মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৭:১৯ অপরাহ্ন

ডিপসিকের সাফল্য স্পুটনিক মোমেন্টের চেয়েও বড় কিছু

  • Update Time : শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ৪.১৯ পিএম

এই সপ্তাহে চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেযা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। অনেকেই একে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো স্পুটনিক স্যাটেলাইটের সঙ্গে তুলনা করছেনযে ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলসোভিয়েতরা বুঝি প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট-এ আমার সর্বশেষ কলামে আমি লিখেছি যে ডিপসিকের এই সাফল্য আসলে স্পুটনিকের চেয়েও বড় ব্যাপার। স্পুটনিক মহাকাশ প্রতিযোগিতার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিলতবে তখন খুব কম মানুষই মনে করতেন সোভিয়েত অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার বহুমুখী প্রয়োগের কারণে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারেব্যবসা-বাণিজ্যস্বাস্থ্যসামরিক খাতসহ আরও বহুদিকেই এর ব্যবহার ছড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী এআই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে সর্বাধুনিক মাইক্রোচিপ সরবরাহ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছেযাতে চীন এআই প্রযুক্তিতে সহজে অগ্রসর হতে না পারে। কিন্তু ডিপসিকের নতুন এআই চ্যাটবট দেখে প্রশ্ন উঠছেযুক্তরাষ্ট্রের এই চেষ্টায় আসলে কতটুকু সফলতা মিলবে।

একই সঙ্গে এটাও ভাবার বিষয় যেপ্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা দেবেযদি এসব পদক্ষেপের ফলে চীন সর্বোচ্চ এক বা দেড় বছরএমনকি কয়েক মাসপিছিয়ে থাকেতাতে কী সত্যিই দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবেবরং চীনের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়াগুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সরবরাহে বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি খাতই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলোএকটি বিচ্ছিন্ন বৈশ্বিক অর্থনীতি গড়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগীদের মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়বে। টেসলা কি সর্বোচ্চ উদ্ভাবনের পথে এগোতে পারবেযদি তারা চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না থাকে?

ডিপসিকের বিজয়পরাজয় ও শিক্ষা
ডিপসিকের সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হয়তো বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেকিন্তু সামগ্রিক বিচারে এটি বেশ ইতিবাচক। দ্য ইকোনমিস্ট তাদের সাম্প্রতিক সংখ্যায় উল্লেখ করেছে, “ডিপসিক-সংক্রান্ত এই নাটকীয় খবর থেকে হারে-জিতের হিসাব করলে দেখা যাবেহারার চেয়ে লাভের পাল্লাই বেশি।” প্রযুক্তি খাতেরই কিছু কোম্পানি উপকৃত হবে। যেমন অ্যাপল তাদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্তে হয়তো সন্তুষ্ট যেঅতি দ্রুত এআই সক্ষমতা তৈরির চেষ্টায় তারা এত বিপুল অর্থ ঢালেনি।

এছাড়া ফ্রান্সের মিস্ত্রাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের টিআইআই-য়ের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট ল্যাবগুলো এখন সমানতালে নিজেদের উদ্ভাবনকে ডিপসিকের সাফল্যের ধারায় নিয়ে যেতে চাইবেবড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইবে। তাছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধির ফল হিসেবে এআই ব্যবহারে আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে ব্লুমবার্গ ওপিনিয়নের কলামিস্ট ক্যাথরিন থরবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি মহলের প্রতি কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলেছেন যে সিলিকন ভ্যালিতে উদ্ভাবনের অভাব নেইতবে সেখানকার অনেকের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি আছেমনে করেন যে আমেরিকানরাই শুধু পথ দেখাতে পারে। ডিপসিকের সাফল্য সেই দম্ভে আঘাত হেনেছে।

চীনের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অজানা থেকে যায়যেমন ভাষাগত বাধাআলাদা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিমণ্ডলআর দেশটিতে বিদেশি সংবাদকর্মীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাওয়ায় সেখানে কী ঘটছেতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। এ কারণে ডিপসিকের আগের মডেলগুলোর সাফল্যও যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা আলোচনায় আসেনি। তাছাড়া চীনের উদ্যোক্তারা সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ভয়ে নিজেদের খুব বেশি প্রচারের বাইরে রাখতে চানযা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি নেতৃত্বকে আরও অন্ধকারে রেখেছে।

