শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন

পরবর্তী অর্থনৈতিক আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে

  • Update Time : সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৫, ১.৩০ পিএম

ক্লদ লাভোয়া

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সোমবার নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর ওটাওয়ার রিডো কটেজে ফিরে গেছেন।কেনেডিয়ানদের আস্থা হারানোই ছিল তার ব্যর্থতাএবং পরবর্তী সরকারের এদিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।লেখক দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের অবদানকারী কলামনিস্ট। তিনি ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ও নীতিশাস্ত্র বিশ্লেষণ বিষয়ক মহাপরিচালক ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোযিনি এই সপ্তাহে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেনতাকে সরে যেতে হয়েছে ঠিক সেই একই কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন: ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর অসন্তোষ। এই অসন্তোষ উত্তর আমেরিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছেসম্প্রতি ইতালিআর্জেন্টিনাভারতজার্মানি ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে জনভিত্তিক রাজনীতির (পপুলিজম) উত্থান ঘটেছে।

অবশ্য এই অসন্তোষকে অনেকেই বাড়তি বৈষম্যস্থবির মজুরি ও ক্রমবর্ধমান জীবিকাখরচের ফল বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু পপুলিজমের উত্থানের মূল কারণ সব সময় অর্থনীতি বা ডানপন্থী আদর্শ নয়। বিভিন্ন দেশে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়কখনো কখনো অর্থনীতি ভালো থাকা সত্ত্বেও (যাকে ভাইবসেশন’ বলা হয়) জনগণ বর্তমান সরকারকে হটিয়ে দিচ্ছে। আর গবেষণায় দেখা যায় যে পপুলিস্ট নেতারা উচ্চ ও নিম্ন উভয় আয়ের মানুষের কাছ থেকেই প্রায় সমান সমর্থন পেয়ে থাকেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক বজায় রেখেছেন এবং বড় আকারের ভর্তুকি ও পুনর্বিতরণমূলক নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। অন্যদিকে জাস্টিন ট্রুডো মধ্যবিত্ত’ বিষয়ক নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে দারিদ্র্যের হার এবং কর-পরবর্তী আয়বৈষম্য ২০১৫ সালের তুলনায় কমিয়ে আনেন। মধ্যম কর-পরবর্তী আয় মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও ৮ শতাংশ দ্রুত বেড়েছে। তবুও জনগণের অসন্তোষ থামেনি। পপুলিস্ট আন্দোলনের শেকড় কিন্তু প্রাচীন রোমের পপুলারেস’ (প্রায় ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আমল থেকে খুব বেশি বদলায়নি: এর মূল নিহিত জনগণের প্রতিষ্ঠিত শাসনকাঠামোর প্রতি আস্থার অভাবে। এজায়গাতেই জাস্টিন ট্রুডো ব্যর্থ হয়েছেন।

বৃহৎ ও দ্রুতগতির সামাজিক পরিবর্তনউদাহরণস্বরূপ ব্যাপক অভিবাসনবিশ্বায়নপ্রযুক্তিগত বিপর্যয়সামাজিক-বিচারের স্বীকৃতিজলবায়ুজনিত বিপর্যয়মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলাঅনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। অনেকে মনে করছেনসবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেআর তথাকথিত এলিট” কেবল নিজেদের সুবিধাই দেখছেসাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখছে না। ফলস্বরূপজনগণ সেইসব পপুলিস্ট আন্দোলনকে সমর্থন করছে যারা নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

