স্বদেশ রায়
কোন দেশে কোন সরকারই চিরকাল থাকে না বা থাকতে পারে না। এমনকি অতীতে যখন সাম্রাজ্য কায়েম হতো তারও পতন ঘটতো। পৃথিবীর অন্যতম শৃঙ্খৃল জনগোষ্টি বা রেজিমেনটেড মানসিকতার জনগোষ্টি চায়নায় “হান” , “সুং” ডায়নেস্টি বা সাম্রাজ্যও এক সময়ে শেষ হয়েছিলো। কুবলাই খানের ডায়নেস্টিও যেমন শেষ হয় চায়নায় তেমনি ভারতে ভারতীয়দের মৌর্য সাম্রাজ্য, ফারগানা থেকে আগত বাবুরের তৈরি মোগল সাম্রাজ্য সব কিছুরই অবসান হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতার মূল শক্তি জনগন সেখানে যে কোন সরকারের মেয়াদকাল একটা সময় গিয়ে শেষ হবেই। এ কারণে উন্নত দেশগুলো বা যাদের গণতন্ত্র উন্নত হয়েছে, জনগন শিক্ষিত ও সিভিলাইজড- সে সব দেশে কোন সরকার ক্ষমতায় যাবার থেকে তার ক্ষমতা থেকে এক্সিটের পথটিকে আরো মৃসন করে। এ যে শুধু সরকারের নিজের স্বার্থে তা নয়, দেশের স্বার্থে। কারণ, কোন সরকারের এক্সিট যদি মৃসনভাবে না হয় তাহলে ওই সরকারের ব্যক্তিরা বা দল যত বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের মানুষ, অর্থনীতি ও সার্বিক কালচার। যে কোন সরকারের অস্বাভাবিক প্রস্থান একটি দেশ, জাতি ও সমাজকে সব সময়ই একটি অন্ধকার টানেলে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। ওই টানেলের শেষপ্রান্তে এসে আলো পেতে ওই দেশ ও জাতিকে অনেক মূল্যদিতে হয় ; নষ্ট করতে হয় পৃথিবীর সবথেকে মূল্যবান বস্তু জাতীয় জীবনের ও মানুষের জীবনের “সময়” ।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের অস্বাভাবিক এক্সিট হয়েছে। সত্যি অর্থে বাংলাদেশের এই ৫৫ বছরের ইতিহাসে একমাত্র ২০০১ এ আওয়ামী লীগও জাতীয়পার্টির ঐকমত্যের সরকার ছাড়া আর কোন সরকারের স্বাভাবিক এক্সিট হয়নি। এর মূল কারণও সকলে জানে, কারণ এদেশের শুধু রাজনীতিকরা নন, সিভিল সোসাইটি এখনও একটি উন্নত দেশের মত কোনরূপ ক্ষমতা থেকে সম্মানজনক এক্সিটের পথে বিশ্বাসী হবার মতো সিভিলাইজড নন- সেটাই গত ৫৫ বছরে প্রমানিত হয়েছে। (যা শুধু সরকারি ক্ষমতায় নয় যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও।) এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে বা যাদেরকে দিয়ে সেনাপ্রধান সরকার গঠন করিয়েছেন, তারাও কিন্তু তাদের এক্সিটটা জনগনের কাছে শুধু নয়, দেশের রাজনৈতিক দলের কাছেও পরিস্কার করছেন না। আর এটাই আমাদের কালচার। এই কালচার আমাদের রাজনীতি ও পরিবারেও। পুরুষরা বেশি লেখেন বলে, শাশুড়ি- পূত্রবধু দ্বন্ধ আমাদের সাহিত্যে প্রকট। কিন্তু আসলে পিতা পুত্র ও শাশুড়ি পূত্রবধু দ্বন্ধ প্রায় সমানই। এরও মূলে রয়েছে ওই এক্সিট রুটে বিশ্বাসী না হওয়া। আর রাজনীতিতে সকলে হাসিনা ও খালেদার দোষ দেন। কিন্তু এদেশের অন্যতম দুই শিক্ষিত রাজনীতিক, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও কমরেড মনি সিং আমৃত্যু তাঁদের পার্টির প্রধান ছিলেন। তাই যেখানে গোটা সমাজ, পরিবার ও রাজনীতিতে এই কালচার সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যিনি যাবেন তিনি যে স্বাভাবিক সুন্দর এক্সিট রুটে বিশ্বাসী হবেন না সেটাই তো বাস্তবতা। তাই শেখ হাসিনার যে অস্বাভাবিক ভাবে ক্ষমতা থেকে পতন হয়েছে তা এদেশের কালচারে নতুন কিছু নয়। বরং এটাই অনিবার্য ও স্বাভাবিক ছিলো।
