স্বদেশ রায়
সেক্যুলারইজম শব্দের বাংলা অর্থ “ইহ-জাগতিকতা” লিখতেন সাংবাদিক, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক আবুজাফর শামসুদ্দিন। বাংলাদেশের সংবিধান যেহেতু প্রথমে ইংরেজিতে লেখা হয়েছিলো তাই তার বাংলায় অনুবাদ করার সময় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেক্যুলারইজমের পরিভাষা করেছিলেন “ ধর্ম নিরপেক্ষতা” ।
ড. আনিসুজ্জামানের এই পরিভাষাটির অর্থ আমাদের রাজনীতিবিদরা হয়তো বুঝতে পারেননি বা একটি কম শিক্ষিত জনগোষ্টির রাজনীতিকদের অশিক্ষিত আচরণের ও চতুর প্রচারের বিরুদ্ধে যে ডিফেন্স নিতে হয়- হয়তো আমাদের রাজনীতিবিদরা এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেই ডিফেন্স নিয়েছিলেন।
বিষয়টি রাজনীতিবিদরা ব্যখা করার সাহস পাননি যে, রাষ্ট্র একটি ইহ-জাগতিক বিষয় বা আধুনিক মেশিনারী। রাষ্ট্রের সঙ্গে পারলৌকিক বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই। এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে পারলৌকিক বিষয়টি কাজে লাগে। পারলৌকিক বিষয়টি সম্পূর্ণ মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়।
আর ভাষার অর্থ বা পরিভাষা অবশ্যই ক্ষেত্র অনুযায়ী হবে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অনুবাদ করেছিলেন একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান। তাই সেখানে সেক্যুলারইজমকে তিনি “ধর্ম নিরপেক্ষতা” বুঝাতে রাষ্ট্র নাগরিকের সঙ্গে যে যে ধর্মে সংযুক্ত সেটাকেই মাথায় রেখে ছিলেন এবং ধর্ম শব্দের রুট অনুযায়ী অর্থাৎ যা মানুষ ধারণ করবে(আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যবহারিক জীবনে যা ধারণ করবে) তিনি সেটা মাথায় রেখেই এ পরিভাষা তৈরি করেছিলেন।
এখন আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবহারিক জীবনে নাগরিকের ধর্ম কীভাবে পরিচিত হবে, সেটা অর্মত্য সেন যেমন বলেছেন এ যুগে এসে- তেমনি চাইনিজ, ভারতীয়, রোমান ও মিশরীয়সহ সকল সভ্যতায় তাই বলে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার নাগরিকের ধর্ম (যা সে ধারণ করে আছে) ভাগ করবে কর্মগুনে বা কাজ অনুসারে। উদাহরণ হিসেবে অর্মত্য সেন যেমন বলেছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসও তাই বলে, রাষ্ট্র নাগরিকের ধর্ম বিচার করে পেশা অনুযায়ী। যেমন যে সাংবাদিক তার ধর্ম রাষ্ট্রের কাছে সাংবাদিকতা। যে গনিতজ্ঞ তার ধর্ম রাষ্ট্রের কাছে গনিতবিদ। যে যোদ্ধা তার ধর্ম রাষ্ট্রের কাছে সমরবিদ। যে ফসল উত্পাদান করে সে কৃষক। যে ব্যবসা করে সে ব্যবসায়ী বা বনিক বা বৈশ্য। যে রাজনীতি করে সে রাজনীতিবিদ, যে এনজিও করে সে এনজিও লিডার বা কর্মী। যে লেখক- রাষ্ট্রের কাছে তার ধর্ম লেখক। যে বিচারকাজের সঙ্গে জড়িত তার ধর্ম বিচারক। যে কোন রাষ্ট্রের পাসপোর্টও কিন্তু এভাবেই পরিচিতি দেয়। কোন পারলৌকিক ধর্মের পরিচিতি দেবার সেখানে কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু এই ব্যখায় এদেশের হাজার বছরের সব থেকে সাহসী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও যাননি। তিনিও তাতক্ষনিক ভোটের রাজনীতিতে দাঁড়িয়ে বার বার ব্যখা করেছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। অনেকটা কায়েদে আযম মোহম্মাদ আলী জিন্নাহ’র পাকিস্তান সৃষ্টির পরে পাকিস্তানকে তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্র বানানোর সেই বক্তব্যরই সুর সেখানে। জিন্নাহ বলেছিলেন, পাকিস্তান শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র নয়, এখানে হিন্দু তার মন্দিরে যাবে, মুসলিম তার মসজিদে যাবে, ক্রিশ্চিয়ান গির্জায় ও বৌদ্ধ প্যাগোডায়। কিন্তু এই পারলৌকিক বিষয় বা আচরণে তো রাষ্ট্রের কোন হাত নেই। এটা যে কোন মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্র দেখবে তার নাগরিকদের পেশাগত কাজ বা ধর্ম।
