বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:১৩ অপরাহ্ন

“ট্রাম্প ২.০” বিশ্ব অর্থনীতির ওপর বিশাল প্রভাব

  • Update Time : রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২৫, ৩.৫৮ এএম

জনাথন জোসেফস

মুদ্রাস্ফীতিসুদের হার ও শুল্কএই তিনটি বিষয়ের কারণে ২০২৫ সাল বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য বেশ আকর্ষণীয় বছর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছেএ বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৩.২% হারে স্থিতিশীল কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম গতিতে বাড়তে পারে। তবে এর অর্থ কী হতে পারে আমাদের সবার জন্য?

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সুদের হার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বড়দিনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঋণগ্রহীতার জন্য সুখবর আসেটানা তৃতীয়বারের মতো সেখানে সুদের হার কমানো হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোম পাওয়েল স্পষ্ট জানিয়ে দেনমুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৫ সালে আগের মতো ঘন ঘন সুদের হার কমানোর পথে হাঁটবে না।তিনি বলেন, “এবার আমাদের নতুন এক পর্ব শুরু হয়েছেএবং সুদ কমানোর বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকব।”

কোভিড মহামারি ও ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর সারা বিশ্বে পণ্যমূল্য দ্রুত বেড়ে যায়। যদিও এখনও দাম বাড়ছেতবে আগের তুলনায় সে গতিতে বেশ কমতি এসেছে। তবু নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রইউরোজোন ও যুক্তরাজ্যএই তিনটি অর্থনীতিতেই মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ২.৭%২.২% এবং ২.৬% হয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি নামিয়ে আনার “শেষ পর্ব” বা “লাস্ট মাইল” সাধারণত অনেক কঠিন হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর টার্গেট ২% হলেও অর্থনীতি শক্তিশালীভাবে বাড়লেই কেবল এ লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়।

কিন্তু ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকে ঘিরেএমনটাই মনে করেন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের প্রধান লুইস ওগানেস।নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীনকানাডা ও মেক্সিকোর ওপর নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।

ওগানেসের ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের চেয়ে বেশি আত্মকেন্দ্রিক বাণিজ্য নীতির দিকে যাচ্ছেযেখানে শুল্ক বাড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা হবে। স্বল্পমেয়াদে এতে মার্কিন প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়তে পারেকিন্তু যেসব দেশ বাণিজ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতাদের জন্য এটা বড় ঝুঁকি হয়ে উঠবে।”

নতুন শুল্ক আরোপ মেক্সিকো ও কানাডার জন্য “একেবারে ধ্বংসাত্মক” প্রভাব ফেলতে পারেআবার একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মরিস অবস্টফেল্ড।

তিনি উদাহরণ হিসেবে গাড়ি শিল্পকে টেনে আনেনযেখানে যন্ত্রাংশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রমেক্সিকো ও কানাডা জুড়ে বিস্তৃত। “এই সরবরাহ শৃঙ্খল যদি ব্যাহত হয়তাহলে গাড়ির বাজারে বিশাল ঝাঁকুনি আসবে,” বলেন তিনি।

ফলে দাম বাড়বেপণ্যের চাহিদা কমবেকোম্পানির মুনাফা কমে বিনিয়োগে ভাটা দেখা দেবেসমষ্টিগতভাবে যা অর্থনীতিকে পেছনে টেনে ধরতে পারে।ওবস্টফেল্ডযিনি এখন পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসে আছেনবলেন, “যে বিশ্ব এখন বাণিজ্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীলসেখানে এমন শুল্ক আরোপ প্রবৃদ্ধিতে আঘাত হানতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।”

এই নতুন শুল্ক নিয়ে বাড়তি চাপ পড়ছে কানাডার উপরও। ইতিমধ্যেই শুল্ক-সংকট ও দেশীয় কিছু সমস্যার জের ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের ঘোষণার বিষয়টি সামনে এসেছে।

চীনের ওপর সম্ভাব্য শুল্কের প্রভাব

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এখন যা পরস্পরের কাছ থেকে কেনাবেচা করেতার বেশির ভাগই ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুল্কের আওতায় এসেছে। তবু নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য ২০২৫ সালে বড় বাধা হিসেবেই দেখা দিচ্ছে।নতুন বছর উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্বীকার করেছেন যে “বাইরের পরিবেশে অনিশ্চয়তা” রয়ে গেছেতবে তিনি বলেছেন চীনের অর্থনীতি উর্ধ্বগামী ধারায়” রয়েছে।

চীনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তার রপ্তানিবিশেষ করে স্বল্পমূল্যের পণ্য। শুল্কের কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মার্কিন ক্রেতারা কম কিনতে পারেযা চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তার ওপর চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগও কিছুটা দুর্বলযা সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

