বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:০৮ অপরাহ্ন

আলামত

  • Update Time : শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫, ৪.০০ পিএম

আবু ইসহাক

বারো শ’ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ড নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল তা যে ভেঙে যাবে, তার আলামত ইলিয়াস পেয়েছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে পা দিয়েই।
১৯৫৬ সাল। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে ইলিয়াস করাচী এলেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় তাঁর মতো আরো সব বাঙালিরা প্রায়ই শুনতে পেতেন, পেছন থেকে বা কোনো বাড়ির বারান্দা থেকে কেউ বলছে, ‘মাচ্ছি খানেওয়ালা বাঙালি যা রাহা হায়’, অথবা ‘ইয়ে বাঙালি বাবু, আপনা ওয়াতন ছোড়কে কিউ উধার আয়া? আপনা মুলুক ওয়াপস চলে যাও’, অথবা ‘বাঙালি মাচ্ছি খাতা হায়, ইস লিয়ে ইয়ে লোগোঁকা বদনছে বদবো নিকালতা হায়।’ কখনো পেছন দিকে বা এপাশে-ওপাশে তাকালে দেখা যেত, কথাগুলো যারা কথক তারা নেহায়েতই ছেলে-ছোঁকরা। বয়স তাদের আট থেকে পনেরোর মধ্যে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষ এত অল্পবয়সী ছেলেদের মধ্যে কীভাবে কেমন করে দানা বেঁধে উঠছে, বুঝতে তখন অসুবিধে হয় নি। বড়দের থেকেই যে এ বিদ্বেষ ছোটদের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। ওদের বিরুদ্ধে বাঙালি ছেলেমেয়েদের বিদ্বেষও যে কম ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের দুই জনগোষ্ঠীর পরস্পরের প্রতি এমন বিরূপ মনোভাবের জন্য পাকিস্তান যে ভেঙে যাবে তা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ইলিয়াস। তবে তা যে এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে তখন তা বুঝতে পারেননি। তখন মনে হয়েছিল, পাকিস্তান আন্দোলনে দুই ভূখণ্ডের যেসব নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা এবং তাঁদের অনুসারীরা যত দিন জীবিত আছেন তত দিনই পাকিস্তান টিকে থাকবে। তাঁদের মৃত্যুর পর নতুন প্রজন্মের নেতাদের পক্ষে পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু কী আশ্চর্য! পাকিস্তানের স্রষ্টা-নায়কদের অনেকের জীবদ্দশায়ই পাকিস্তান ভেঙে গেল এবং তার পূর্ব অংশে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হলো।
বারো শ’ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ, এমনকি চেহারা ও দৈহিক গঠন এক নয়, তাদের পক্ষে একসাথে মিলেমিশে থাকা যে সম্ভব নয় তার আরো আলামত ইলিয়াস পেয়েছিলেন। অতি অদ্ভুত এই আলামত তিনি পেয়েছিলেন উদ্ভিদের কাছ থেকে। হ্যাঁ, উদ্ভিদের বা সোজা সরল কথায় গাছের কাছ থেকে। তাঁর এ কথা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি হলফ করে বলতে পারেন, তাঁর বিবৃত ঘটনায় বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নেই। প্রয়োজন হলে সাক্ষী-সাবুদ হাজির করতেও তিনি প্রস্তুত। অদ্ভূত এ ঘটনাটি যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সদস্যও ছিলেন। শুভানুধ্যায়ী কয়েকজন বন্ধু ব্যাপারটি আর কাউকে না জানাতে তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন এজন্যে যে ওই দেশীয়দের মধ্যে চাউর হয়ে গেলে ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচারণার উদ্দেশ্যে বাঙালির পরিকল্পিত বানাওট কারিকুরি বা অপকৌশল বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তারা ইলিয়াসকে অভিযুক্ত করতে পারে।
করাচীতে বসবাসকারী অনেক বাঙালি চাকরিজীবী তাঁদের বাসস্থান-সংলগ্ন খালি জায়গা গুল্মের বেড়া দিয়ে ঘিরে শাক-সবজির চাষ করতেন। তাঁদের দেখাদেখি ইলিয়াসও শাক-সবজির চাষ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের দেশের বাড়ি থেকে বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ নিয়ে আসতেন। ইলিয়াসও একবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে নানা ধরনের শাক-সবজির বীজ নিয়ে এসেছিলেন। ঘৃতকমলি, জামাইপুলি, নলডোগ, খলশেকানি, কাতলাকানি ইত্যাদি সাত-আট জাতের শিমের বীজও এনেছিলেন। এক বাঙালি প্রতিবেশী শিমের বীজ রোপন করার নতুন এক পদ্ধতির কথা বললেন। তাঁর উপদেশ-অনুযায়ী তিনি দুই ফুট দীর্ঘ, দুই ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট গভীর একটা গর্ত করেন। গর্তের মাটির সাথে এক ঝুড়ি জৈব সার, তিন পোয়া খইল, একপোয়া হাড়ের গুঁড়ো, তিন ছটাক সুপার ফসফেট এবং দুই ছটাক পটাশ মিশিয়ে রেখে দেন তিন সপ্তাহ। তারপর গর্তের মাটি ভালো করে কুদলিয়ে মাঝ-বরাবর দুই-তিন ইঞ্চি গভীর একটা ছোট গর্ত করেন। এবার সাত প্রজাতির শিমের প্রত্যেকটির দুটো করে চোদ্দটা বীজ ঐ গর্তের ভিতরে রেখে ওগুলোকে ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর হাতের দাবনা দিয়ে মৃদু থাপড় মেরে মেরে মাটি সমান করে তার ওপর ছিটিয়ে দেন সামান্য পানি।
চার-পাঁচ দিন পর মাটির ওপর শিমের চারা দেখা যায়। চোদ্দটা বীজই অঙ্কুরিত হয়েছে। ইলিয়াস এগুলোকে তাঁর একতলা বাসার ছাদে উঠতে সাহায্য করার জন্য মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত একগাছি দড়ি টাঙিয়ে দেন। চারাগুলো পরস্পরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে যেন কোলাকুলি-গলাগলি করে দড়িটা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ছাদের উপর উঠে শিমলতাগুলো আলাদা হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে কিছুদিনের মধ্যে সারাটা ছাদ ছেয়ে ফেলে। সে-বছর বিভিন্ন জাতের শিমের এত ফলন হয়েছিল যে নিজেরা খেয়ে এবং প্রতিবেশীদের বিলিয়েও সব শিম কাবার করা সম্ভব হয় নি। প্রচুর শিম লতার সাথেই শুকিয়ে গিয়েছিল। গতানুগতিক পদ্ধতিতে লাগানো শিমগাছ মাত্র একবছর ফল দিয়ে শুকিয়ে মরে যায়। আর এ বিশেষ পদ্ধতিতে লাগানো শিমগাছ তিন বছরেরও বেশি বাঁচে ও ফল দেয়। এর গোড়ার দিকটা জাহাজের কাছির চেয়েও মোটা হয়। একটিমাত্র লতা এক প্রচেষ্ঠায় মাটি ও বাতাস থেকে যে-পরিমাণ খাদ্য আহরণ করতে পারে, অনেকগুলো ঐক্যবদ্ধ লতা সেই তুলনায় তার প্রত্যেকটি লতার জন্য সম্ভবত পরিমাণে বেশি খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এজন্যেই বোধহয় ঐক্যবদ্ধ শিমলতা বেশিদিন বাঁচে এবং বেশিফল দেয়।
১৯৬৬ সালে করাচী থেকে বদলি হয়ে ইলিয়াস পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ইসলামাবাদে যান। তার ব্যক্তিগত আসবাবপত্রাদি পাঠিয়ে দেন ট্রেনে। নড়বড়ে একটা কেরোসিন-কাঠের বাক্সের ভিতর বাজে টুকিটাকির সাথে শাক-সবজির ও নানা জাতের শিমের বীজ পাঠিয়েছিলেন। রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাল খালাস করে এনে দেখেন কাঠের বাক্সটার বেহাল অবস্থা। প্রায় সব বীজই পড়ে গেছে। টুকিটাকির ভিতর তন্নতন্ন করে খুঁজে শিমের মাত্র পাঁচটা বীজ পেলেন। এ ক’টাকেই দুর্লভ সম্পদ হিসাবে যত্ন করে রেখে দিলেন।