কিন্তু তাদেরই বা দোষ কীরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীগুলো (যেকোনো মতাদর্শের হোক না কেন) প্রায়ই সীমানা নিয়ন্ত্রণমানসম্মত জনসেবাসাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনপ্রতারণা ও পরিবেশগত ক্ষতি প্রতিরোধ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। লিবারেলরা নাগরিকদের আস্থা হারিয়েছে পাসপোর্ট ইস্যু থেকে শুরু করে সরকারি ডিজিটাল সেবাক্রয়-বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা (যেমন অ্যারাইভক্যান)স্বার্থের সংঘাত এড়ানো (যেমন ডব্লিউই চ্যারিটিআগা খান)এমনকি দেশের সীমানা দিয়ে কতসংখ্যক মানুষ আসছে তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও। আরো ব্যাপকভাবে বলতে গেলেসরকারগুলো বিশ্বায়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার পক্ষে অবস্থান নিলেও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য যথেষ্ট সুরাহা দিতে পারেনি। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট ঘটিয়ে দেওয়া ধনকুবেরদের বিচার হয়নিআর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাও চোখে পড়ার মতো সহায়তা পায়নি। ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে নীতিমালা থেকে সরে আসেএমনকি মূলনীতিও জলাঞ্জলি দেয়। এ-সমস্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে উত্তর আসে তাচ্ছিল্যঔদ্ধত্য ও আত্মপরায়ণতার সুরে। পরিসংখ্যান কানাডার এক জরিপে দেখা যায়মাত্র ৩০ শতাংশেরও কম কানাডীয় নাগরিক সরকারকে বিশ্বাস করেন। কাজেই করহার সামান্য বাড়ানো-কমানোডাকযোগে চেক পাঠানো বা বিক্রয়কর তুলে নেওয়াএসব ছোটখাটো পদক্ষেপে মানুষের হারানো আস্থা ফিরবে না।

অসন্তোষের মূল পুরোপুরি অর্থনীতিতে নিহিত না থাকলেও আস্থা অর্জনে ভালো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কুশলতার ঘাটতি জাস্টিন ট্রুডোর পতনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

যে-ই ট্রুডোর স্থলাভিষিক্ত হোনতাকে প্রথমেই স্বাস্থ্যসেবা-সহ মৌলিক সেবাগুলোর গুণগতমান ও প্রাপ্যতা বাড়াতে হবেপাশাপাশি আর্থিক ও কর্মসংস্থান সহায়তার সুযোগ উন্নত করতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের জোগান সরাসরি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়াক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ও সেবা-কেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলানিয়ম-কানুন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা (এবং সত্যিকারের সমতার ভিত্তিতে) ও অভিবাসীদের প্রবেশ ও সমন্বয়ের ওপর নিয়ন্ত্রিত নজরদারি রাখাএসবই হবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পরবর্তী সরকারকে প্রতিযোগিতা ও শ্রমবান্ধব নীতিমালা উৎসাহিত করতে হবেশিল্প ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সরকারকে স্থিতিশীলতা ও দক্ষতানিয়ম ও নমনীয়তাব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ঝুঁকিবহনজলবায়ু প্রশমন ও জ্বালানি নিরাপত্তার মধ্যে আরও ভারসাম্য আনতে হবে।

স্বায়ত্তশাসন আরো বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় বা নিম্ন স্তরের প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দিলে স্থানীয় জনগণের কণ্ঠ ও নিয়ন্ত্রণ বাড়তে পারে। এ ছাড়া সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে ধরা মূলধারার ম্যাক্রোঅর্থনীতির অনেক ধারণাই যে অপরিবর্তনীয় সত্য নয়বরং তাতে যথেষ্ট প্রমাণের ঘাটতি আছেসেটিও স্বীকার করে নেওয়া দরকার। বহু ক্ষেত্রে অর্থনীতি হয়ে উঠেছে আদর্শবাদের কাছে বাস্তবতার পরাজয়ের নামান্তর।

সবশেষেপরবর্তী সরকারের অবশ্যকরণীয় কাজ হলো আরও স্বচ্ছনির্ভরযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক হওয়াএকই সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত এবং সিদ্ধান্ত-সমর্থক প্রমাণ জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা। এটি করতে ব্যর্থ হলে অন্য অংশের সুবিধাবাদী রাজনীতিকরাযারা নিজেরাও এলিট শ্রেণিরই অংশমানুষের এই অনাস্থাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করবে। রোমে পপুলারেসদের সময় ঠিক এমনটিই ঘটেছিল: জুলিয়াস সিজারের জনপ্রিয়তাবাদী অবস্থান রিপাবলিকান ব্যবস্থাকে নাড়া দিয়েছিল এবং তাকে আজীবন স্বৈরতন্ত্রী’ হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল।

কানাডায় এমন কিছু ঘটবে কি নাতা সময়ই বলে দেবেতবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আশাব্যঞ্জক নয়। মনে করে দেখুনডোনাল্ড ট্রাম্প একবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যেতাকে নির্বাচিত করা হলে আমেরিকানদের আর কখনো ভোটের প্রয়োজনই হবে না।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024