সত্যেন্দ্রকুমার বসু
পাঠক কল্পনা-নেত্রে এই মরুভূমি দেখুন, আর দেখুন একজন যাত্রী সম্পূর্ণ একাকী, অজানা, অচেনা দূর এক ভারতবর্ষের অভিমুখে বিপদসংকুল মরুভূমির পথে চলেছেন- তাঁর পথপ্রদর্শক কেবল মৃত যাত্রীদের অস্থি, সঙ্গী একমাত্র তাঁর নিজের দেহের ছায়া তাঁর সান্ত্বনার একমাত্র সামগ্রী ধর্মশাস্ত্রের বাক্যাবলী, আর তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ভারতে গিয়ে নানা ধর্মমতের তুলনা করা আর ধর্মশাস্ত্রের পাঠোদ্ধার।
তিনি শুনেছিলেন ‘বন্য অশ্বের প্রস্রবণ’ নামে একটি প্রস্রবণ আছে। কিন্তু সে প্রস্রবণ তিনি খুঁজে পেলেন না। জলের কমণ্ডলু তুলে জলপান করতে গেলেন। ভারী কমণ্ডলু তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল। সব জলই নষ্ট হল। তার পর পথেরও গোলমাল হয়ে গেল। ঠিক পথ আর বুঝতে পারলেন না। হতাশ হয়ে আবার চতুর্থ প্রেক্ষাস্তম্ভের দিকে ফিরলেন। কেবল এই একবার মাত্র প্রতিজ্ঞা থেকে তিনি বিচলিত হয়েছিলেন।
কিন্তু চার ক্রোশ গিয়ে তিনি আবার ফিরলেন। ‘প্রথম থেকেই আমি পণ করেছি যে, ভারতবর্ষে না পৌঁছতে পারলে চীনের দিকে আমি এক পা-ও ফিরাব না। পূবদেশে ফিরে গিয়ে বাস করার চাইতে বরং পশ্চিম দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃত্যু হোক- সেও ভালো।’ এই বলে তিনি তাঁর ঘোড়ার মুখ ফেরালেন আর বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরকে মনে মনে স্মরণ করে আবার উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেন।
চারদিকে অনন্তস্পর্শী সমতল ছাড়া জনপ্রাণীও দেখতে পেলেন না। রাত্রে অপচ্ছায়ারা চারিদিকে আলো জ্বালাত। দিনে ভীষণ ঝড়ে মরুভূমির বালির বৃষ্টি হত। এই সমস্ত বিপদে তিনি নির্ভীকভাবে পথ চলতেন। কিন্তু অসহ্য তৃষ্ণার কষ্টে তাঁর চলা অসম্ভব হল। পাঁচ দিন, চার রাত এক ফোঁটা জলও তিনি পান করতে পারলেন না। অসহ্য তৃষ্ণায় পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত যেন জ্বলে যেতে লাগল।
দুর্বল হয়ে তিনি মরুভূমিতে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু অবলোকিতেশ্বরের নাম গ্রহণ করতে বিরত হলেন না। প্রার্থনা করলেন, ‘আমার এই যাত্রায় আমি ধন মান যশ কিছুই আকাঙ্ক্ষা করি না। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য সম্যক জ্ঞান আর সত্য ধর্মশাস্ত্রের অন্বেষণ। হে বোধিসত্ত্ব, সংসারের দুঃখ থেকে জীবকে উদ্ধার করবার জন্যে আপনার হৃদয় সর্বদাই ব্যগ্র। আমার দুঃখ কি আপনি দেখছেন না?’
চলবে
Leave a Reply