এখন ইতিহাসের যে কোন ঘটনা ঘটে যাবার পরে তার কারণ নিয়ে প্রকৃতভূমিতে দাঁড়িয়ে গবেষণা করতে হয়। ওই ঘটনাকে নিয়ে কখনও নিজস্ব স্বার্থে বা মনের মাধুরি মিশিয়ে কোন ন্যারেটিভ তৈরি করে তা চালু করার চেষ্টা করতে নেই। কারণ, ইতিহাসের ঘটনার যদি প্রকৃতভূমিতে দাঁড়িয়ে কোন জাতি গবেষণা না করে, বিজয়ীরা একটি ন্যারেটিভ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে জাতীয় জীবনের কালচার ও ভবিষ্যত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে বা অবস্থান করে।
শেখ হাসিনার পতনের কারণ হয়তো কোন এক সময়ে এদেশের প্রকৃত গবেষকরা ( আমেরিকায় মাস্টারি করা বা চায়ের দোকানের রাজনীতি’র আলাপকে জানা গবেষকের মূল যোগ্যতা নয়) এক সময়ে গবেষণা করবেন। তবে আমাদের মত সাধারণ সাংবাদিক যারা আমরা রাজপথে ঘুরে ঘুরে বাস্তবতা বোঝার উপলদ্ধি করার চেষ্টা করি তারা সকলেই শুধু নয়, এদেশের সাধারণ মানুষও স্বীকার করবেন, শেখ হাসিনার পতনের প্রধান কারণ তিনটি। একের পর এক ইনক্লুসিভ ইলেকশান না করা, শেষের দিকে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রন করতে না পারা এবং তাঁর সরকারে ও পার্টির নেতৃত্বে অযোগ্য লোকদের বসানো। শুধুমাত্র জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও আর ইনক্লুসিভ রাখা হয়নি তাঁর আমলে।
বাঙালি জাতি হিসেবে পশ্চাদপদ হলেও রেজিমেনটেড নয় আর্গুমেনটেটিভ। এই আর্গুমেনটেটিভ হওয়াতে বাঙালি ভোট দিতে এবং ভোটের আগে নানান তর্ক করতে পছন্দ করে। অবশ্য ভোট দেবার পরে তাদের যে ওয়াচ ডগের দ্বায়িত্ব পালন করতে হয় -ওই কালচারে বা সভ্যতায় বাঙালি এখনো পৌঁছায়নি।ভোট দিতে পছন্দ করা ও তা নিয়ে তর্ক করা যেহেতু তারা পছন্দ করে -তাই সে অধিকার তাকে দিতে হবে। তাছাড়া কোন জাতি একদিনে গণতান্ত্রিক হয় না। ধীরে ধীরে হলেও এই কালচার প্রতিষ্ঠিত করার দ্বায়িত্ব সমাজের ও রাষ্ট্রের সকল স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে রাজনীতিবিদদেরও । শেখ হাসিনা এক সময়ে এই কালচার প্রতিষ্ঠিত করার নেত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যাবার পর থেকে এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে তাঁর হাত দিয়েই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ইনক্লুসিভ নির্বাচন না করে এক পক্ষীয় নির্বাচন বা ক্রটি যুক্ত নির্বাচনের পথ ধরেন। আর এ ধরনের ক্রটি যুক্ত নির্বাচন করতে হলে বেশ কিছু স্বার্থন্বেষী স্টেক হোল্ডারদের সাহায্য নিতে হয়। যার ফলে সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে যায়। সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে গেলে স্বাভবিকই সরকার অর্থীনীতির ওপর নিয়ন্ত্রন হারায়। সেখানে সুবিধাবাদীরা ঢুকে পড়ে। যার ফলে অনেক অনিয়ম ঘটতে থাকে। বড় অনিয়মগুলো বড়দের ধাক্কা দেয় বা ম্যাক্রো ইকোনমিতে ধাক্কা দেয়। কিন্তু মানুষের গায়ে লাগে মাইক্রো ইকোনমির ধাক্কা অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষের দিকে এসে মধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্তের গায়ে ধাক্কা লাগতে শুরু করে।
আর পার্টি ও সরকারের নেতৃত্বে তিনি যাদের বসান সেটাই তাঁর পতনের জন্য যথেষ্ট ছিলো। কারণ, যে দলের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের হন এবং সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও তথ্যমন্ত্রী আরাফাত হন- ওই দল ও সরকারের পতন তখন শুধু মাত্র সময়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এদের কাজ দ্রুতই সরকার প্রধান বা দলীয় নেতাকে রোমান ঐতিহাসিক “টাকিটাস” বর্নিত সেই ফাঁদে নিয়ে যায়। অর্থাৎ এদের কাজ ও কথাবার্তা সরকার ও সরকার প্রধানকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যে তখন সরকার ও সরকার প্রধান অ-জনপ্রিয় হয়ে যায়। আর সরকার ও সরকার প্রধান একবার অজনপ্রিয় হলে- সরকারের যে কোন ভালোকাজ, ভালো কথাও মানুষের কাছে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়। শেখ হাসিনার দলের এই সব নেতা ও মন্ত্রীরা তাকে সেই টাকিটাস ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলেন।
বর্তমান ইনট্রিম এডমিনিস্ট্রেশানও কিন্তু ইতোমধ্যে একই “টাকিটাস” ফাঁদে পড়ে গেছেন। তাদের কয়েক উপদেষ্টা ও সরকারের প্রাইভেট বাহিনীর কয়েক নেতার দৌরাত্ম্য কিন্তু এই সরকারের অধিকাংশ বিষয়কে খারাপ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে জনগন। যার ফলে যারা শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী গণ আন্দোলনের একটিভিস্ট ছিলেন, তারা যে পদ পদবী পেয়েছেন তা রক্ষার জন্য শংকিত হয়ে হোক আর তাদের নিজ নিজ বিবেচনা থেকে হোক, বার বার হুশিয়ার করছেন, দেশের মানুষকে “ ফ্যাসিস্ট” ও তাদের সমর্থকরা ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ এখন বলছে “ আগেই ভালো ছিলাম”, “ শেখ হাসিনা ছাড়া এ দেশ চালানো সম্ভব নয়”- এসব কথা বন্ধ করতে হবে।
আর এই বন্ধ করার জন্যে তারা প্রতি নিয়ত হার্ড পাওয়ার ব্যবহার করছে। যেমন শেখ হাসিনাও করেছিলেন। বাস্তবে হার্ড পাওয়ারের যে কোন শক্তি নেই তা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও যেমন প্রমানিত হয়েছে- এই সরকারও প্রমান করে দেখতে পারে হার্ড পাওয়ারের থেকে সফট পাওয়ার অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের বেশি কিছু করার দরকার নেই- তারা গ্রেফতার না করে, বিচারের আওতায় না এনে শুধু মাত্র ওয়াবদুল কাদের, হাছান মামুদ ও আরাফাতকে দেশের ভেতর স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করতে দিক। ওবায়দুল কাদের এক সপ্তাহ নিয়মিত তার ফেসবুকে আগের মতো ছবি আপলোড করুক, আর হাছান মাহমুদ ও আরফাতকে সরকার বিটিভিতে নিয়মিত কথা বলতে দিক। এক সপ্তাহ হয়তো বেশি কম সময় হয়ে যাবে দুই সপ্তাহের মধ্যেই কিন্তু এই যে কথা এখন অনেক মানুষের মুখে মুখে “ আগেই ভালো ছিলাম” , “ শেখ হাসিনা ছাড়া এ দেশ চালানো সম্ভব নয়” এ কথা হাওয়া হয়ে যেতে থাকবে।
