এই সপ্তাহে চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। অনেকেই একে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো স্পুটনিক স্যাটেলাইটের সঙ্গে তুলনা করছেন—যে ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, সোভিয়েতরা বুঝি প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট-এ আমার সর্বশেষ কলামে আমি লিখেছি যে ডিপসিকের এই সাফল্য আসলে স্পুটনিকের চেয়েও বড় ব্যাপার। স্পুটনিক মহাকাশ প্রতিযোগিতার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল, তবে তখন খুব কম মানুষই মনে করতেন সোভিয়েত অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার বহুমুখী প্রয়োগের কারণে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে—ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, সামরিক খাতসহ আরও বহুদিকেই এর ব্যবহার ছড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী এআই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে সর্বাধুনিক মাইক্রোচিপ সরবরাহ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছে, যাতে চীন এআই প্রযুক্তিতে সহজে অগ্রসর হতে না পারে। কিন্তু ডিপসিকের নতুন এআই চ্যাটবট দেখে প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই চেষ্টায় আসলে কতটুকু সফলতা মিলবে।
একই সঙ্গে এটাও ভাবার বিষয় যে, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা দেবে? যদি এসব পদক্ষেপের ফলে চীন সর্বোচ্চ এক বা দেড় বছর—এমনকি কয়েক মাস—পিছিয়ে থাকে, তাতে কী সত্যিই দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে? বরং চীনের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সরবরাহে বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি খাতই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি বিচ্ছিন্ন বৈশ্বিক অর্থনীতি গড়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগীদের মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়বে। টেসলা কি সর্বোচ্চ উদ্ভাবনের পথে এগোতে পারবে, যদি তারা চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না থাকে?
ডিপসিকের বিজয়, পরাজয় ও শিক্ষা
ডিপসিকের সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হয়তো বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এটি বেশ ইতিবাচক। দ্য ইকোনমিস্ট তাদের সাম্প্রতিক সংখ্যায় উল্লেখ করেছে, “ডিপসিক-সংক্রান্ত এই নাটকীয় খবর থেকে হারে-জিতের হিসাব করলে দেখা যাবে, হারার চেয়ে লাভের পাল্লাই বেশি।” প্রযুক্তি খাতেরই কিছু কোম্পানি উপকৃত হবে। যেমন অ্যাপল তাদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্তে হয়তো সন্তুষ্ট যে, অতি দ্রুত এআই সক্ষমতা তৈরির চেষ্টায় তারা এত বিপুল অর্থ ঢালেনি।
এছাড়া ফ্রান্সের মিস্ত্রাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের টিআইআই-য়ের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট ল্যাবগুলো এখন সমানতালে নিজেদের উদ্ভাবনকে ডিপসিকের সাফল্যের ধারায় নিয়ে যেতে চাইবে, বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইবে। তাছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধির ফল হিসেবে এআই ব্যবহারে আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে ব্লুমবার্গ ওপিনিয়নের কলামিস্ট ক্যাথরিন থরবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি মহলের প্রতি কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলেছেন যে সিলিকন ভ্যালিতে উদ্ভাবনের অভাব নেই, তবে সেখানকার অনেকের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি আছে—মনে করেন যে আমেরিকানরাই শুধু পথ দেখাতে পারে। ডিপসিকের সাফল্য সেই দম্ভে আঘাত হেনেছে।
চীনের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অজানা থেকে যায়, যেমন ভাষাগত বাধা, আলাদা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিমণ্ডল, আর দেশটিতে বিদেশি সংবাদকর্মীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাওয়ায় সেখানে কী ঘটছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। এ কারণে ডিপসিকের আগের মডেলগুলোর সাফল্যও যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা আলোচনায় আসেনি। তাছাড়া চীনের উদ্যোক্তারা সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ভয়ে নিজেদের খুব বেশি প্রচারের বাইরে রাখতে চান, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি নেতৃত্বকে আরও অন্ধকারে রেখেছে।
শুল্ক আরোপ প্রায় দোরগোড়ায়
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপের কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলেন, তা শিগগিরই কার্যকর হতে যাচ্ছে। এর আওতায় মেক্সিকো ও কানাডার জন্য ২৫% শুল্ক, আর চীনের জন্য ১০% শুল্ক নেওয়া হবে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, “মেক্সিকো ও কানাডা অবৈধ ফেন্টানিল সরবরাহ ও বিতরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যা লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের মৃত্যু ডেকে এনেছে”—এই কারণ দেখিয়েই তাদের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে।
বেশির ভাগ মূলধারার অর্থনীতিবিদই একমত যে শুল্কমূলক বাধা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। কারণ আমদানিকারকেরাই এই কর পরিশোধ করে এবং তারা সাধারণত সেই খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই শুল্ক নীতি কার্যকর হলে আমেরিকানদের পোশাক-জুতো থেকে শুরু করে খেলনা, খাদ্যপণ্য—সব কিছুর দামই বাড়তে পারে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ডোনাল্ড এল. লাসকিন এক মতামত নিবন্ধে লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, সেটি আমাদের একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। শুল্কমূলক বাধা কি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছিল? না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কি প্রভাব ফেলেছিল? না। বাণিজ্য ঘাটতি কি কমেছিল? উদ্দেশ্য ছিল তাই করা, কিন্তু তা-ও হয়নি।” লাসকিন আরও বলেন, “তাহলে কেন শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে? অন্যদিকে, যদি শুল্কের তেমন প্রভাবই না থাকে, তবে এত আলোচনা কেন? বরং প্রশাসনের উচিত ঋণ ও ঘাটতি কমিয়ে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং ২০১৭ সালের ট্যাক্স ছাড় আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।”
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা ছাড়াও দ্য গার্ডিয়ান-এ স্টিভেন গ্রিনহাউস লিখেছেন, “শুল্ক, বাণিজ্যিক টানাপড়েন, পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে ভয়ের কারণে হয়তো অনেক ব্যবসা বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে; আর এতে করে সারা বিশ্বেই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ডিলবুক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন—উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি হঠাৎ করেই কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন, কারণ দেশটি সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রগামী কিছু অভিবাসী প্রত্যাবাসন ফ্লাইট প্রত্যাখ্যান করেছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে পড়ছে, কারণ তারা জানে না কোথায় কোন শুল্ক আরোপ হয়ে যাবে, ফলে সরবরাহ শৃঙ্খলা বা উৎপাদন পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের ক্ষতি, নরওয়ের লাভ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস এড়িয়ে চলছে। আর ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক হিসেবে নরওয়ে এই সুযোগে বিশাল লাভের মুখ দেখছে। হাভার্ড হাল্যান্ড এবং কনুট অ্যান্টন মর্ক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে লেখা এক নিবন্ধে যুক্তি দিয়েছেন, নরওয়ের উচিৎ এই “অতিরিক্ত মুনাফার” অন্তত একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউক্রেনের পুনর্গঠন ও সহায়তায় ব্যয় করা।
তাঁরা লিখেছেন, “পরিসংখ্যান নিয়ে তেমন তর্ক নেই। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ইউরোপে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, আর এর ফলে নরওয়ে প্রায় ১০৮ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১১৩ বিলিয়ন ডলার) বাড়তি আয় করেছে—যা নরওয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই পাওয়া গেছে। তুলনা করলে দেখা যাবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি মিলিয়ে ইউক্রেনকে যে সামরিক ও বেসামরিক সহায়তা দিয়েছে, তার মোট মূল্য এর চেয়ে কম।”
তাঁরা আরও বলছেন, “কিন্তু নরওয়ে এই বাড়তি আয় প্রায় সবটুকুই নিজের কাছে রেখেছে। ২০২৫ সালের বাজেটে ইউক্রেনের জন্য মাত্র ৩ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সামান্যই বেশি। … যুদ্ধ থেকে উপার্জিত এই বাড়তি অর্থের একটি বড় অংশ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও পুনর্গঠনে ব্যয় না করা ঠিক হবে না। এটা খুবই স্বার্থপর মনোভাবের পরিচায়ক, যা নরওয়ের সরকারের ত্যাগ করা উচিত।”
সিএনএন
Leave a Reply