শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

বিশ্ব তথ্য সুরক্ষা দিবস : নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত হোক এইজন্যই পূর্ণাঙ্গ আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ৩.৫৫ পিএম
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
আজ মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বিশ্বব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে ডাটা প্রাইভেসি ডে বা তথ্য সুরক্ষা দিবস ২০২৫। প্রতি বছর এই দিবস উপলক্ষে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে বিশ্বে নানান রকম ক্যাম্পেইন চালানো হয়,১৯৮১ সালে ইউরোপের বৃহৎ সংগঠন ‘কাউন্সিল অব ইউরোপে’ কনভেনশন ১০৮ স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে বিশ্বে প্রথম ডাটা প্রাইভেসি ডে বা তথ্য সুরক্ষা দিবস উদযাপন শুরু হয়। ‘কনভেনশন ১০৮’ গোপনীয়তা ও তথ্য সুরক্ষা নিয়ে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি যা প্রতিপালনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ২৮ জানুয়ারি ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স (এনসিএসএ) এর নেতৃত্বে দিবসটি পালিত হয়। ইউরোপে উদযাপন শুরু হওয়া তথ্য সুরক্ষা দিবস ২০০৮ সাল থেকে উত্তর আমেরিকায় পালন শুরু হয়। এই দিবসটি মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভোক্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার সর্বোত্তম কলাকৌশল ভাগাভাগি করার সুযোগ করে দেয়। ‘ডাটা প্রাইভেসি ডে’ বা তথ্য সুরক্ষা দিবস বিশ্বব্যাপী একটি বৃহত্তর ক্যাম্পেইনের অংশ, যেখানে প্রাইভেসির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা হয়। তুলে ধরা হয় ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার সহজ সব পদ্ধতি। পাশাপাশি সংগঠনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, সব কাজে প্রাইভেসি গুরুত্বপূর্ণ। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, করপোরেশন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, পৌরসভা ও ব্যক্তি পর্যায়ে বাসাবাড়ি ও কর্মস্থলে সচেতনতা তৈরির ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক এই ক্যাম্পেইনে যুক্ত হয়েছে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন। সকল ‘ডাটা প্রাইভেসি ডে চ্যাম্পিয়ন’ই সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাইভেসি ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা সম্পর্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ বার্তা প্রচার করে। এর মধ্য দিয়ে তথ্য সুরক্ষা ও আস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সচেতনতা বিকাশের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে কাজ সংগঠনগুলো। আর আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অবিরাম তথ্য প্রবাহ তৈরি করছি।দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমসাময়িক সমীক্ষা ও প্রতিবেদনগুলিতে দেখা যাচ্ছে, আমরা ক্রমবর্ধমানভাবে নিজস্ব তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। বর্তমান বিশ্বে তথ্যই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যার কাছে যত অন্যের তথ্য আছে, সে তত বেশি সম্পদশালী। তাই বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার পরও ফেসবুক, গুগল, টুইটারের মতো সংস্থাগুলি দিন দিন বিশাল দৈত্যাকার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। এসব সংস্থা আমাদের তথ্য বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করে অর্থ কামাচ্ছে।সাধারণত তিন প্রকার তথ্য পাওয়া গেলে সেই তথ্যের মালিককে শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথমটি হচ্ছে ‘কে’—নাম, ফোন নম্বর, জাতি, লিঙ্গ, বয়স, উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি ‘কী’—শিক্ষার স্তর, রাজনৈতিক বিশ্বাস, পেশা, বৈবাহিক অবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম ইত্যাদি। তৃতীয় প্রকারটি ‘কোথায়’—শপিংয়ের জায়গা, কাজের জায়গা, প্রার্থনার জায়গা ইত্যাদি, এককথায় বিচরণক্ষেত্র।এই তিন প্রকার তথ্য এক সুতায় বাঁধলে সহজেই একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ জন্য একে বলা হয় ব্যক্তিগত শনাক্তযোগ্য তথ্য (পারসোনাল আইডেন্টিফায়েবল ইনফরমেশন—পিআইআই) আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিন্সির অনুমান অনুযায়ী শুধু ব্যক্তিগত অবস্থানের তথ্যের মূল্য আগামী কয়েক বছরে আট লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। বিখ্যাত অ্যান্টিভাইরাস সংস্থা ম্যাকাফির হিসাব অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহারকারীর অনলাইন ক্রিয়াকলাপ ট্র্যাক করে এবং প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাপ লোকেশন তথ্য সংগ্রহ করে। বিশ্বব্যাপী ৭০০ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহকের ১ হাজার ৫০০ ধরনের বৈশিষ্ট্যের তথ্য ২০ হাজারের বেশি সার্ভারে জমা রেখেছে এবং প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে। এসব সংস্থা সম্পত্তির রেকর্ড, বিয়ের লাইসেন্স এবং আদালতের মামলা ইত্যাদি উৎস থেকে তথ্য সংকলন করে। তারা ব্যক্তির চিকিৎসার রেকর্ড, ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের ইতিহাস, সোশ্যাল মিডিয়া সংযোগ এবং অনলাইনে কেনাকাটার তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে।আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত তথ্য না বুঝেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা ভাবছি এটা নিরাপদ। কিন্তু ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্যই উন্মুক্ত। আপনি যাকে তথ্য দিচ্ছেন, হয় সে সেটা অন্যের কাছে বিক্রি করছে, অথবা হ্যাকাররা চুরি করে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে বা অন্যের কাছে বিক্রি করছে। হ্যাকার শুধু ব্যক্তি বা সংগঠিত গোষ্ঠীই নয়, রাষ্ট্র, দেশি–বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বা তাদের এজেন্টরাও হ্যাকিং করতে পারে।বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান, যাদের আপনি বিশ্বাস করে তথ্য দেন, তারা আপনার পুরোনো তথ্য মুছে ফেলে না। আপনি নিজের প্রোফাইল মুছে ফেলার পরও ফেসবুক সেটা তার সার্ভারে অনেক দিন রেখে দেয়। আর বলা হয়, গুগল কখনোই কারও কোনো তথ্য মোছে না। এই ধরনের সংস্থার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা লঙ্ঘন, ব্যবহারকারীর তথ্যের অনৈতিক ব্যবহারের অভিযোগে অনেক মামলা হয়েছে, প্রতিনিয়ত হচ্ছে।আমরা দিন দিন আরও ডিজিটালাইজড এবং আরও সংযুক্ত হচ্ছি। এটা কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। তাহলে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য কী করব? এর সহজ উত্তর হচ্ছে আমাদের সচেতন হতে হবে। অনলাইনে আমরা কী তথ্য তৈরি করছি এবং কীভাবে সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়, শেয়ার করা হয় এবং কীভাবে ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কোনো অ্যাপ্লিকেশন বা সংস্থা চাইলেই আপনার তথ্য দেওয়া ঠিক হবে না। আপনি যেসব উপকার পেতে পারেন, সেটা বিবেচনা করে আপনার তথ্য শেয়ার করবেন কি না, সে সম্পর্কে অবগত হয়ে সিদ্ধান্ত নিন। অনেক অ্যাপ্লিকেশন তাদের পরিষেবা ব্যবহার করার আগে ব্যবহারকারীর ভৌগোলিক অবস্থান, পরিচিতি তালিকা এবং ফটো অ্যালবামের অ্যাক্সেসের অনুমতি চায়।বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী,  দেশে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা টানা চার মাস ধরে কমেছে। এ সময় ৬১ লাখের বেশি মুঠোফোনের গ্রাহক সংখ্যা কমেছে। একই সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ লাখ।
গত রোববার (১ ডিসেম্বর) মুঠোফোন ও ইন্টারনেট গ্রাহক নিয়ে সর্বশেষ হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সেখানে অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব দেওয়া হয়েছে। ওই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর জুনে মুঠোফোনের সর্বোচ্চ গ্রাহক ছিল ১৯ কোটি ৬০ লাখের বেশি। এরপর গ্রাহক সংখ্যা কমতে থাকে। অক্টোবরে মুঠোফোনের গ্রাহক ছিল ১৮ কোটি ৯৯ লাখের বেশি।
শুধু মুঠোফোনের গ্রাহক সংখ্যা নয়, এ সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিটিআরসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, জুনে দেশে সর্বোচ্চ ১৪ কোটি ২১ লাখের বেশি ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল। এরপর থেকে টানা চার মাস গ্রাহক কমেছে। অক্টোবরে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল ১৩ কোটি ৭১ লাখের বেশি। উল্লেখ্য, ৯০ দিনে কেউ একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তাকে গ্রাহক হিসেবে ধরে বিটিআরসি।বিটিআরসির তথ্য বলছে, এই চার মাসে ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে মুঠোফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কমেছে। জুনে সর্বোচ্চ ১২ কোটি ৯১ লাখের বেশি মুঠোফোন ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল। অক্টোবরে এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৪ লাখের কিছু বেশিতে। তবে এ সময় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
মুঠোফোন অপারেটর ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সর্বশেষ বাজেটে মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সেবায়। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এতে প্রভাব ফেলেছে।