তাই বর্তমান সরকারের যিনি প্রধান উপদেষ্টা ( যিনি সম্পাদক নুরুল কবিরকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, তিনি অবশ্য ভেবে দেখেননি, তিনি কাকে উপদেশ দেন) তাকে এবং এই সরকার মূলত যিনি গঠন করেছেন সেই সেনাবাহিনীর প্রধানকে অবশ্যই সরকারের ও সরকারের প্রাইভেট বাহিনীর ওই সব ব্যক্তিদের থামাতে হবে – যারা এ মুহূর্তে দেশকে একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশানের পথে নিয়ে যাবার বাধা হয়ে নানান তত্ত্ব হাজির করছেন- এমনকি দেশের মূল অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ ও তার ডিক্লারেশান অফ ইনডিপেনডেন্স ( যা সংবিধানের জেনিসিস) নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ।
সর্বোপরি এ সত্য স্বীকার করতে হবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ সংকটে। দ্রব্যমূল্য’র অস্বাভাবিকতা, কর্ম সংস্থান নষ্ট হয়ে যাওয়া, লাখ লাখ লোক বেকার হওয়া সব মিলে জাহাজ এখন নাবিকহীন অবস্থার মতো অনেকটা মধ্য সাগরে ঘুরপাক খাঁচ্ছে।
দেশের এই মধ্য সাগরে ঘুরপাক খাওয়া এবং বর্তমান সরকারের আচরণ ও সরকারের তথাকথিত স্পোকসম্যান এবং নাজির উজিরদের বক্তব্য ও কাজ দেশকে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও সর্বোপরি ইনক্লুসিভ ইলেকশান থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেটা কোন অবস্থানে চলে গেছে তা বিএনপির জেনারেল সেক্রেটারি ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারই প্রমান করে, তিনি ঈংগিতে হলেও স্পষ্ট ভবিষ্যতটি বলে দিয়েছেন, “ সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে” ।
বাস্তবে প্রকৃত নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী সরকার ছাড়া বর্তমানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে ইনক্লুসিভ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর ইনক্লুসিভ নির্বাচন ছাড়া কোনরূপ এক পক্ষীয় নির্বাচনের মাধ্যমে কোন সরকার গঠন করার চেষ্টা করার আগে দূর ইতিহাস নয়, শেখ হাসিনার মতো মাইটি লিডারের পরিনতির ইতিহাসের দিকে রাজনীতিতে অনঅভিজ্ঞ এবং জীবনের অভিজ্ঞতাহীন যারা ক্ষমতায় আছেন তাদেরকে ভেবে দেখতে হবে। বিষয়টি আরো গভীরভাবে নিতে হবে যারা বা যিনি এই সরকার গঠন করেছেন।
কারণ, এই সরকার ইতোমধ্যে পুলিশ হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে, সংখ্যালঘু হত্যা ও নির্যাতনকে অস্বীকার করে -সর্বোপরি দেশকে চাঁদাবাজির অবাধ ক্ষেত্র তৈরি করে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী আন্দোলন ঘিরে তারা যে গ্রাফিতি এঁকেছিলেন তার রঙ ম্লান করে দিয়েছেন। এখন অন্তত তারা এ দেশে একটি মৃসন এক্সিটের পথ তৈরি ও ইনক্লুসিভ ইলেকশানের পথের বাধা না হলেই দেশ স্থিতিশীলতার পথে যাবার পথ খুঁজে পাবে। আর সে কাজটি যত দ্রুত হবে ততই দেশের মানুষের জন্য কল্যানকর।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply