সারাক্ষণ ডেস্ক
দুর্যোগ এবং মানবিক সংকটকালে শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাথমিক শৈশব বিকাশ (ইসিডি) বাড়াতে কাজ করছে ‘প্লে টু লার্ন’ কনসোর্টিয়াম। সেসেমি ওয়ার্কশপ, ব্র্যাক, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি এবং নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গত ছয় বছর ধরে কক্সবাজারে ‘প্লে টু লার্ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
এরই অংশ হিসেবে ‘প্লে টু লার্ন’ কনসোর্টিয়াম বৃহস্পতিবার, ১৬ই জানুয়ারি, ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে “প্লে উইথ এ পারপাস: ইনসাইট অ্যান্ড ইমপ্যাক্টস ফ্রম দ্য প্লে টু লার্ন পার্টনারশিপ” শীর্ষক একটি ‘লার্নিং-শেয়ারিং’ সেশনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লেগো ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত ‘প্লে টু লার্ন’ প্রকল্পটি কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু এবং নারী। শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি এই মডেলটি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ভাষা এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করা হয়েছে। সহিংসতার শিকার শিশুরা কিভাবে খেলাধুলাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারে সে বিষয়টিতে এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান, এনডিসি, রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন। মিয়ানমারে ‘কালচারাল জেনোসাইড’ বা সাংস্কৃতিক গণহত্যা হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্লে টু লার্ন’ কর্মসূচিটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন মানবিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে কনসোর্টিয়াম অংশীদারদের তাদের গবেষণা এবং এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই গবেষণার ফল শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট পরিস্থিতিতে শিশুদের জন্য সহায়ক হবে।
সেসেমি ওয়ার্কশপের ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ইমপ্যাক্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লেইসলি বার্নস শিশুদের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য শিক্ষার মূল বিষয়গুলো নিত্যনতুন পদ্ধতিতে পুনরাবৃত্তির উপর জোর দেন। এই কর্সূচিটিকে তিনি কেবলমাত্র একটি প্রকল্প নয়, বরং একটি আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেন।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. হিরোকাজু ইয়োশিকাওয়া উল্লেখ করেন যে খেলার মাধ্যমে যে শিক্ষা সেটি বাস্তুচ্যুত ও সংঘাতপ্রবণ এলাকার শিশুদের মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, শিশুদের সহিংসতার শিকারের ঘটনা কমাতে এবং তাদের বিকাশে মায়েদের পাশাপাশি বাবাদের সম্পৃক্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান ‘প্লে টু লার্ণ’ প্রকল্পে কিভাবে অল্প বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ বার্তার মাধ্যমে অর্থবহ আচরণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে সেটি তুলে ধরেন।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (বিআইইডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম শিশুদের কেন্দ্র করে প্রোগ্রামটি কিভাবে তৈরি হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, খেলাধুলা এখানে শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মানসিক নিরাময়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য ও মানবিক সংকট ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. মো. আকরামুল ইসলাম নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, এই প্রকল্পে কাজ করাটা একই সঙ্গে ছিল চ্যালেঞ্জিং এবং প্রেরণাদায়ক। ‘প্লে টু লার্ন’ প্রকল্পে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে ব্র্যাকের এডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ মানবিক সংকটকালে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব তুলে ধরেন। ‘প্লে টু লার্ন’ প্রকল্পটি সফল বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য তিনি কনসোর্টিয়াম সদস্য এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বিআইইডি-এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার ডা. মুহাম্মাদ মুসা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। আলোচনা শেষে ‘প্লে টু লার্ন’ রিসোর্স হাব এবং একটি মার্কেট প্লেস প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, গত ছয় বছর ধরে চলমান ‘প্লে টু লার্ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শিশু, বাবা-মা এবং অভিভাবকরা সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে অংশগ্রহণকারী শিশুদের ৭০ শতাংশ সামগ্রিক বিকাশ মাইলফলক অর্জন করেছে এবং ৯১ শতাংশ মানসিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। এছাড়া ৯৬ শতাংশ বাবা-মা এবং অভিভাবকরা তাদের শিশুদের প্রতি আরও যত্নশীল ও মনোযোগী হয়েছেন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা কক্সবাজার এবং মধ্যপ্রাচ্যে ‘মানবিক প্লে ল্যাব (এইচপিএল)’ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা শিশুদের বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকার উপর জোর দেন। বক্তারা কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং মানসিক ক্ষত নিরাময়ে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
Leave a Reply