ফরিদপুর জেলা স্কুলে
এবার হইতে ক্লাসে ধীরেন আমার সঙ্গে আরও মিশিতে লাগিল। আমার পড়াশুনা দেখাইয়া দিতে লাগিল। আমি শিক্ষকের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলে সে বড়ই খুশি হইয়া উঠিত। এ যেন তাহারই কৃতিত্ব। ক্লাসের উপর-নিচ অনুসারে কোনো কোনো দিন আমরা পাশাপাশি বসিতাম। তখন আমাদের মনে বড়ই আনন্দ হইত। আমরা পরস্পরে যে কতই গল্প করিতাম, এজন্য মাঝে মাঝে শিক্ষকের ধমকানি খাইতে হইত।
তখনকার দিনে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা করিয়া ড্রইং শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। একদিন আমরা সকলে লতাপাতা আঁকিতাম। অপরদিন হিন্দু ছেলেরা মানুষ ও নানা-প্রকার জীবজন্তু আঁকিত। জীবজন্তুর ছবি আঁকিলে মুসলমান ছেলেদের ধর্ম নষ্ট হয় এই মিথ্যা ধর্মের গোঁড়ামি কে আবিষ্কার করিয়াছিল জানি না। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রাঙ্কন বিদ্যায় আমরা মুসলমানেরা যে দেওলিয়া-খাতায় নাম লেখাইয়াছি তাহা এইসব গোঁড়ামির ফল।
যে-ঘণ্টায় হিন্দু ছেলেরা জীবজন্তুর ছবি আঁকিত সে-সময় আমরা মৌলবি সাহেবের কাছে উর্দু ভাষা শিক্ষা করিতাম। সেই শিক্ষার কোনো প্রণালী ছিল না। মৌলবি সাহেব একখানা উর্দু কিতাব দেখিয়া পড়া দিয়া দিতেন। পরদিন পড়া না পারিলে বেদম প্রহার করিতেন। উর্দু বর্ণমালা শিক্ষা করা বড়ই কঠিন। শব্দের এক এক স্থানে একই অক্ষর বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। তাহা ভালোমতো শিখাইবার ধৈর্য মৌলবি সাহেবের ছিল না। তাঁহার ক্লাসে আসিলে
তিনি আমাদিগকে টুপি পরিয়া আসিতে বলিতেন। তখনকার দিনে প্রতি ক্লাসে চার-পাঁচজন করিয়া মুসলমান ছাত্র ছিলাম। এক মৌলবি সাহেব আর ড্রিল-মাস্টার সাহেব ছাড়া স্কুলে আর কোনো মুসলমান শিক্ষক ছিলেন না। এই হিন্দুঅধ্যুষিত বিদ্যালয়ে একেই তো মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে হিন্দু ছেলেরা ভালোমতো মিশিত না, তাহার উপর টুপি মাথায় পরিলে নানারকম ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত। আমরা অনেকেই টুপি মাথায় দেওয়াটা অতীব-লজ্জাজনক বলিয়া মনে করিতাম। তাই মৌলবি সাহেবের আদেশ পাইয়াও টুপি পরিয়া স্কুলে আসিতাম না। এইজন্য মৌলবি সাহেব বেত দিয়া মাথায় বাড়ি মারিতেন। সেই আঘাতে মাঝে মাঝে মাথার স্থানে স্থানে ফুলিয়া যাইত। ছোটদের মাথায় মারিলে তাহাদের ভবিষ্যৎ মেধাশক্তির
যে কত অবনতি হয় তাহা হয়তো তিনি জানিতেন বলিয়াই সবচাইতে ক্ষতিকর স্থানেই আঘাত করিতেন। শিক্ষকতার কাজে আসিয়া ছাত্রদিগকে তিনি শুধু ঠেঙাইতেই শিখিয়াছিলেন। ভালোবাসিয়া, আদর করিয়া নিজের কথাটিকে যদি তিনি বুঝাইতে চেষ্টা করিতেন তবে হয়তো তাহার সুফল ফলিত। এই মৌলবি সাহেব পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতেন, আর গভীর রাত্রে জাগিয়া নাকি আল্লার এবাদত-বন্দেগিও করিতেন; কিন্তু এই তপস্যার কোনো ফলই তাঁহার জীবনে প্রতিফলিত হয় নাই। ধর্ম যখন রুটিনমাফিক প্রথা হইয়া জীবনে অভ্যস্ত হইয়া যায় তখন তাহা হইতে কোনো উপকারই পাওয়া যায় না।
যদি পাওয়া যাইত তবে এই মৌলবি সাহেব ভালোবাসিয়া আমাদের ধর্মের কথাটি বুঝাইতেন। কেন আমরা টুপি পরি না তাহা জানিতে চেষ্টা করিতেন। মৌলবি সাহেবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া আমরা খলিফার দোকান হইতে তিন পয়সা দিয়া কিস্তিটুপি কিনিয়া আনিয়া পকেটে রাখিলাম। তাঁহার ক্লাসে যাইবার সময় সেই টুপি মাথায় দিতাম। ক্লাস শেষ হইলে আবার মাথা হইতে খুলিয়া পকেটে পুরিতাম, যেন হিন্দু ছাত্রেরা দেখিয়া না ফেলে।
আমাদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলে আগেই বাড়ি হইতে উর্দু বর্ণমালা শিখিয়া ফেলিয়াছিল। আমরা দুই-তিনজন যাহারা বাড়িতে শিখি নাই, তাহাদিগকে বর্ণমালা শিখাইবার পরিশ্রম করিয়া মৌলবি সাহেব সময়ের অপব্যয় করিতেন না। প্রতিদিন তিনি আমাদিগকে নিয়মিত পড়া দিয়া দিতেন। পড়া পারিতাম না। সেইজন্য মৌলবি সাহেব আমাকে বেদম প্রহার করিতেন। তাঁহার প্রতি ধীরে ধীরে আমার মন বিতৃষ্ণ হইয়া উঠিতেছিল। আমাকেও তিনি দুই চক্ষে দেখতে পারিতেন না। সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়া আমি আরবির পরিবর্তে সংস্কৃত লইলাম। এই মৌলবি সাহেবের অত্যাচারে আমার স্কুল-জীবন মুসলিম কৃষ্টি ও তমদ্দুনের ধারা হইতে বঞ্চিত হইল।
চলবে…
Leave a Reply