শুল্ক আরোপ প্রায় দোরগোড়ায়
হোয়াইট হাউস জানিয়েছেপ্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপের কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলেনতা শিগগিরই কার্যকর হতে যাচ্ছে। এর আওতায় মেক্সিকো ও কানাডার জন্য ২৫% শুল্কআর চীনের জন্য ১০% শুল্ক নেওয়া হবে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, “মেক্সিকো ও কানাডা অবৈধ ফেন্টানিল সরবরাহ ও বিতরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছেযা লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের মৃত্যু ডেকে এনেছে”—এই কারণ দেখিয়েই তাদের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে।

বেশির ভাগ মূলধারার অর্থনীতিবিদই একমত যে শুল্কমূলক বাধা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। কারণ আমদানিকারকেরাই এই কর পরিশোধ করে এবং তারা সাধারণত সেই খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছেএই শুল্ক নীতি কার্যকর হলে আমেরিকানদের পোশাক-জুতো থেকে শুরু করে খেলনাখাদ্যপণ্যসব কিছুর দামই বাড়তে পারে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ডোনাল্ড এল. লাসকিন এক মতামত নিবন্ধে লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেনসেটি আমাদের একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। শুল্কমূলক বাধা কি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছিলনা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কি প্রভাব ফেলেছিলনা। বাণিজ্য ঘাটতি কি কমেছিলউদ্দেশ্য ছিল তাই করাকিন্তু তা-ও হয়নি।” লাসকিন আরও বলেন, “তাহলে কেন শুল্ক আরোপ করা হচ্ছেঅন্যদিকেযদি শুল্কের তেমন প্রভাবই না থাকেতবে এত আলোচনা কেনবরং প্রশাসনের উচিত ঋণ ও ঘাটতি কমিয়ে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং ২০১৭ সালের ট্যাক্স ছাড় আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।

অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা ছাড়াও দ্য গার্ডিয়ান-এ স্টিভেন গ্রিনহাউস লিখেছেন, “শুল্কবাণিজ্যিক টানাপড়েনপাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে ভয়ের কারণে হয়তো অনেক ব্যবসা বিনিয়োগের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবেআর এতে করে সারা বিশ্বেই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ডিলবুক বিশ্লেষণে বলা হয়েছেপ্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেনউদাহরণস্বরূপসম্প্রতি হঠাৎ করেই কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের কথা বলেছেনকারণ দেশটি সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রগামী কিছু অভিবাসী প্রত্যাবাসন ফ্লাইট প্রত্যাখ্যান করেছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে পড়ছেকারণ তারা জানে না কোথায় কোন শুল্ক আরোপ হয়ে যাবেফলে সরবরাহ শৃঙ্খলা বা উৎপাদন পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের ক্ষতিনরওয়ের লাভ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস এড়িয়ে চলছে। আর ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক হিসেবে নরওয়ে এই সুযোগে বিশাল লাভের মুখ দেখছে। হাভার্ড হাল্যান্ড এবং কনুট অ্যান্টন মর্ক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে লেখা এক নিবন্ধে যুক্তি দিয়েছেননরওয়ের উচিৎ এই অতিরিক্ত মুনাফার” অন্তত একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউক্রেনের পুনর্গঠন ও সহায়তায় ব্যয় করা।

তাঁরা লিখেছেন, “পরিসংখ্যান নিয়ে তেমন তর্ক নেই। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ইউরোপে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়আর এর ফলে নরওয়ে প্রায় ১০৮ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১১৩ বিলিয়ন ডলার) বাড়তি আয় করেছেযা নরওয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই পাওয়া গেছে। তুলনা করলে দেখা যাবেযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি মিলিয়ে ইউক্রেনকে যে সামরিক ও বেসামরিক সহায়তা দিয়েছেতার মোট মূল্য এর চেয়ে কম।

তাঁরা আরও বলছেন, “কিন্তু নরওয়ে এই বাড়তি আয় প্রায় সবটুকুই নিজের কাছে রেখেছে। ২০২৫ সালের বাজেটে ইউক্রেনের জন্য মাত্র ৩ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রাখা হয়েছেযা আগের বছরের চেয়ে সামান্যই বেশি। … যুদ্ধ থেকে উপার্জিত এই বাড়তি অর্থের একটি বড় অংশ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও পুনর্গঠনে ব্যয় না করা ঠিক হবে না। এটা খুবই স্বার্থপর মনোভাবের পরিচায়কযা নরওয়ের সরকারের ত্যাগ করা উচিত।

সিএনএন

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024