ইসলামাবাদের বাসার সামনে ফুলের বাগান আর পেছনে সুপরিসর সবজির বাগান।
ইলিয়াস শিমগাছ লাগাবার জন্য গর্ত খোঁড়েন। প্রয়োজনীয় সার দিয়ে ফেলে রাখেন মাসখানেক। বীজ রোপনের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাঁর যে আছে মাত্র পাঁচটা বীজ। আরো কমপক্ষে সাত-আটটা বীজের দরকার। বাঙালি প্রতিবেশী কারো কাছেই শিমের বীজ পাওয়া গেল না। অগত্যা তিনি রাওয়ালপিন্ডির রাজাবাজারে ছুটলেন। বীজের দোকানে শিমের বীজ চাইতেই দোকানদার বীজ দেখাল। তার কাছে এই এক জাতের বীজই আছে। বীজ নিয়ে তিনি বাসায় ফিরলেন। সেদিনই বিকেলে তিনি তাঁর দেশী পাঁচটা এবং ওই দেশের নয়টা-মোট চৌদ্দটা বীজ আগের মতোই এক গর্তে রুয়ে দিলেন।
চার-পাঁচ দিন পর বাগানে গিয়ে ইলিয়াস দেখেন, চারা উঠে গেছে। গুণে দেখা যায়, বারোটা বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। তাঁর দেশী শিমের চারা চিনতে অসুবিধে হয় না। কোনোটার পাতার রঙ গাড়ো সবুজ, কোনোটার পাতার শিরায় বেগুনি আভা, পাতার আকৃতিও ভিন্ন। ওই দেশী শিমের পাতাগুলো অপেক্ষাকৃত বড়, পাতা ও শিরার রঙ শাদাটে সবুজ। মোটা দড়ি দিয়ে জালের মতো বানিয়ে শিমলতার জন্য মাচা টাঙিয়ে দেওয়া হলো। মাচায় উঠবার জন্য একটা দড়ির একপ্রান্ত মাটিতে পোঁতা খুঁটার সাথে বেঁধে অন্যপ্রান্ত বেঁধে দেওয়া হলো মাচার সাথে। প্রায় তিন সপ্তাহ পর ইলিয়াস বাগানে গিয়ে দেখেন, ওই দেশী শিমের চারাগুলো একসাথে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে দড়ি বেয়ে উপরে উঠছে আর তাঁর নিজের দেশের শিমের চারাগুলো কোলাকুলি-গলাগলি করে উপরে উঠবার কোনো অবলম্বন না পেয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। তিনি একটু অবাক হন এবং অনুমান করেন, বীজ রোপনের সময় নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি হয়েছে, সম্ভবত তাঁর নিজের দেশের সবগুলো বীজ একধারে আর ওই দেশী বীজের সবগুলো অন্যধারে পড়ায় এই কাণ্ডটি ঘটেছে।
ইলিয়াস নরম হাতে চারাগুলোর প্যাঁচ খুলে সবগুলোকে একসাথে পেঁচিয়ে দড়ির সাথে দু-তিনটে প্যাঁচ দিয়ে জড়িয়ে দেন।
পাঁচ-ছ’ দিন পর বাগানে গিয়ে ইলিয়াস দেখেন পূর্ব পাকিস্তানী ও পশ্চিম পাকিস্তানী দুই চারার গোষ্ঠী প্যাঁচমুক্ত হয়ে আলাদাভাবে নিজেদের জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিয়েছে। ওই দেশের চারাগুলো এবারও দড়িটা দখল করে উপরে উঠছে।
ইলিয়াস আর একটা দড়ি মাচার সাথে বেঁধে তাঁর দেশী শিমের জন্য সিড়ি বানিয়ে দেন। দুই দলই মাচার উপরে উঠল। কিন্তু এক দল দখল করল মাচার দক্ষিণ দিক আর অন্য দল উত্তর দিক।
ইলিয়াস বুঝতে পারেন, দেহত্বকের ও দেহরসের ভিন্নতার জন্য দুই দেশের দুই শিম-গোষ্ঠীকে জবরদস্তি করে সংযোজন করার প্রয়াস সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
সে-বছর শিমের ফলন মোটেই ভালো হয় নি। মাটির নিচে হয় তো শিকড়ে শিকড়ে লড়াই চলছিল দুই দলের।

যা ছিল অবশ্যম্ভাবী তা ঘটে গেল এই আলামতের পাঁচ বছর পরেই।


৬৯৯ বড় মগবাজার, ঢাকা
মে, ১৯৮৯

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024