সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
১. শ্রমঘন্টা হারারে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪.৮ শতাংশ
২. ২০৫০ এর মধ্যে বাস্তুচ্যূত হবে ২ কোটি মানুষ
৩. পোষাক বানিজ্যে প্রতিযোগীতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে
৪. দেশের ২২ শতাংশ মানুষ সামাজিক সুরক্ষার বাইরে
একটি গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮ শতাংশ হারাবে।
এছাড়াও, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে বলে গবেষণাটি উল্লেখ করেছে। গবেষণাটি “বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত জলবায়ু পরিবর্তন” বিষয়ক বিশ্লেষণে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, তবে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, আন্তর্জাতিক পোশাক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে পরিচালিত কারখানাগুলো থেকে পোশাক ক্রয় কমাতে পারে বা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এফএসজি, এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশন এবং লডস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে, যা গতকাল ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলে বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের আয়োজিত এক আলোচনায় প্রকাশিত হয়।
গবেষণার দুই লেখক সুজাতা রাঠি এবং অকশায় কোহলি – এফএসজির পরিচালক এবং সহযোগী পরিচালক – আলোচনায় এই তথ্য উপস্থাপন করেন। আলোচকরা মূলত পোশাক ও নির্মাণ খাতে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেন।
এক পার্শ্ব আলোচনা থেকে জানা যায়, পোশাক খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি মাত্র ২ শতাংশের নিচে, যেখানে প্রতিযোগী দেশগুলো এই খাতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে।
আলোচনায় পোশাক রপ্তানিকারক, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তারা, ইউনিয়ন নেতারা, পোশাক কারখানার মালিক এবং দেশি-বিদেশি গবেষকরা অংশ নেন।
বাংলাদেশের শিল্প খাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পোশাক ও নির্মাণ খাত, যা ১.২ কোটি মানুষকে কর্মসংস্থান দিচ্ছে এবং জিডিপির ৩৪ শতাংশ অবদান রাখছে। তবে এই দুটি খাত দেশের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী, যা ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
পোশাক ও নির্মাণ খাত, যা ইট উৎপাদন, সিমেন্ট এবং স্টিল শিল্প অন্তর্ভুক্ত করে, শিল্প রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি খাত শিল্প খাতের মোট অবদানের ৭৪ শতাংশ ধারণ করে এবং দেশের মোট নির্গমনের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী।
শিল্প শ্রমিকরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শিল্প খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মী অনানুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত, যাদের গড় মাসিক আয় ১৩,৫৬৮ টাকা (১৪০ ইউরো), যা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির চেয়ে ৪০ শতাংশ কম।
বাংলাদেশের মাত্র ২২ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রয়েছে, তবে অধিকাংশ কর্মসূচি শিল্প শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে না। গবেষণাটি পরামর্শ দিয়েছে যে, শ্রমিক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে তারা কোম্পানি ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। একই সময়ে, বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ১৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের শারীরিক ঝুঁকি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্বন নির্গমন হ্রাসের প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ তার উন্নয়নধারা বজায় রাখতে পারবে এবং টেকসই অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
পোশাক ও নির্মাণ খাত বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত শিল্প রূপান্তরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতগুলো শিল্প খাতের মোট অবদানের ৭৪ শতাংশ ধারণ করে এবং শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান জোগান দেয়। এছাড়া, এই দুই খাত বাংলাদেশের মোট ক্ষতিকর নির্গমনের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী।
একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা জরুরি, যেখানে সরকারী সংস্থাগুলি, শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি ও তাদের প্রতি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কম-কার্বন ও জলবায়ু সহনশীল অর্থনীতির দিকে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর সম্ভব হবে।
রাঠি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন, যেগুলোর উপর বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেগুলো হলো: কম-কার্বন উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ, পুনর্ব্যবহৃত উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধি, কর্মস্থলে জলবায়ু অভিযোজন বাড়ানো, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ, পর্যাপ্ত শ্রমিক আবাসন নিশ্চিত করা, আর্থিক সমাধান উদ্ভাবন এবং স্থানীয় কোম্পানি ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
কোহলি বলেন, বিশ্বব্যাপী টেকসই ফ্যাশনের চাহিদা বাড়ছে, কারণ ভোক্তারা প্রকৃতির সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তাই, বাংলাদেশকে তার কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে বিশ্ববাজারে আরও বড় অংশীদার হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি হলেও, সবুজ অর্থায়নে আমাদের বিনিয়োগ এখনো কম, যা বাড়ানো উচিত।”
Leave a Reply