তবে বিশ্বব্যাংকের মতেসম্পত্তি খাতের সমস্যা সামাল দেওয়াসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা ও স্থানীয় সরকারের অর্থব্যবস্থার উন্নতি সাধন করলে ২০২৫ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ৪.৫% পর্যন্ত হতে পারে। সংস্থাটির পূর্বাভাস ডিসেম্বরের শেষে ৪.১% থেকে বাড়িয়ে ৪.৫% করা হয়েছে।

২০২৫ সালে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক না করলেও গত বছরে ৫% লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়ার কথা তারা বলছে। চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোয় নজর দেওয়ার পাশাপাশি সরকার বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন চীনে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাইকেল হার্ট।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও শুল্কের কারণে কিছু বিদেশি কোম্পানি চীনের বাইরে উৎপাদন সরাতে চায়। তবু মাইকেল হার্ট মনে করেন, “চীনকে এতবছরে যে শক্তিশালী সরবরাহকারী উৎপাদনকেন্দ্র হিসেব গড়ে তুলতে ৩০-৪০ বছর লেগেছেসেটা রাতারাতি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।”

বিদ্যুৎচালিত গাড়ি (ইভি) খাত

বিশ্ব বাণিজ্য সংঘাতে কেন্দ্রে থাকতে পারে ইভি বা ইলেকট্রিক গাড়ি খাত। চীনে গত বছর ১ কোটি বেশি ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এসব গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। চীন এই শুল্ককে অন্যায় বলে মনে করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় প্রতিবাদও জানিয়েছে।
তবে ট্রাম্প যদি নতুন করে শুল্ক চাপিয়ে দেনতাহলে ইউরোপের পক্ষেও ব্যাপারটি উদ্বেগজনক হতে পারে।

ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড গত মাসে বলেন, “বাণিজ্যে বাধাসংরক্ষণবাদী নীতিএসবই প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। পাশাপাশি এতে মুদ্রাস্ফীতির উপর কী প্রভাব পড়বেতা অনিশ্চিত। তবে স্বল্পমেয়াদে এর কিছুটা মুদ্রাস্ফীতিমূলক প্রভাব দেখা যেতে পারে।”

ইউরোপের প্রবৃদ্ধির চিরাচরিত প্রধান চালিকাশক্তি জার্মানি ও ফ্রান্স। কিন্তু গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তাদের দুর্বল অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা উন্নতি সত্ত্বেও ইউরোজোনের গতি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।উৎপাদন ও খুচরা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং ভোক্তাদের ক্রয়ব্যয় বাড়লে ইউরোজোন প্রবৃদ্ধি কিছুটা গতি পেতে পারে।

কিন্তু উচ্চ কর ও মজুরির কারণে দাম আরও বেড়ে যেতে পারেযা একে আরও কঠিন করে তুলবে।তার ওপর ইউরোজোনে মুদ্রাস্ফীতি এখনো ৪.২%। ২% লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটা দ্বিগুণেরও বেশিআর উচ্চ মজুরি বৃদ্ধির চাপ তা কমানোয় বাধা দিচ্ছে।

এ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্বের বৃহত্তম নিয়োগ সংস্থা র‍্যানস্টাডের প্রধান নির্বাহী স্যান্ডার ভ্যান ট নুরডেন্ডে।

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালেও মজুরি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪% থাকবে বলে ধারণা। পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশে এটা আরও বেশি। এর পেছনে যেমন দক্ষ জনবলের স্বল্পতা আছেতেমনি আছে পূর্ববর্তী মুদ্রাস্ফীতির চাপযেখানে মানুষ বেশি বেতন দাবি করছে।”

অনেক কোম্পানি এই বাড়তি মজুরি খরচ পণ্যের দামে যোগ করছেযা সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতিকে আবার বাড়িয়ে দিচ্ছে।তবে বৈশ্বিক চাকরির বাজারে স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে স্যান্ডার ভ্যান ট নুরডেন্ডে বলেনঅর্থনীতি ভালো করলে ব্যবসা বাড়েনিয়োগও বাড়েআর মানুষ তখন নতুন সুযোগের সন্ধানে চাকরি বদলায়। এভাবে পুরো কর্মবাজারে গতিশীলতা আসে।

ট্রাম্প ২.০” ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি

২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প কর ছাড় ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারেনযা সাময়িকভাবে মার্কিন অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে।

তবে এই সব পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি। ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পরেই অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। জেপি মরগ্যানের লুইস ওগানেসের ধারণা, “সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে এগুতে চাইলেও বাকি বিশ্বের জন্য তা ততটা সহায়ক হবে না।”

তিনি আশাবাদী যে বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার কমতে থাকবেতবে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “বেশিরভাগ কিছুই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া বিভিন্ন নীতির ওপর। যদি বাড়তি শুল্ক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি গতি পায়বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হবে।”

এটাই ২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতির সম্ভাব্য রূপরেখাসাময়িকভাবে স্থিতিশীল কিন্তু বহু অনিশ্চয়তায় পূর্ণ এক পথযেখানে প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করছে “ট্রাম্প ২.০” যুগের যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কোন পথে এগোয় তার ওপর।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024