শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:০০ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৬)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৫, ১১.০০ এএম

অধ্যাপক এস. সি. সেন

মিঃ সেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা দেখিতেন। এই পরীক্ষার খাতা দেখিয়া তিনি আমাকে দিয়া রেলস্টেশনে পাঠাইতেন কলিকাতায় পার্সেল করিতে। পার্সেলে যাহা লাগিত তাহা হইতেও কিছু বেশি টাকা তিনি আমার সঙ্গে দিতেন। একবার সেই খাতা পার্সেল করিয়া আট আনার পয়সা আমার পকেটে আছে। এমন সময় দেখিতে পাইলাম একটি লোক সুন্দর গুড়ের সন্দেশ বিক্রি করিতে আসিয়াছে। ক্ষুধাও তখন বেশ লাগিয়াছে।

আমি একটা একটা করিয়া আট আনার সন্দেশই খাইয়া ফেলিলাম। তারপর বেশ অনুতাপ হইল। কেন এরূপ করিলাম? এই আট আনার পয়সা আমি কোথা হইতে দিব? বাড়িতে যাইয়া অনেক চেষ্টা করিলাম বাজানের নিকট হইতে পয়সা লইতে কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারিলাম না।

পরদিন মিঃ সেনের সঙ্গে দেখা করিতে তিনি পয়সার হিসার চাহিলেন। হিসাব দিতে আমি বলিলাম, “আট আনার পয়সা আমি খরচ করিয়া ফেলিয়াছি। পরে আপনাকে দিব।” তিনি বলিলেন, “পয়সা তোমাকে ফেরত দিতে হইবে না। কিন্তু কিভাবে খরচ করিয়াছ আমাকে বল।” আমি তখন সকল কথা প্রকাশ করিলাম। তিনি আমাকে অতি স্নেহের সঙ্গে বলিলেন, “তোমার ভালোর জন্যই আমি বলিতেছি, এভাবে সন্দেশ খাওয়া তোমার উচিত হয় নাই।” আমি সরমে মরিয়া গেলাম। সামান্য আট আনার পয়সাই তখন আমার জীবনে কত মহার্ঘ ছিল।

লক্ষ্ণৌ শিয়া কলেজে চাকরি পাইয়া মিঃ সেন চলিয়া গেলেন। তাঁহার বিদায়ের দিন আমি অজস্র কাঁদিয়াছিলাম। ১৯৩১ সনে একবার লক্ষ্ণৌ যাইয়া কয়েকদিন তাঁহার সঙ্গে কাটাইয়া আসিলাম। তিনি কত স্নেহের সঙ্গেই না আমাকে গ্রহণ করিলেন। তখন আমার দুইখানা কবিতার বই বাহির হইয়াছে। লোকের সুখ্যাতিও পাইয়াছি। আমার এই সুখ্যাতি যেন তাঁহারই কৃতিত্ব। খুঁটিয়া খুঁটিয়া তিনি আমার সবকিছু সাহিত্য-প্রচেষ্টা জানিয়া লইলেন। তখন তিনি শিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। তাঁহার মেয়েটির নাম মনে নাই। তিনি আমার আহার-বিহারে বিশেষ যত্ন লইয়াছিলেন।

ইহার ১৪ বৎসর পরে মিঃ সেনের সঙ্গে দেখা হইল দিল্লিতে। শিয়া কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধের জন্য তাঁহার চাকরিটি গিয়াছে। আর্থিক দুর্গতি এবং ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিনি ছেলের সঙ্গে দিল্লিতে বাস করিতেছেন। জন্মান্তরবাদ প্রমাণ করিয়া তিনি একটি মোটা কেতাব লিখিয়াছেন। একদিন তিনি আমার বহু মতবাদ গড়িয়া দিয়াছেন। তাঁহার প্রতিটি কথা আমি বেদবাক্যের মতো সমর্থন করিয়াছি। আজ পরিণত বয়সে তাঁহার জন্মান্তরবাদের সমর্থন করিতে পারিলাম না।

অনেক আলোচনার পর তিনি বলিলেন, “ঈশ্বর যদি তোমার ভিতরে এ বিষয়ে বিশ্বাস না গড়িয়া থাকেন তবে যুক্তি-তর্কে কি তাহা করা যায়?” বহুদিনের ব্যবধানে আমার মতবাদ যে তাঁহাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে এজন্য তিনি বিস্মিত হইলেন। দুঃখিত হইলেন কি না জানি না। তাঁহাকে সালাম জানাইয়া বিদায় গ্রহণ করিলাম। আর যে তাঁহার সঙ্গে দেখা হইবে না তাহা কে জানিত? আমার জীবনে মিঃ সেনের সঙ্গে পরিচিতি একটি মস্তবড় ঘটনা। আমার বহু মতবাদের পিছনে মিঃ সেন জীবন্ত হইয়া আছেন।

 

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024