, সেটা একদিন আপনিও অন্যের জন্য করবেন- এটাই আমার প্রত্যাশা।’
তার কথা আমার মনে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। তখন শপথ করি যদি আমি ক্যান্সার থেকে বেঁচে উঠি এবং দ্বিতীয় জীবনের সুযোগ পাই তবে আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেবা করার চেষ্টা করবো। তার পরিমাণ কম না বেশি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাই যখন নেপালে ভূমিকম্প হলো, আমি সেখানে ছুটে গিয়েছি। ইউএনএফপিআর-এর উদ্যোগে সেখানে একটি ক্যাম্পেইন করি ‘ডিগনিটি ফার্স্ট’ নামে। আমি দুর্গম এলাকায় গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব, তাদের অধিকার এবং বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রচারণা চালাই। এর বাইরে একজন ক্যান্সার সারভাইভার হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমি অসংখ্য ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলি। কাজ করি। তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি ক্যান্সার কোনো মৃত্যুদণ্ড নয়, ক্যান্সারের বাইরেও জীবন আছে। এছাড়া যে কোনো বিষয় নিয়ে আমার কোনো বন্ধু বা অন্য কেউ পরামর্শ চাইলে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি। আমি নিজেকে একজন ক্যান্সার ক্রুসেডার হিসাবে অভিহিত করি। এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গি। ক্যান্সার জীবনের অংশ ছিল। কিন্তু এটিই আমার পুরো জীবন নয়।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অনেক অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। আমার নাম যশ খ্যাতি, গ্ল্যামার জগৎ, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া, ভয় জন্ম দেয়া কেমোথেরাপি এবং মৃত্যুভীতি আমার মধ্যে গভীর ভাবনার সৃষ্টি দেয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়সহ সব মিলিয়ে নতুন জীবনবোধ উপলব্ধি করতে পারি। এর মধ্য দিয়ে আমি জীবনের কিছু সত্য খুঁজে পেয়েছি।
এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, এই জীবন হলো একটি উপহার। এটা সত্যিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। জীবনে যা ঘটে যায় সবই এই উপহারের অংশ। আমাদের সুস্থতা একটি উপহার। এর প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। জীবন চলার পথে যে মানুষগুলো হেঁটে যান তারাও আমাদের জন্য উপহার।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, নিজেকে চেনার চেষ্টা। আমাদের নিজের গভীরে ডুব দিতে হবে। কোনটা আমার জন্য ভালো সেটা বের করতে হবে। আমাদের জীবন অনেক ক্ষণস্থায়ী, তাই যতোটা সম্ভব একে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের সব সময় চেষ্টা করতে হবে কীভাবে জীবনকে আরো বেশি অর্থবহ করা যায়। এজন্য প্রতিদিন আমাদের দান (চ্যারিটি) করা এবং এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে।
তিন নাম্বার হলো, জীবন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি যাই থাক না কেন, আমাদের জীবনে সারপ্রাইজ বা বিস্ময়কর বা কিছু ঘটবেই। জীবন হঠাৎ করেই আমাদের এমন এক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয় যার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত থাকি না। তবে এসব পরিস্থিতিতে আমাদের স্থির হয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে হবে। এমন হতে পারে আমরা সেই সমস্যায় ডুবে যেতে পারি। আমাদের জীবনের চেয়েও সমস্যাকে বড় করে তুলতে পারি। আবার এর বিপরীতে পুরো বিষয়টিকে আমাদের এক নতুন সম্ভাবনার প্ল্যাটফরম হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। কারণ জীবনে আমরা যে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করি তার প্রতিটির মধ্যেই কোনো না কোনো শিক্ষা থাকে। কোনো না কোনো বার্তা থাকে। আমরা জীবনের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটিকেও বদলে দিতে পারি প্রজ্ঞা ও সাহসের সঙ্গে, যে শক্তি আমাদের মাঝেই সুপ্ত আছে।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply