বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৫ অপরাহ্ন

চায়না ও যুক্তরাষ্ট্র:  আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে জানুন, নিজেকেও জানুন

  • Update Time : শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২৫, ৯.০০ পিএম

জুড ব্ল্যানচেট এবং রায়ান হ্যাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতৃত্বের আসনে বসার পর থেকে আমেরিকান নেতারা নিয়মিতভাবে উদ্বেগে ভোগেন যে দেশটি পতনের মুখে এবং কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পিছু হটছে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এমনই উদ্বেগ তৈরি করেছিলযেমনটি করেছিল ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত সম্প্রসারণবাদ। ১৯৮০-র দশকে ওয়াশিংটনে এই আশঙ্কা ছড়িয়েছিল যে জাপানের অর্থনৈতিক মহাশক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা মার্কিন শিল্পের সাধ্যের বাইরে। এমনকি ১৯৯২ সালেওযে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সদ্য পতন হয়েছেহার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল: আমেরিকা কি পতনের দিকে যাচ্ছে?”

আজকের দিনেএই পতনের উপলব্ধি যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন করে উন্মোচিত দুর্বলতার ভয় এবং চীনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার বিষয়ে উৎকণ্ঠার সঙ্গে। উভয় উদ্বেগই অবশ্যই পুরোপুরি অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা তাদের গণতন্ত্রের প্রতি হুমকির উৎস নিয়ে একমত না হলেওএকটি ব্যাপারে তারা বেশ মিলিতদেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আর আগের মতো আমেরিকান স্বপ্ন”-এর প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারছে না। ২০২৪ সালের অক্টোবরে গ্যালাপের করা এক জনমত জরিপে দেখা গেছেচার-পঞ্চমাংশ আমেরিকান তাদের দেশের বর্তমান গতিপথ নিয়ে অসন্তুষ্ট।

অন্যদিকে অনেকের ধারণাচীন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিরাট এক উদ্দীপনা নিয়েতাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক লক্ষ্য উঁচুসামরিক খাতের সম্প্রসারণও বিশালআর যুক্তরাষ্ট্র যেন নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত: অসমতামজুরি-স্থবিরতাআইনসভায় অচলাবস্থারাজনৈতিক মেরুকরণ ও জনতাবাদ (পপুলিজম)। সত্যিই গত তিন দশকে চীন বিশ্ব-কারখানার মর্যাদা পেয়েছে এবং কিছু অগ্রসর প্রযুক্তি খাতেও নেতৃত্ব দখল করেছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে তৈরি হওয়া মোট ইলেকট্রিক গাড়ির প্রায় ৬০ শতাংশই চীনে তৈরিব্যাটারির ৮০ শতাংশ ও সৌরশক্তি প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ওয়েফারের ৯৫ শতাংশের বেশি চীন উৎপাদন করেছে। একই বছরে তারা তাদের বিদ্যুৎ-গ্রিডে ৩০০ গিগাওয়াট পवन ও সৌরশক্তি যুক্ত করেছেযা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সাত গুণ বেশি। এ ছাড়াবৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের খনি ও পরিশোধন প্রক্রিয়ার বড় অংশই চীনের দখলেএবং বিশ্বের অন্যতম আধুনিক অবকাঠামোও তাদের রয়েছেবিশাল হাই-স্পিড রেল নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে আধুনিক ৫জি ব্যবস্থা পর্যন্ত।

যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্প চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেতখন চীন নজিরবিহীন গতিতে সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। গত তিন বছরে তারা ৪০০-র বেশি আধুনিক ফাইটার জেট তৈরি করেছেনতুন স্টেলথ বোমার উদ্ভাবন করেছেহাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি প্রদর্শন করেছেআর তাদের মিসাইল মজুদও দ্বিগুণ করেছে। সামরিক বিশ্লেষক সেথ জোনস অনুমান করেছেনযুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীন এখন পাঁচ থেকে ছয় গুণ দ্রুত গতিতে অস্ত্র মজুত করছে।

অনেক পর্যবেক্ষক তাই মনে করেনএকবিংশ শতাব্দীর চাহিদা পূরণে চীনের সরকারব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কার্যকর। চীনা নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, “পূর্ব উঠছে এবং পশ্চিম নামছে”; কিছু মার্কিন নেতা যেন এখন সেটাকেই অনিবার্য ভবিষ্যদ্বাণী বলে মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু এত সহজে এমন সার্বিক উপসংহার টানা এক বড় ধরনের ভুল হবে। চীনের অগ্রগতি ও ক্ষমতা নিঃসন্দেহে বিশাল। কিন্তু তাদের ভারসাম্যপত্রে (ব্যালান্স শিট) নেতিবাচক দিকও আছেএগুলো পর্যালোচনা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা বোঝা অসম্ভব। সবচেয়ে প্রবল ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও অদৃশ্য দুর্বলতা থাকেপ্রতিপক্ষের শক্তি যেমন বিচার করা জরুরিতেমনি বিচার করা দরকার তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলোও।

এটাও সত্য যে চীন বৈশ্বিক পরিসরে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু তারা ক্রমেই জটিল এক সমস্যার জালে জড়াচ্ছেযা তাদের বিকাশকে নানা দিক থেকে কঠিন করে তুলবে। এক দশক ধরে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পরচীনের অর্থনীতিকে এখন নানামুখী চাপে পড়তে হয়েছে: টালমাটাল আবাসন খাতবাড়তে থাকা ঋণের বোঝাস্থানীয় সরকারের ভাঙাচোরা অর্থনীতিকমে যাওয়া উৎপাদনশীলতাআর দ্রুত বয়স্ক হয়ে ওঠা জনসংখ্যাএসবই কঠিন সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনকে সামলাতে হচ্ছে আঞ্চলিক সামরিক উত্তেজনা এবং উন্নত অর্থনীতিগুলোর পক্ষ থেকে বাড়তি নজরদারি আর প্রতিরোধ। ফলে গত দুই দশকে চীনের অভাবনীয় উত্থানের পেছনে যে ভিত্তিগুলো কাজ করেছিলতার অনেকটাই আলগা হয়ে আসছে। অথচ এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলো সামলাতে যেখানে দরকার ছিল চটপটে ও সতর্ক নীতিসেখানে চীনের নেতা শি জিনপিং ক্ষমতা পোক্ত করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক দমন করেছেনবিশেষজ্ঞদের পেছনে ঠেলে দিয়েছেন এবং একটি ভঙ্গুরপ্রতিক্রিয়াশীল ও ত্রুটিপূর্ণ নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন। চীনের তরুণদের অনেকে এখন হতাশ হয়ে বলছেতারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জায়গা পাচ্ছে না। দেশটির নেতৃত্বে পরিবর্তন না এলে এই প্রবণতার বদল ঘটার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু সেই নেতৃত্ব পরিবর্তন যে অদূর ভবিষ্যতে আসবেতার ইঙ্গিতও খুব কম।

যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীনের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ঐতিহ্যগত স্বত্ব বজায় রেখেছে। সকল সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেওযুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন কিছু কৌশলগত গভীরতা (স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ) আছে যা চীনের নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়এক অনন্য সংমিশ্রণ: শক্তিশালী অর্থনীতিবৈশ্বিক সামরিক শ্রেষ্ঠত্বঅসাধারণ মানবসম্পদআর একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা ভুল-শুদ্ধি শোধরানোর পথকে সহজ করে। লচকদার ও অভিযোজিত মার্কিন অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে গভীর ও তরল মূলধন বাজার (ক্যাপিটাল মার্কেট) পরিচালনা করে এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ওপর এর অসাধারণ প্রভাব আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সেরা মেধাকে আকর্ষণ করেযার মধ্যে অনেক চীনা নাগরিকও রয়েছেযারা চীনের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিচ্ছেন।

সরাসরি বলতে গেলেঅর্থনৈতিক গতিশীলতাবৈশ্বিক প্রভাব ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীনের তুলনায় স্পষ্ট একটি অগ্রাধিকার ধরে রেখেছে। এটি কোনো উল্লম্ফন বা আত্মতৃপ্তি নয়বরং সঠিক কৌশলের ভিত্তি। কারণ অতিরিক্ত হতাশা বা ভীতি যদি যুক্তরাষ্ট্রের মনোবল নষ্ট করে দেয়লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করে তোলে বা জাতিবাদী আর সুরক্ষাবাদী (প্রোটেকশনিস্ট) ঝোঁককে বাড়ায়তাহলে বাইরের বিশ্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর চীনের সমস্যাসত্ত্বেও সে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেযেমন কোয়ান্টাম কম্পিউটিংনবায়নযোগ্য জ্বালানিআর ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনযা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য হুমকি। চীনের মতো একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার বহুমুখী দুর্বলতা সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

চীন সাধারণত সেই সব খাতে শীর্ষস্থান দখল করেযেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের ঘাটতি আছে। চীনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো কোনো লক্ষ্য অর্জনে তার হাইপারফোকাস’ এবং বিশাল সম্পদ বিনিয়োগ ও অপচয় সহ্য করার মানসিকতা। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ যে খাতগুলোসেগুলো থেকে ওয়াশিংটন আর পিছু হটে থাকার সুযোগ পাবে নাযেমনটা ৫জি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল গত দশকে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় মূলত আমেরিকা পতনের পথে” এই আশঙ্কাকে ভর করেই বক্তব্য দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নিজের নানা সমস্যায় ভুগছেবহির্বিশ্বে ও অভ্যন্তরেকিন্তু চীনের সমস্যাগুলো তার চেয়েও বড়। আর প্রতিপক্ষের শক্তিকে নিয়ে বরাবর বাড়াবাড়ি করার যে প্রবণতাতা বরং মার্কিন নীতিনির্ধারকদের বারবার ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। অতীত ইতিহাস বোঝা জরুরিএবং এমন বিষয়ও মনে রাখা দরকার যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল ভঙ্গিমা নিয়ে চীনের পেছনে ছুটলে বরং খরচ বাড়েযেখানে যুক্তরাষ্ট্রের যা যা তুলনামূলক সুবিধা আছেসেগুলো কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারতবিশেষ করে এমন সময়ে যখন বেইজিং নিজেই অস্বস্তিতে।

আত্মবিশ্বাসের খেলা গত শতাব্দীজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তি বাড়িয়ে দেখে এবং নিজের শক্তি খাটো করে দেখে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এটা ছিল বিশেষভাবে স্পষ্ট। মার্কিন কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক ক্ষমতায়প্রযুক্তিতে আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাবের দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে। যেমন১৯৫০-এর দশকের শেষ ভাগে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে প্রচুর পরিমাণে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছেযা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি উন্নতও বটে। পরে ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানের তথ্যসহ অন্য সূত্রে জানা গেলএই কথিত মিসাইল গ্যাপ’ আসলে প্রধানত কল্পিত ছিল। আর ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বেরিয়ে এলো সোভিয়েত অর্থনীতি ব্যাপক সামরিক ব্যয়ের চাপে ভেঙে পড়ছিলএবং যেসব সোভিয়েত শ্রেষ্ঠত্বকে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এত ভয় পেয়েছিলেনতার বড় অংশ ছিল অতিরঞ্জিত বা ভুল ব্যাখ্যার ফল।

যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি খাটো করে দেখার প্রবণতা আংশিকভাবে আসে গণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য থেকে। গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা অপেক্ষাকৃত বেশিতাই এ ধরনের ব্যবস্থায় নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। এতে করে ঘরোয়া সমস্যাগুলোকে অতিরিক্ত গুরুতর মনে হতে পারে। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমিয়ে রাখে ও প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেফলে বাস্তবের চেয়ে তারা নিজেদেরকে অনেক বেশি শক্তিশালী হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ করে আর সংবাদ সেন্সর করে নিজেদের অজেয় ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিল। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থবিরতারাজনৈতিক দ্বন্দ্বআর উদ্ভাবনের অনুপস্থিতি ঢেকে রাখতে গিয়ে তাদের প্রচেষ্টা অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদেরও বিভ্রান্ত করেছেঅন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্ব-আলোচনা ও আত্মসমালোচনার প্রবণতা তার নিজের শক্তিশালী দিকগুলোকে আড়াল করেছে।

কখনো কখনো এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের উপকারেও আসে। প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুপক্ষের উত্থানের আশঙ্কা আমেরিকান সম্পদ ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়: যেমনসোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আছেএমন (ভুল) ধারণা সত্ত্বেও এটি মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে ও প্রযুক্তি গবেষণা ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল। কিছুটা ভুল ধারণা থাকলেওতুলনামূলক অগ্রগামী অবস্থান ধরে রাখতে এই আশঙ্কা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। একইভাবে মহাকাশ প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েতদের সাফল্যএবং যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে এই আতঙ্কমার্কিন সরকারকে নাসা গড়ে তুলতেদেশটির স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষা জোরদার করতে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অর্থায়ন বাড়াতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এতে বরং পরবর্তী অর্ধ শতকজুড়ে আমেরিকার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল।

প্রতিপক্ষকে অবমূল্যায়ন করারও ঝুঁকি আছেযেমনটা দেখা গেছে ১৯৩০-এর দশকে নাৎসি জার্মানির উত্থান১৯৯০-এর দশকে আল-কায়েদার বিকাশআর ২০২২ সালে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে করা অবমূল্যায়নের ক্ষেত্রে। এসব ভুলের ফলে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়তা অনেককেই মনে করায় যে প্রতিপক্ষকে বাড়িয়ে দেখা হয়তো নিরাপদ। কিন্তু অনেক উদাহরণই দেখায়কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে অতি বড় করে দেখা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সম্পদের অপচয়ের দিকে ঠেলে দেয়আত্মশক্তি জোরদারের দিকে নজর কমিয়ে দেয়গৌণ হুমকিতে অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়এমনকি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে জড়িয়েও ফেলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক ও মানবিক সম্পদ ব্যয় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সেই কথিত ডোমিনো থিয়োরির ভিত্তিতেযেখানে ধারণা ছিলযুক্তরাষ্ট্র যদি সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিজমকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থামাতে না পারেতবে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট বিস্তার ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলাফল হিসেবেযুক্তরাষ্ট্র এক দীর্ঘব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যা প্রায়ই তার সম্পদ নিঃশেষ করে দেয়বৈশ্বিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং আমেরিকানদের মধ্যে নিজেদের সরকারের ওপর আস্থা নষ্ট করে। কয়েক দশক পরেআরেকটি অতিরঞ্জিত হুমকিইরাকের সাদ্দাম হোসেনদুর্বলভাবে মূল্যায়ন করে সেখানে অনাবশ্যক দীর্ঘ যুদ্ধ ও দেশীয় অস্থিরতা ডেকে আনেএবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শত্রুপক্ষের শক্তিকে সামনে রেখে ঘরোয়া কাজ গুছিয়ে নেওয়াএমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একাধারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকেসম্ভবত শত্রুপক্ষের অগ্রসরতা বা ক্ষমতার আশঙ্কা দেশকে উদ্বুদ্ধ করে সম্পদ জোগাতেউদ্ভাবন চালিয়ে যেতে এবং ঐক্যবদ্ধ হতেযেমনটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মহাকাশ প্রতিযোগিতায় দেখা গেছে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষমতা সামান্য অতিরঞ্জন করা যদি সৃজনশীল উদ্যোগ ও বিনিয়োগ বাড়ায়তাহলে সেটি কাজে লাগতে পারে। কিন্তু যখন এই মূল্যায়ন অতিমাত্রায় ভয়-ভীতির জন্ম দেয়তখন তা সরকারকে সম্পদ ভুল পথে ব্যয় করতে বাধ্য করতে পারেঅন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারেএমনকি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের ঝুঁকিও বাড়ায়। কাজেই প্রতিপক্ষের সক্ষমতা মূল্যায়নে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই জরুরিযাতে প্রতিক্রিয়া কার্যকর হয়কিন্তু আতঙ্ক বা অদূরদর্শী প্রতিশোধপরায়ণতার দিকে না যায়।

সবই যে সোনা নয় আজকের দিনে অনেক আমেরিকানের আশঙ্কাচীন শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। উপরন্তু বিভিন্ন খাতেহাইপারসনিক মিসাইল থেকে জাহাজ নির্মাণ পর্যন্তচীন আজ শক্তিশালী বা প্রায়শই শীর্ষস্থানীয়। এটা তাদের রাষ্ট্র-চালিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মডেলের সক্ষমতাকেই যেন তুলে ধরেযেখানে বড় কাজ করতে শক্তি কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব,” যেমনটি দেং শিয়াওপিং বলেছিলেন।

তবে চীনের এই ক্ষমতার ভিত্তি অনেক দিক থেকেই চাপে রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছেবিশেষ করে গত পাঁচ বছরে কিছু কাঠামোগত সমস্যাও প্রকট হয়েছে। আবাসন খাতযা এতদিন চীনের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলএক অভূতপূর্ব ধসের মুখে। ২০২৪ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব করে দেখেপ্রায় অর্ধেক চীনা সম্পদ উন্নয়নকারী (ডেভেলপার) দেউলিয়া হওয়ার পথে। এর পেছনে অন্যতম কারণ বাড়ির দাম লাগাতার পড়ে যাওয়াযা ২০২৪ সালের অক্টোবর নাগাদ ২০১৫ সালের পর সবচেয়ে দ্রুতগতিতে কমেছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকারচীনে ৭০ শতাংশের বেশি পারিবারিক সম্পদ বাসাবাড়ির সঙ্গেই যুক্তফলে আবাসন খাতে মূল্যহ্রাস শুধু ডেভেলপারদেরই নয়সাধারণ মানুষেরও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

এই আবাসন সংকট স্থানীয় সরকারগুলোর অর্থনীতিকেও টেনে নামাচ্ছে। ভূমি বিক্রি করে তারা এতদিন বড় ধরনের রাজস্ব তুলতযা সামাজিক পরিষেবা ও অবকাঠামোয় বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হতো। এখন ভূমিমূল্য আর আগের মতো নেইফলে রাজস্ব-সংকট দেখা দিয়েছে। এতে ঋণ পরিষেবা ও নাগরিক সেবায় টান পড়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ব্লুমবার্গের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়সে মাসে চীনের স্থানীয় সরকারগুলোর ভূমি বিক্রি থেকে আয় ছিল গত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে তারা কর্পোরেটদের ওপর অতিরিক্ত জরিমানা চাপানোস্থানীয় কর্মকর্তাদের আগের দেয়া বোনাস ফেরত নেয়াএমনকি বেতন-ভাতা মেটাতে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ধার করাএসব কৌশলও অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে।

চীনা নাগরিকেরাও ধীরে ধীরে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আস্থা হারাচ্ছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর তথ্য অনুযায়ী২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ২৫৪ বিলিয়ন ডলারের মূলধন চুপিচুপি দেশ থেকে বেরিয়ে গেছেযা স্পষ্টভাবে অভ্যন্তরীণ হতাশার লক্ষণ। তরুণ প্রজন্মের একাংশ এখন লায়িং ফ্ল্যাট” (চুপচাপ শুয়ে থাকা) মনোভাবের কথা বলছেসমাজের নিরন্তর পরিশ্রমের প্রত্যাশা আর ত্যাগ স্বীকারের দাবির বিপরীতে তাদের একধরনের নীরব বিদ্রোহ। তরুণ-যুবাদের বেকারত্ব রেকর্ড পর্যায়েউন্নত ডিগ্রি আর দীর্ঘ পরিশ্রম এখন আর আগের মতো চাকরি বা সামাজিক অগ্রগতির নিশ্চয়তা দেয় না।

চীনের বিকাশের জন্য এতদিন যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সহায়ক ছিলসেটিও এখন সতর্ক। একসময় বিপুল বাজারের আশায় চীনে ঝাঁপিয়ে পড়া বিদেশি কোম্পানিগুলো এখন অনেক বেশি সতর্ককেউ কেউ তো বাজার থেকেই বেরিয়ে যেতে চাইছে। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ কমে গেছে৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ২০২১ সালে চীন কর্তৃক প্রযুক্তি খাতে আরোপিত কঠোর নিয়ন্ত্রণে (ক্র্যাকডাউন) শেয়ারমূল্যে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়আর অনিশ্চিত নিয়ন্ত্রক ও রাজনৈতিক পরিবেশ বহুজাতিক কোম্পানিকে পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সাংহাইয়ে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়তাদের সদস্যদের মধ্যে অর্ধেকেরও কম চীনে আগামী পাঁচ বছরের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদীএই সমীক্ষার ২৫ বছরের ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগদানের পর চীনকে বহুমুখী বাজারে উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিলদেশটি ছিল সস্তায় উৎপাদন আর সীমাহীন বিনিয়োগের ক্ষেত্র। এখনো চীনের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের ওপর নির্ভরতা প্রবলকিন্তু অনেক সরকার চীনের অর্থনৈতিক বিস্তার আর সামরিক সক্ষমতার কূটনৈতিক পরিণতি নিয়ে সতর্ক হয়ে উঠছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশযারা একসময় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) অবকাঠামো গড়ার সুযোগ বলে দেখেছিলএখন এর পরিবেশগত প্রভাব ও স্থানীয় শ্রমনীতির সমস্যাগুলো নিয়েও ভাবছে। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো উন্নত অর্থনীতিও চীনা বিনিয়োগ থেকে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি এড়াতে নতুন স্ক্রিনিং পদ্ধতি তৈরি করেছে। ২০১৯ সালের মার্চে ইউরোপীয় কমিশনের এক স্ট্র্যাটেজিক আউটলুক” রিপোর্টে চীনকে পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়আগেকার দিনের বাজারসুযোগের ভাবনার পরিবর্তে এটিকে এক মৌলিক সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখা হয়। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রিটিক্যাল অবকাঠামোপ্রযুক্তিডিজিটাল খাতের বিনিয়োগের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানোর কথা ভাবে।

অন্যদিকে শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীলঅস্বচ্ছযা চীনের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সম্পর্ক উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা বাড়াচ্ছে। তিনি ক্ষমতার পিরামিডের শীর্ষে খুব ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের রেখেছেনফলে অভ্যন্তরীণ যাচাই-বাছাই ও ভারসাম্য রক্ষা দুর্বল হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে তথ্য চেপে রাখাসতর্কবার্তা দেয়া চিকিৎসকদের মুখ বন্ধ করাএসবই এর উদাহরণএতে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় দেরি হয়ভাইরাস দ্রুত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়ভাবে সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও স্বচ্ছতার অভাবে তা ব্যর্থ হয়আর দায়ে পড়ে চীন আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এটি দেখিয়ে দেয়মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহ দমিয়ে রাখার ফলে কী ক্ষতি হতে পারে।

শি জিনপিং যে অসাম্য দূর করতে এবং বেসরকারি খাতের মাত্রাতিরিক্ত শক্তি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছেনসে পদক্ষেপগুলোও অনেকটা হঠাৎঅস্বচ্ছ এবং বিশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি-ভুলযেমন স্থানীয় সরকারগুলোকে আর্থিকভাবে বাঁচাতে অনীহা ও ছায়া ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী না হওয়াচীনা অর্থনীতির আর্থিক চাপে ঘি ঢেলেছে। রিয়েল এস্টেট জায়ান্টদের তারল্য সংকটও বেড়েছে এতে। হঠাৎ ও বিরাট পরিসরে প্রযুক্তি খাত আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদেরও হতবুদ্ধি করেছে চীন। জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ বিবেচনা করে (শি জিনপিং যাকে সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তা ধারণা” বলেন) অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা শুরু হওয়ায়চীনের দ্রুত অগ্রগতিকে চালিকাশক্তি জোগানো উৎসগুলো (যেমন উদ্ভাবনবিনিয়োগউদ্যোগ) ঝুঁকির মুখে পড়ছে। দেং শিয়াওপিং-এর সময় থেকে চীনের নেতারা বাজারমুখী ব্যবস্থাকে উৎসাহ দিয়েছেনস্থানীয় সরকারগুলোকেও নিজেদের বাস্তবতা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে দিয়েছেন। এখনকেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর ও শীর্ষ-নির্ভর নির্দেশনায় স্থানীয় সরকারগুলো অচলআর বেকারত্ব ও ঋণের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

যেসব উদ্যোক্তা চীনের অর্থনৈতিক বিস্ময়ের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেনতারা এখন আতঙ্কে রয়েছেনকেন্দ্রীয় সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে কেউ জানে না। অস্বচ্ছ ও আইনি নিরাপত্তাহীন যে প্রক্রিয়ায় নীতি নির্ধারণ হয়তা কেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলোকে উন্মোচিত করছে: এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পর্যালোচনার সুযোগ কমনাগরিক ও ব্যবসায়ীরা হঠাৎ বদলে যাওয়া নির্দেশের ধাক্কা সামলাতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ মেয়াদে হয়তো শি জিনপিং-এর ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ সাময়িকভাবে কিছু নির্দিষ্ট কৌশলগত সাফল্য এনে দেবেকিন্তু সেটিই দেশটির নীতিনির্ধারণ ব্যবস্থাকে জনমানস ও বৈশ্বিক প্রত্যাশা থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে।

মজবুত ভিত চীনের উত্থানকে ঘিরে একদিকে ফাতালিজম (অপরিহার্য পরাজয়ের ধারণা)আরেকদিকে নির্ভেজাল আত্মপ্রত্যয়দুটোই বাস্তব চিত্রকে আড়াল করতে পারে। বাস্তবতা হলো চীনের বৈশ্বিক প্রভাব অবশ্যই বাড়ছেকিন্তু একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এমন কিছু অনন্য ও টেকসই কৌশলগত সুবিধা আছেযেমন এর অভিযোজনশীল অর্থনীতিউদ্ভাবনী সক্ষমতাশক্তিশালী মিত্রজোটআর উন্মুক্ত সমাজব্যবস্থা। ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে (ডলার সমান ধরে) এখনো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শুধু চীনের চেয়েই বড় নয়বরং বিশ্বের পরবর্তী তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতির সম্মিলিত আকারেরও বড়। আইএমএফ-এর হিসাব মতে২০২৪ ও ২০২৫ সালে জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদকালে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে জিডিপির ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নিয়েছেআর বৈশ্বিক জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব এখনো ১৯৯০-এর দশকের কাছাকাছি। রোডিয়াম গ্রুপের লোগান রাইটের মতো বিশ্লেষকেরা অনুমান করছেনচীনের বৈশ্বিক জিডিপিতে অংশগ্রহণ ২০২১ সালে সর্বোচ্চে পৌঁছেছিলএরপর থেকে তা নিম্নমুখীএবং অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। যারা চীনের অর্থনীতি নিয়ে অপেক্ষাকৃত আশাবাদীতারাও স্বীকার করেন প্রবৃদ্ধির গতিপথ ধীরকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ বাড়ছেআর নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া অনেকখানি অনভিজ্ঞ।

আমেরিকান কোম্পানিগুলো বিশ্বের বাজারে রাজত্ব করছে২০২৪ সালের মার্চে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বড় কোম্পানির ৯টিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরচীনের সবচেয়ে বড় কোম্পানি টেনসেন্ট ২৬-তম স্থানে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেচীনে অর্থ ঢোকার বদলে বরং সেখান থেকে অর্থ বের হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন (হাই-স্কিলড) অভিবাসীর সংখ্যাও বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চবিপরীতে চীনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিদেশি মেধা আকর্ষণ করার ইতিহাস নেই।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিপ্লব যত এগোচ্ছেযুক্তরাষ্ট্র ততটাই এর উদ্ভাবন ও বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার অবস্থায় আছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল এআই পাওয়ার র‍্যাঙ্কিং-এ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে আছেএআই গবেষণাবেসরকারি বিনিয়োগও উন্নত এআই প্রযুক্তি বিকাশে চীনের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে। গত দশকে মার্কিন প্রযুক্তি খাত এআই-ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে তিন গুণ বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬১টি উল্লেখযোগ্য এআই মডেল তৈরি হয়যেখানে চীনে তৈরি হয় মাত্র ১৫টি। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা এআই-ক্ষেত্রে চীনের তুলনায় প্রায় নয় গুণ বেশি মূলধন লগ্নি করে৮৯৭টি স্টার্টআপে অর্থায়ন হয়চীনে সেই সংখ্যা মাত্র ১২২। এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীভূতবাজারনির্ভর কাঠামোযেখানে বেসরকারি খাত ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবাধ সহযোগিতা করা যায় এবং সেরা বিশ্বমেধা আকর্ষণের সুযোগ আছে।

জ্বালানি খাতেও চীনের বড় এক দুর্বলতা হলোদেশটি বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিমাণ তেল আমদানি করেমোট চাহিদার ৭০ শতাংশের বেশি। ফলে বৈশ্বিক সংঘাতসরবরাহ সংকটবা অন্য কোনো বিঘ্ন ঘটলে চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা বড় ঝুঁকিতে পড়বে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় জ্বালানি-স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্পাদনেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। উন্নত শেল ফ্র্যাকিংঅনুভূমিক খনন (হরাইজন্টাল ড্রিলিং) প্রযুক্তিতে সাফল্যের কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারকে প্রভাবিত করতে পারছে। যেমনরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হলে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত বাড়তি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে ইউরোপের রাশিয়া-নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে।

ডলারের বিশ্ব-রিজার্ভ মুদ্রা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে অতুলনীয় আর্থিক প্রভাব দিয়েছেযদিও এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল ডলারেযেখানে ইউরোর ছিল প্রায় ২০ শতাংশআর ইউয়ানের ছিল ৩ শতাংশেরও কম। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ব্যবস্থাপনা সহজ হয়সুদের হার কমিয়ে রাখতে সুবিধা হয়এমনকি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভর করে বিরাট হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তবে এটাও সত্য যেডলারের এই প্রাধান্য যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু কাঠামোগত সমস্যার মুখে ফেলেযেমন বাণিজ্য ঘাটতি কিংবা ডলারের মান বেশি হয়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারীদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া। কিন্তু এসবই এমন সমস্যা যা চীন পেতে চাইছেতারা ডলারের বিকল্প বানাতে উদ্যোগীএমনকি একটি ডিজিটাল কারেন্সি চালু করেছে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতার লাগাম কিছুটা কমানো যায়।

উত্তর ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে চীনের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারস্টেলথ সাবমেরিনও এআই-চালিত সমরাস্ত্রের বিকাশ। তাদের প্রতিরক্ষা শিল্প এখন পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধবিমানহাইপারসনিক অস্ত্র এবং উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র বিপুল হারে তৈরি করতে সক্ষম। এ-টু/এডি (A2/AD) সক্ষমতার বিকাশ দেখায় যে যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশনাল স্বাধীনতা সীমিত করার লক্ষ্য চীনের। তা সত্ত্বেওচীনের সামরিক বাহিনী দুর্নীতিবাস্তব যুদ্ধের অভিজ্ঞতার অভাবইত্যাদি সমস্যায় ভুগছে। আর যে কোনো সংঘাত চীনের আঞ্চলিক জলসীমায় হলে তাদের নিজস্ব অর্থনীতিই অনেক বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেকারণ তারা ব্যাপকভাবে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বিশ্বের নানা স্থানে মোতায়েন সৈন্যব্যাপক যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা ও মিত্রজোটের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা এখনো তুলনাহীন।

তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্যযুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বৈশ্বিক মিত্রজোট যা চীনের নেই। ন্যাটোঅস্ট্রেলিয়াজাপানফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো বৈশ্বিক সঙ্কটে দ্রুত সাড়া দিতে পারেদূর দেশে সেনা মোতায়েন রাখতে পারেযা তাদের কার্যকারিতা ও প্রস্তুতিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। একটি সুপারপাওয়ার হল সেই দেশযা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেযুক্তরাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা আছেচীনের এখনো তা নেই।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণও এক বড় শক্তিঅংশত শক্তি অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যেও ভাগ করা আছেএবং নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নাগরিকরা অসন্তুষ্টি প্রকাশের সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্রকে আজ চরম মেরুকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়ের হুমকির মুখে পড়তে হলেওএখনো মুক্ত গণমাধ্যমস্বাধীন আইনসভা আর স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা রয়েছেযা নির্বাহী ক্ষমতার ওপর লাগাম টানে।

মিথ্যা সীমা মনে রাখা দরকারচীনের বড় সাফল্যগুলো এসেছে এমন খাতেইযেখানে যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরে গিয়েছে। ৫জি প্রযুক্তির কথা ধরি: পরবর্তী-প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক তৈরি ও স্থাপনে চীন জোরেশোরে এগিয়ে আফ্রিকাএশিয়া ও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে আধিপত্য বানিয়ে ফেলেছে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা ছিল নাতা নয়বরং যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে বিনিয়োগে দেরি করেছেজাতীয় পর্যায়ে যথেষ্ট সম্পদ ও পরিকল্পনা দেয়নি।

কোয়ান্টাম যোগাযোগ ও স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কে চীনের দ্রুত সাফল্য দেখায় যেতারা সরকারি ভর্তুকিআগ্রাসী শিল্পনীতি ও কাঁচামালের উৎস দখলের বিষয়গুলোকে কৌশলগত গুরুত্ব দিয়েছেআর যুক্তরাষ্ট্র এদিকে ধীর গতিতে এগিয়েছে। কিন্তু এই একমুখী অগ্রযাত্রারও মূল্য আছে। চীন নির্দিষ্ট কিছু খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাপক সম্পদ ঢেলে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতযেমন সামাজিক নিরাপত্তা বা অভ্যন্তরীণ ভোগবাদএর সংস্কার ও উন্নয়নকে পিছিয়ে রাখছে।

চীনের এই টানাপোড়েনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার শক্তি আরও জোরদার করা। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি)কাটিং-এজ শিল্পবুদ্ধিমান অভিবাসন সংস্কারএশিয়া ও ইউরোপে মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়করণ এবং প্রতিরক্ষা শিল্পভিত্তির পুনর্গঠনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যদি মার্কিন নেতৃত্ব চীনের উত্থান নিয়ে শুধু হাহুতাশ করে আর নিজস্ব কাঠামোয় বিনিয়োগ না করেতবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রাধিকার দ্রুত ক্ষয় হতে পারে।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গুরুতর সমস্যাও রয়েছে। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যায় না যে দেশে-বিদেশে এর শক্তিমত্তা এখনো অসামান্যএবং এর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (সব চাপ সত্ত্বেও) অন্য যে কোনো ব্যবস্থার চেয়ে নিজেকে পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অনন্য সক্ষমতা দেখাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতা সামনের কয়েক দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উপাদান হয়ে থাকবে। তবে চীনের কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা নির্দিষ্ট কিছু খাতে দ্রুত অগ্রগতি আনলেওসে অর্জন যথেষ্ট ভঙ্গুর। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রকৃত বিপদ হয়তো কোনও অপ্রতিরোধ্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নয়বরং নিজেদেরকে জানার বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়া সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা কিংবা সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে কাজে না লাগানো থেকেই আসতে পারে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024