ফরিদপুর জেলা স্কুলে
ভালো করিয়া ইংরেজি বই পড়িবার জন্য আমার খুবই ইচ্ছা হইত। অর্থ-পুস্তক দেখিয়া ইংরেজি পড়া তৈরি করতাম। সেই অর্থ-পুস্তকে বাংলায় ইংরেজি উচ্চারণ লেখা থাকিত।
‘Hidden’ শব্দের পাশে বাংলায় লেখা থাকিত ‘হিডন’। ‘Horse’ শব্দের পাশে বাংলায় লেখা থাকিত ‘হর্ষ’। বাড়িতে কেহই ইংরেজি জানিত না। অর্থ-পুস্তক দেখিয়া এইভাবে ইংরেজি উচ্চারণ শিখিয়া ক্লাসে যখন পড়িতাম শিক্ষক ছাত্র সকলে মিলিয়া আমাকে উপহাস করিত। আমাদের বাড়িতে তখনও হারিকেন লণ্ঠনের প্রচলন হয় নাই। কেরোসিনের কুপি জ্বালাইয়া পড়াশুনা করিতে হইত। কোনোরকম চেয়ার-টেবিল ছিল না। আমার পিতার বই-পুস্তক রাখিবার একখানা সুন্দর ফুলচাং আমাদের ঘরের চালার সঙ্গে লটকানো ছিল। তাহার উপর আমার বই-পুস্তক রাখিতাম। ঘরের মেঝেয় মাদুরের উপর বসিয়া পড়াশুনা করিতাম।
আমাদের ক্লাসে একদিন রাজবাড়ির রাজপুত্র আসিয়া ভর্তি হইল। তাহার সঙ্গে ভাব করিবার জন্য ক্লাসের ছেলেদের কি কাড়াকাড়ি। আমারও ইচ্ছা হইত রাজপুত্রের সঙ্গে আলাপ করি। কিন্তু অন্যান্য ছেলেদের ব্যূহ ভেদ করিয়া তাহার নিকটস্থ হইতে পারিতাম না। আমাদের ক্লাসে পড়িত ধীরেন্দ্র নামে একটি ছাত্র। স্থানীয় গভর্নমেন্ট উকিলের পুত্র। এই সুদর্শন বালকটি ছিল বড়ই নিরহঙ্কার আর মিশুক। পড়াশুনায়ও সে ছিল ভালো।
অন্যান্য ছেলেদের মতো সে আমাকে অবহেলা করিত না। শিক্ষক মহাশয়েরা যা যা নোট দিতেন, সে তাহা অতি সুনিপুণ করিয়া লিখিয়া রাখিত। একদিন সেই নোট আনিবার জন্য তাহাদের বাড়ি গেলাম। আমাকে বাহিরে দাঁড় করাইয়া ধীরেন বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। ইতিমধ্যে একজন বর্ষিয়সী মহিলা আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা। তুমি ওখানে দাঁড়াইয়া আছ কেন?”
আমি বলিলাম, “ধীরেন আমার সহপাঠী। তাহার কাছে নোটখাতা লইতে আসিয়াছি।” তিনি সস্নেহে বলিলেন, “তবে তুমি বাহিরে দাঁড়াইয়া আছ কেন? ভিতরে আসিয়া বস।” এই বলিয়া তিনি আমাকে বৈঠকখানার ফরাসে লইয়া বসাইলেন।
আমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কি করেন প্রভৃতি নানা প্রশ্ন করিয়া আমার যাহা কিছু তিনি জানিয়া লইলেন। ইতিমধ্যে ধীরেন আসিয়া তাহার নোটখাতাটি আমাকে দিয়া গেল। বিদায়ের সময় ধীরেনের মা আমাকে বলিয়া দিলেন, “তুমি আমার ধীরেনের বন্ধু। যখন খুশি আমাদের বাসায় আসিবে। কোনো সঙ্কোচ করিবে না।”
ফিরিবার পথে বারবার এই মহিলাটির কথা মনে পড়িতে লাগিল। মনে হইল এমন আপনার জন বুঝি কেহ আমার নাই। সেদিন এমন কিছু তিনি আমাকে বলেন নাই যার জন্য এত করিয়া তাঁহাকে মনে পড়িবে। শুধুমাত্র বলিয়াছিলেন, “যখন খুশি তুমি আমার এখানে আসিও।”এই সামান্য কথার জন্য কেহ কাহারও প্রতি আকৃষ্ট হয় না। পরিণামে যে এই মহিলাটি আমার জীবনে এক অভূতপূর্ব স্নেহময়ী মাতৃরূপে আবির্ভূতা হইবেন তাঁহার দর্শনে আমার অবচেতন মনের কোনো কন্দরে হয়তো তাহারই একটু ছোঁয়া লাগিয়াছিল।
বাড়ি যাইবার সমস্ত পথ যেন নাচনের নূপুর হইয়া আমার পায়ে বাজিতে লাগিল। ইহার পরে কারণে-অকারণে বহুবার ধীরেনদের বাড়িতে গিয়াছি। একদিন মাঠ হইতে সরষে শাক তুলিয়া আনিয়া ধীরেনের মাকে দিলাম। এই সামান্য উপহার পাইয়া তিনি যে খুশি হইলেন, আমার সুদীর্ঘ জীবনে কতজনকে কত কিছু দিয়া কোনোদিন কাহাকেও তেমন খুশি করিতে পারি নাই। ইহার পর কবে হইতে যে তাঁহাকে মা বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিলাম তাহা আজ মনে নাই।
চলবে…
Leave a Reply