অবশ্য আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এই পারলৌকিক ধর্মকে যোগ করার কাজটি যে শুধু পশ্চাদপদ দেশে আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে যাদের ধারণা পরিস্কার নয় তারা করেছেন তা নয়, যারা আধুনিক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সেই পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরাও করছেন। যেমন হান্টিংটন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিমাদের সংঘাত বা মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংঘাতকে ব্যখা করেছেন সিভিলাইজেশানের সংঘাত হিসেবে ( Clash of Civilization)। হান্টিংটনের এই বক্তব্য বা মতামতকে ধারণ করেই ফরিদ জাকারিয়ার মতো সাংবাদিকও লেখকরাও কিন্তু মধ্য প্রাচ্য’র সংকটকে ব্যাখা করেন। কিন্তু মধ্য প্রাচ্যের সংকটের মধ্যে একটু গভীরভাবে ঢুকলে দেখা যাবে এটা মূলত পারলৌকিক ধর্মকে উপলক্ষ্য করে এক বনিক সংঘাত। আর উপলক্ষ্য যে পারলৌকিক ধর্ম তা কিন্তু ইরাক আক্রমনের সময় দেয়া বক্তব্যে বুশ বলেছিলেন, “ এটা নিউ ক্রসেড”। তাই উন্নত বিশ্বও কিন্তু সচেতন বা অবচেতনভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে পারলৌকিক ধর্মকে যোগ করিয়ে দিচ্ছেন। এখানে তাদের যে স্বার্থ আছে সে বিষয়ে লিখতে গেলে লেখা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। তাই যাদের নিজস্ব কোন উপলব্দ মনোজগত নেই – যারা পশ্চিমা এই সুবিধাবাদী চিন্তাধীন বা পারলৌকিক বিশ্বাসে নির্ভর মনোজগতের অধিকারী তারা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে চিন্তার ভূমিতে দাঁড়িয়ে “ ধর্ম নিরপেক্ষতা” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন যা গ্রীক সভ্যতা থেকে চাইনিজ সভ্যতা অবধি এনডোরস করে সেটা তাদের পক্ষে উপলব্দি করা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের থেকে অনেক বড় ফরিদ জাকারিয়াও হানিংটনের ব্যাখাকে মেনে নিচ্ছেন।
সাংবাদিক ও সমাজবিজ্ঞানী আবুজাফর শামসুদ্দিন আমাদের সাধারণ সমাজও তাদের চিন্তাকে চিনতেন। তাই তিনি মনে করেছিলেন, “ ইহ- জাগতিকতা” শব্দটি ব্যবহার করলে হয়তো রাজনীতিবিদদের আধুনিক রাষ্ট্র নিয়ে পারলৌকিক ধর্মের সঙ্গে ভোটের রাজনীতি বা অন্য অনেক কিছুতে সুবিধা হবে। আসলে তাঁর এ চিন্তা কতটা কাজ করতো তা সঠিক বলতে গেলে বাস্তবে সমাজের সাধারনের চিন্তার স্তর নিয়ে গবেষণার দরকার। আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, শ্যামাপ্রসাদ ও মুসলিমলীগের রাজনীতি মিলে এ উপমহাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যেভাবে পারলৌকিতার বিশ্বাসকে যোগ করিয়ে দিয়ে গেছেন তা থেকে একটি পশ্চাদপদ, মু্ক্ত শিক্ষাব্যবস্থাহীন জনগোষ্টি’র বের হয়ে আসা সহজ নয়। তাছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতার লোভ আধুনিক মানুষকেও মুহূর্তে বদলে দেয়- তারাও যে কোন ধরনের পপুলিজমকে গ্রহন করার জন্যে মুহূর্তে বিবেককে নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দেয়। যা অন্য কোন অসততার থেকেও ভয়াবহ। তবে এ সব কিছু বাধা পার হতে বা হবার জন্যে রাষ্ট্রের নীতি অবশ্যই নাগরিকের ইহজাগতিক ধর্মের অর্থাৎ পেশাগত ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এ না হলে যে কোন আধুনিক রাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার সকল পেশায় বন্ধাত্ব এনে নিজেই রাষ্ট্রকে একটি অন্ধকারের পথে ঠেলে দেবে।
অন্যদিকে ন্যাশনালইজম বা জাতীয়তাবাদও কখনই কোন উগ্র বিষয় বা ভাষা ও অন্য কোন একক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না। জাতীয়তাবাদ সব সময়ই একটা কনসেফসুয়াল বিষয়। যা ভৌগলিক সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি হয়। যে কারণে কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদ, মিশরীয় জাতীয়তাবাদ, ইরানী জাতীয়তাবাদ, চায়নিজ জাতীয়তাবাদ, রুশ জাতীয়তাবাদ, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ। আর একে যে কোন পারলৌকিক চিন্তার বর্ণবাদ বা ধর্মীয়বাদের মধ্যে ঢোকানো যায় না তা তো হিটলারের প্রাসা শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণবাদের ব্যর্থতাই ইতিহাসের সব থেকে বড় প্রমান।
আর জাতীয়তাবাদ সব সময়ই ভৌগলিক সিভিলাইজেশান নির্ভর কনসেফসুয়াল এ কারণে আরবে আরব জাতীয়তাবাদ হতে হচ্ছে, ভারতে হিন্দুত্ব’র রমরমা অবস্থাতেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ থাকতে হচ্ছে- যেহেতু জাতীয়তাবাদ সিভিলাইজেশান নিঃস্মৃত সংস্কৃতিকে ধারণ করে- তাই সেখানে ডাইভারসি থাকতে হয়। পারলৌকিক বিষয়গুলো একটি বিশেষ বিশ্বাসে- সেখানে সার্বিক ডাইভারসির স্থান নেই। যে কারণে ভারতে যেমন কখনই হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে না- তাদেরকে ভারতীয় কনসেফসুয়াল জাতীয়তাবাদকেই ধারণ করতে হবে। রুশরা জাতীয়তাবাদ উড়িয়ে দিয়ে কমিউনিজমের মতো একমূখী চিন্তায় বেশি দিন থাকতে পারলো না- ঐতিহ্যবাহী রুশ সিভিলাইজেশান নির্ভর জাতীয়তাবাদে তাদের ফিরতে হয়েছে। চায়নিজরা কমিউনিজমকে ধারণ করলেও কখনও চায়নিজ সিভিলাইজেশানের জাতীয়তার গর্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়নি। যে কারণে সেখানে তথাকথিত রাষ্ট্রীয় কালচারাল রেভ্যুলেশান শুধু ব্যর্থ হয়নি পৃথিবীর জন্য উদাহরণও সৃষ্টি করেছে, কালচার সিভিলাইজেশানের চলার পথের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কালচার তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে সিন্ধ, পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের সিভিলাইেজেশান নির্ভর বিশাল কালচারাল জাতীয়তাবাদ থাকা সত্ত্বেও পারলৌকিক বিশ্বাসী রাষ্ট্র করতে গিয়ে আজো অবধি কোন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ হয়নি। এবং হবেও না। যে কারণে জাতীয়তাবাদটি সিভিলাইজেশাসনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা থেকে উদ্ভূত একটি সংস্কৃতিজাত এবং মানব সভ্যতার সহজাত বিষয়। একে বাদ দেবার ক্ষমতা যেমন কোন রাষ্ট্র ক্ষমতার নেই আবার একে সৃষ্টি করার ক্ষমতাও কোন রাষ্ট্র ক্ষমতার নেই। রাষ্ট্রক্ষমতা কি বা কতটুকু তার আয়ু -তা রবীন্দ্রনাথের ছন্দবদ্ধ প্রকাশ কি যথেষ্ট নয়, “ রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে,/ সিংহাসন গেছে টুটে/ তব সৈন্য দল/ যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল/ তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে/ উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-‘পরে।/
কিন্তু শুধু দিল্লি নয়, দিল্লি, কায়রো, রোম ও বেইজিং এর পথে পথে হাজার হাজার বছরের সিভিলাইজেশানজাত সংস্কৃতি নির্ভর জাতীয়তার গৌরব বাতাসে ঠিকই চিরকালের ধারাবাহিকতায় বহমান- যেমন বহমান-পদ্মা, মেঘনা যমুনা বিধৌত এই বাংলায়। এখানে নদীর নাম কীর্তিনাশা, অনেক কীর্তি নাশ করে ফেলে কিন্তু তার জলের ধারা ঠিকই বহমান থাকে একই গতিতে। আর সেই ধারা সভ্যতা থেকে উৎসারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply