ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
হজমজনিত রোগ হল পরিপাকতন্ত্রের ব্যাধি, যাকে কখনও কখনও গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (জিআই) ট্র্যাক্ট বলা হয়।হজমের ক্ষেত্রে, খাদ্য ও পানীয় ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয় (যাকে পুষ্টি বলা হয়) যা শরীর শোষণ করতে পারে এবং কোষের জন্য শক্তি এবং বিল্ডিং ব্লক হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। পাচনতন্ত্র খাদ্যনালী (খাদ্য নল), পাকস্থলী, বৃহৎ ও ছোট অন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয় এবং গলব্লাডার নিয়ে গঠিত।
> পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার প্রথম লক্ষণে প্রায়ই নিম্নলিখিত এক বা একাধিক উপসর্গ থাকে:
রক্তপাত, ফোলা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, অম্বল, অসংযম, বমি বমি ভাব এবং বমি, পেটে ব্যথা, গিলতে সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস। একটি হজম রোগ হল যে কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা যা পরিপাকতন্ত্রে ঘটে। অবস্থা হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে। কিছু সাধারণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে অম্বল, ক্যান্সার , ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম এবং ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা ।
> অন্যান্য হজম রোগের মধ্যে রয়েছে: পিত্তথলির পাথর, কোলেসিস্টাইটিস এবং কোলেঞ্জাইস
> খাদ্যনালীর সমস্যা, যেমন স্ট্রাকচার (সঙ্কুচিত), অচলাসিয়া এবং খাদ্যনালীর প্রদাহ গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার (সাধারণত হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণের কারণে হয়) এবং ক্যান্সার সহ পেটের সমস্যা।
> লিভারের সমস্যা, যেমন হেপাটাইটিস বি বা হেপাটাইটিস সি , সিরোসিস , লিভার ফেইলিউর এবং অটোইমিউন এবং অ্যালকোহলযুক্ত হেপাটাইটিস। প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং অগ্ন্যাশয় সিউডোসিস্ট অন্ত্রের সমস্যা, যেমন পলিপ এবং ক্যান্সার, সংক্রমণ, সিলিয়াক ডিজিজ , ক্রোন ডিজিজ , আলসারেটিভ কোলাইটিস , ডাইভারটিকুলাইটিস , মালাবসর্পশন, শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোম এবং অন্ত্রের ইস্কেমিয়া।
> হজমের সমস্যার জন্য পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে কোলনোস্কপি , আপার জিআই এন্ডোস্কোপি , ক্যাপসুল এন্ডোস্কোপি, এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোল্যাঞ্জিওপ্যানক্রিটোগ্রাফি (ইআরসিপি), এবং এন্ডোস্কোপিক আল্ট্রাসাউন্ড ।
সাধারণত হজমশক্তি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। যাঁদের খাবার ঠিকমতো হজম হয় না, তাঁরা সঠিক খাদ্যাভাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে হজমশক্তি সবল করা সম্ভব।
>হজমশক্তি বাড়ানোর সহজ উপায়গুলো হলো:-
১. খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে। যিনি যত ভালোভাবে চিবিয়ে খাবার খান, তাঁর পাচকরস নিঃসরণ তত ভালো হয়। এসব পাচকরস খাবারকে সঠিকভাবে হজম করতে সহযোগিতা করে।
২. খাবারের সঙ্গে লেবু রাখতে পারেন। লেবু খুব সহজে খাবার হজম করতে সাহায্য করে। চাইলে খাওয়ার পর লেবুপানি খেতে পারেন।
৩. প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খান। ক্যালসিয়াম আমাদের হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। অনেকেই ল্যাকটোজেন অসহিষ্ণুতার কারণে দুধ খাওয়া একেবারে ছেড়ে দেন। এ ক্ষেত্রে দুধ খাওয়া একেবারে না ছেড়ে অল্প করে খাওয়ার অভ্যাস রাখা উচিত। অথবা ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ খেতে পারেন।
৪. দুধের বিকল্প হিসেবে দই খেতে পারেন। হজমশক্তি বাড়াতে দই খুব সহায়ক। এতে অন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। ক্যালসিয়াম ও প্রোটনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এটি হজমে সাহায্য করে।
৫. গ্রিন টি বা পুদিনাপাতার চা পান করতে পারেন দিনে দুইবার। এতে বিদ্যামান অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট খাবার হজমে সাহায্য করে।
৬. খাদ্যতালিকায় আঁশযুক্ত খাবার বেশি রাখুন। আঁশযুক্ত খাবার সহজে পানি শোষণ করে, হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নিয়মিত শাকসবজি, ফল, সালাদ, চিয়া সিড, ইসবগুল খেতে পারেন। পানির পরিমাণ বেশি রয়েছে, এমন ফল ও সবজি, যেমন তরমুজ, বাঙ্গি, শসা, টমেটো, লাউ ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় বেশি রাখুন।
৭. পানি ছাড়া কোনো খাবারই সঠিকভাবে হজম হয় না। দৈনিক ১০-১২ গ্লাস পানি পান করুন। তবে খাওয়ার আগে এবং খাওয়ার মধ্যে অতিরিক্ত পানি পান করা যাবে না। এতে বদহজম হয়।
৮. রাতের খাবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত আটটার মধ্যে খেয়ে ফেলা ভালো। গভীর রাতে খাবার খাওয়া যাবে না। খেয়েই ঘুমানো যাবে না। ঘুমনোর ২ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার গ্রহণ করুন।
৯. নিয়মিত ব্যায়াম করলে খাবার সঠিকভাবে হজম হয়। সারা দিনে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম, যেমন হাঁটাহাঁটি, জগিং ও সাইক্লিং করার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে পেটে চাপ পড়ে, এমন ব্যায়াম করলে হজম ত্বরান্বিত হয়। পাশাপাশি শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়ামও জরুরি। এতে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয়।
১০. সারা দিনে ৭–৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম প্রয়োজন। রাতজাগা চলবে না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে হজমপ্রক্রিয়ার উন্নতি হয়।
১১. মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে।
১২. অতিরিক্ত তেল, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ভাজাপোড়া এড়াতে হবে।
১৩. ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
লেখক, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
Leave a Reply