 ০৫ জানুয়ারী, ২০২৪ পর্যন্ত, ৫.৩০ বিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৬% এর সমান।গড় বিশ্ব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিদিন সাত ঘন্টা অনলাইনে ব্যয় করে।৩১ ডিসেম্বর,২০২৩ পর্যন্ত, ১.১৩ বিলিয়ন ওয়েবসাইট ছিল, যার মধ্যে ৮২% নিষ্ক্রিয় ছিল।৬.৪ সালে বিশ্বব্যাপী খুচরা ইকমার্স বিক্রয়ের পরিমাণ হবে $০২৪ ট্রিলিয়ন।আর জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় আট হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছেন, যেখানে ৫০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। এর ফলে একদিকে নারী-পুরুষের বৈষম্য, অন্যদিকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ও গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূর হচ্ছে। দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে ও স্টার্টআপদের উদ্ভাবনী সুযোগ কাজে লাগানোর পথ সুগম করতে সরকার আগামী পাঁচ বছরে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। মেধাবী তরুণ উদ্যোক্তাদের সুদ ও জামানতবিহীন ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট এবং ট্রেনিং, ইনকিউবেশন, মেন্টরিং এবং কোচিংসহ নানা সুবিধা দেওয়ার ফলে দশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। বিকাশ, পাঠাও, চালডাল, শিওর ক্যাশ, সহজ, পেপারফ্লাইসহ দুই হাজার ৫০০ স্টার্টআপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। যারা প্রায় আরো ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ১০ বছর আগেও এই কালচারের সঙ্গে আমাদের তরুণরা পরিচিত ছিল না। মাত্র সাত বছরে এই খাতে ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে।
বর্তমানে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে প্রত্যেক গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসা অর্থ আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে আধুনিক ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ সব কিছুই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল।
নারী-পরুষের সমান অংশগ্রহণ, ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিত করা, শহর ও গ্রামের সেবা প্রাপ্তিতে দূরত্ব হ্রাস করার সবই ছিল আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করা গেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন গ্রামে বসেই যে কেউ চাইলেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করতে পারছে। আর রবিবার আজকে আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেট ও আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ডিভাইসগুলোতে ব্যয় করছি। এখনও খুব কম মানুষই জানে যে, আমাদের ব্যবহৃত ডিভাইস ও অনলাইন সেবা থেকে অসংখ্য ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং তা শেয়ার করা হচ্ছে। এসব তথ্য অনির্দিষ্টভাবে গচ্ছিত করা হতে পারে এবং আমাদের ব্যক্তিগত এসব তথ্য উপকারে ব্যবহার করা হতে পারে আবার অবাঞ্চিতভাবেও ব্যবহার করা হতে পারে। এমনকি দেখা গেছে, অনলাইনে অনুপকারী তথ্য শেয়ার করার ফলেও তা আপনার আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আপনার প্রিয় রেস্টুরেন্ট অথবা অনলাইনে যেসব আইটেম আপনি ক্রয় করেছেন তা শেয়ার করা। আর আইনগত বিষয় শক্তিশালী আইনের অনুপস্থিতিতে দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি তাদের ইউজার ও ক্রেতাদের ব্যক্তিগত আচরণ পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছে এবং ভোক্তাদের এসব তথ্য তারা লাভের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে। ভোক্তাদের বোঝা প্রয়োজন যে তাদের তথ্যের সঠিক মূল্য আসলে কতটা এবং কিভাবে এই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তা শেয়ার করা হচ্ছে। এছাড়া তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা জানতে হবে।
>তথ্য চুরি ও রোধে প্রয়োজন সচেতনতা :-
ব্যক্তিগত বা পেশাগত যে কারণেই আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকুন না কেন, আপনাকে অনলাইন ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সচেতন না হলে অনলাইন মাধ্যমের বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীগণ যে কয়েকটি সম্ভাব্য বিপদের সম্মুখীন হতে পারে তার মধ্যে ‘তথ্য চুরি’ অন্যতম। বিভিন্নভাবেই ইন্টারনেট থেকে আপনার তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে। যেমন:
১। অরক্ষিত ওয়েবসাইট বা অনেকের ব্যবহৃত Wi-Fi-এ শেয়ার করা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
২। আপনার মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার চুরি হয়ে গেলে এসব ডিভাইস থেকেও ব্যক্তিগত তথ্য, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য ইত্যাদি চুরি হতে পারে।
৩। প্রতারকরা ইমেইল হ্যাকিং এর মাধ্যমে ব্যাংক এবং ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট, পূর্ব-অনুমোদিত ক্রেডিট কার্ড অফার, কর-প্রদান সংক্রান্ত তথ্য এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যের নাগাল পেতে পারে।
৪। বিভিন্ন থার্ড পার্টি সোর্স (উৎস) থেকে ব্যক্তিগত তথ্য কিনে নেওয়ার মাধ্যমেও প্রতারকরা অনেক স্পর্শকাতর তথ্যের নাগাল পেতে পারে।
৫। ইন্টারনেট তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মচারী, যার কাছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অ্যাক্সেস আছে, এমন মানুষের মাধ্যমেও আপনার ইন্টারনেটে দেওয়া তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে।
৬। একজন হ্যাকিং এর শিকার হলে, তার ডিভাইসের মাধ্যমে পরিবারের বা কর্মসংস্থানের অন্যান্য কর্মীদের তথ্য ও চুরি হতে পারে।
৭। থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি হয়ে যাওয়া বা বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮। ফিশিং এর মাধ্যমে তথ্য চুরি করতে পারে। অর্থাৎ এমন কোন সাইট বা লিঙ্কে আপনাকে নিয়ে গেলো যার মাধ্যমে আপনার ইমেইল, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি তথ্য চুরি করে তারপর আরও মূল্যবান তথ্য চুরি করে ফেলতে পারে।
৯। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারকৃত বিভিন্ন তথ্য পাবলিক করে রাখলে এসব তথ্য প্রতারকরা অনায়াসেই চুরি করে ফেলতে পারে।
১০। কোন অপ্রয়োজনীয় এবং নকল ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট তৈরি এবং ব্যক্তিগত তথ্য দিলে তথ্য চুরি হতে পারে।
১১। অনেক ওয়েবসাইট বা অ্যাপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী নয়, সেসব অনিরাপদ ওয়েবসাইট তথ্য দিলেও আপনার তথ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
মনে রাখবেন, সাইবার অপরাধীরা বিভিন্ন অবৈধ কাজে আপনার তথ্য ব্যবহার করতে পারে। এমনকি ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে টাকা চুরি, আপনার নামে ক্রেডিট কার্ড অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে বা নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে আরও বড় কোন অপরাধ করতে পারে। এর ফলে আর্থিক বা সামাজিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ভারও পড়তে পারে আপনারই ওপর। কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান ও সংরক্ষণে যত্নবান হওয়া একান্তই জরুরি। নিজে সতর্ক হবার পাশাপাশি প্রাসোঙ্গিক বিষয়গুলো আপনার শিশুকেও অবহিত করুন এবং সচেতন করুন ডিজিটাল দুনিয়ায় সতর্ক আচরণ করতে
> আইন
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২) নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ (অনুচ্ছেদ ১৭), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-এ প্রাইভেসিকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো আইনে নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনাই নেই। এখন সময় এসেছে তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কিভাবে বজায় থাকবে তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য তথ্য সুরক্ষা ও তথ্য সংরক্ষণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার আগে কোন তথ্যটি কেন, কী উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে তা অবশ্যই শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে ব্যক্তিগত তথ্য অবশ্যই ব্যক্তির সম্মতিতে সংগ্রহ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যারা তাদের গ্রাহক/ভোক্তার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে, তারা যাতে গোপনীয়তার নীতি মেনে চলে সে বিষয়ে সরকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা খুব জরুরি।
> প্রাইভেসি ও সিকিউরিটির মধ্যে পার্থক্য কী?
সিকিউরিটি বলতে- যেসব উপায়ে আমরা আমাদের নিজেদের, আমাদের সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষা করি তাকে বোঝায়। এটা অবাঞ্চিত অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম পর্যায়ের প্রতিরক্ষা। আর প্রাইভেসি বলতে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে বোঝায়।
পরিশেষে বলতে চাই, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কিভাবে বজায় থাকবে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধকে প্রতিহত করার জন্য আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেউ ইচ্ছা করলেই যাতে আরেক নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন করতে না পারে সেজন্য শক্ত আইন থাকা উচিত। আইন ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন মেনে চলার জন্য জনসচেতনতাও প্রয়োজন। শুধু আইন দিয়ে এই অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না। মানুষ নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে সজাগ হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লেখক, 
কলাম লেখক ও গবেষক 
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি। 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024