মণীশ রায়
লেখক মাত্রই তরুণ। তাঁর বয়স কতো তা আলাদা করে বলার অবকাশ নেই। তিনি বরাবরই তারুণ্য উদ্দীপ্ত মানুষ। এ তারুণ্য জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে। এ তারুণ্য-সরোবরে অবগাহনের পরই তিনি সৃজনশীলতার চর্চা অব্যাহত রাখতে পারেন। এ তারুণ্য মোটেই বয়সের উপর নির্ভরশীল নয়। জিমে গিয়ে, একস্ট্রা প্রোটিন খাওয়ার পর সিক্সপ্যাক হবার সঙ্গে এর মোটেই কোন মিল নেই। এ হল মানুষের চিরায়ত অনুভব অনুভূতির খেলা। এর সঙ্গে সেঁটে রয়েছে অমলিন মৌনমহান প্রকৃতির সঙ্গ। দুয়ের ভেতর নতুন দাগ যিনি ফেলতে পারেন তিনিই লেখক। এজন্য প্রতিপদে ধারালো হতে হয় লেখকের ব্যাখ্যাদানের দক্ষতা। নিজস্ব কল্পনা, স্বপ্ন, দর্শন, দ্রোহবোধ দিয়ে সাজাতে হয় সে জগৎ। সাহিত্যে নতুনত্বের উৎসমুখ সম্ভবত সেখানেই। যে লেখক যত পারঙ্গম তিনি তত সুনির্দিষ্ট করে নিজের সাহিত্যবোধকে রাঙিয়ে তোলেন। পাঠক একপাতা পড়েই চমকে বলে ওঠে, এ তো আল মাহমুদের জলবেশ্যা। অন্যজন আরও চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, আরে, এতো সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ছোটগল্প একটি তুলসিগাছের কাহিনী ।।
এবার আসি তারুণ্য উদ্দীপ্ত এরকম পাঁচ গদ্যকারের পাঁচটি গল্পগ্রন্থের স্বরূপসন্ধানে:
নিবেদিতা আইচের প্রজাকাহিনি
নিবেদিতা আইচের ‘প্রজাকাহিনি’ একটি গল্পগ্রন্থ। মোট ১৪টি হ্রস্ব আয়তনের ছোট গল্প দিয়ে সাজানো এর কলেবর। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিনন্দন নির্ভুল লোভনীয় একটি প্রকাশনা। এজন্য অতি অবশ্যই অনুপ্রাণন প্রকাশনের অধিকর্তা ইঞ্জিনীয়ার আবু মোঃ ইউসুফ ও তাঁর অভিজ্ঞ টীমকে সর্বান্তকরণে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তৌহিন হাসানের প্রচ্ছদটি কথা বলে। সব মিলিয়ে হাতে তুলে নেবার মতো একটি বই এই ‘প্রজাকাহিনি’ গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা। গল্পের শিরোনাম থেকে শুরু হয়ে চরিত্র রূপায়ণ সবখানেই লেখকের এ শক্তিমত্তা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাটকীয় এক আবেশের ভেতর লুকিয়ে থাকে তাঁর গল্পগুলো। শিং গল্পটি সেরকম এক উদাহরণ। অতিপ্রাকৃত নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে লেখক গল্পটি বলতে চেয়েছেন। উজলপসর, অলিলিয়া, অপরিশোধিত ঘুম গল্পগুলোও একই ঘরানার। ‘ঘ্রাণ ও সলমা জরি’করুণ রসের গল্প। পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। ক্যান্সার আক্রান্ত মৃতপ্রায় স্ত্রীকে ভালবেসে খুন করে তাকে অসহ্য যাতনা থেকে মুক্তি দেবার আখ্যানভাগটি পরিচিত ও সিনেমাটিক মনে হলেও লেখকের নিজস্ব অনুভূতির প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ‘রতনচূড় ও মৃত্যুসংক্রান্ত’ গল্পে একদিকে আপনজনের মৃত্যু হচ্ছে আর অন্যরা গয়নাঘাটির ভাগাভাগি নিয়ে একধরনের স্বার্থপর হীনম্মন্যতার ব্যস্ত এরকম আখ্যানও নতুন কিছু নয়। কিন্তু লেখক যেভাবে চিত্রটি আঁকতে চেয়েছেন সেটি তাঁর নিজস্ব। এ অনেকটা পরিচতি গান নিজের গায়কীতে গেয়ে নতুন করে উপস্থাপনের মতো এক প্রয়াস।
লেখক ছোট ছোট গল্পের পলক দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর গল্পগ্রন্থ। পাঠককে মাঝে মাঝে এক-একটি অকিঞ্চিৎকর ঘটনার উপর আলো ফেলে আড়ষ্ট করতে চেয়েছেন লেখক। আলোর ঝাপটা মেরে বুঝাতে চেয়েছেন, বলতে জানলে যেকোন বিষয় নিয়েই গল্প বলা সম্ভব। এমন কি, পদ্মপাতায় শিশিরজলের আকুলতাকে নিয়েও একটি মিষ্টি গল্প রচনা করা যায়। লেখবো এরকম একটি পরোক্ষ চেষ্টা প্রতিটি গল্পেই রয়ে গেছে।
গল্পগুলোর বেশিরভাগ পটভূমি গ্রামীন জনপদ ও সেখানকার মানুষদের ছিন্ন ছিন্ন দুঃখ-কষ্ট ও সুখ ঘিরে আবর্তিত। লেখকের তাঁদের খুব কাছাকাছি যাবার তীব্র আকুলতা গল্পগুলোয় স্পষ্ট। সাহিত্য-অলংকারের প্রয়োগ ঘটিয়ে আবহ তৈরি করা, চরিত্রের আচার-আচরণ, ডায়ালগের মাটিলগ্ন বৈচিত্র দিয়ে তিনি গল্পগুলো এগিয়ে নেবার কাজ করেছেন এবং বিমোহিত করতে চেয়েছেন পাঠককে।
বিষয়বস্তুর বিস্তৃতি রয়েছে লেখকের গল্পে। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি লেখকসুলভ কৌতূহলে পূর্ণ। ‘বশীকরণ’ গল্পের শুরুতে যেভাবে লেখক পান খাওয়ার লোভনীয় এক বর্ণনা দিয়েছেন তা পাঠককে অবশ্যই গল্পটি পাঠ করার দিকে টেনে নেয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ‘অসুখ’ গল্পে যেভাবে লেখক ‘এই হলো ডুবডুবির বিল’ বলে মুখরা তৈরি করলেন তাতে পাঠকের মনে হবে তিনি বুঝি ভিস্যুয়্যাল দেখাচ্ছেন। ‘প্রজাকাহিনি’ গল্পে ‘আলকাতরার মতো অন্ধকার কাকে বলে আজ বুঝতে পারছি’ বলে লেখক বারবার পাঠকের গল্প পাঠের আগ্রহকেই যেন উসকে দিচ্ছেন। এরকম খুচরো ট্রিকের ব্যবহার গল্প-চতুরালির বৈশিষ্ট্য। নিবেদিতা আইচকে গল্পে এসব উপকরণ প্রয়োণের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দেয়া যায়।
জীবনকে খুঁড়ে দেখার বড় সাধ লেখকের। ক্ষিরোদেশ্বরী হোটেল’ যদি হয় এক নারীর স্বাবলম্বী হিসাবে বেড়ে ওঠার গল্প তো ‘প্রজাকাহিনি’ হলো এক টুকরো অর্থ-সামাজিক সংকটের প্রতিধ্বনি। তিনি এক দুটো আবেগকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর গল্পরাজয়। ‘গ্লোম্যান’ এরকম এক গল্প। অপত্য স্নেহ নিয়ে কথিত গল্পটি করুণ-রসাত্মক ও গল্পের নমুনা। তাঁর গল্পে কোথায় যেন এক ধরনের বেদনার সুর বাজে। যন্ত্রণা, দুঃখ কাতরতা, আতিশয্য, বিহ্বলতা, সামাজিক অবক্ষয় প্রবলভাবে তাঁকে আকৃষ্ট করে। তবে একথাও সত্যি যে, তিনি তাঁর দেখা চেনা মানুষগুলোর গল্পই বলতে চেয়েছেন। তাঁর গল্পগুলো বলে দেয় তিনি গল্প বলতে জানেন। হয়তো ধীরে ধীরে গল্পগুলোর চারণক্ষেত্র আরো বড় হবে। অদূর ভবিষ্যতে কী পর্যবেক্ষণ শক্তি, কী নিজস্ব দর্শনশক্তিতে আরো সমৃদ্ধ হবে এক-একটি ছোটগল্প তা সহজেই অনুমান করা যায়।
গল্প বলায় তেমন কোন জড়তা নেই লেখকের। বাক্যগঠন কিংবা শব্দপ্রয়োগে যত্ন ও সতর্কতার ছাপ রয়েছে। উপমা উৎপ্রেক্ষা কিংবা চিত্রকল্প রচনায় লেখকের আগ্রহ ও নিজস্বতা তৈরির প্রচন্ড এক অগ্রহ লক্ষ্যণীয়। এগুলো একজন লেখককে সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল হিসাবে গড়ে তোলে। আশা করা যায় উল্লিখিত এসব গল্প-উপকরণ ভবিষ্যতে আরো ভালো গল্পের জন্মবার্তা আমাদের শোনাবে।
দুই
ফরিদুল ইসলাম নির্জনের ‘সে শুধু থাকে আড়ালে’
মোট বারোটি গল্প রয়েছে ফরিদুল ইসলাম নির্জনের’ সে শুধু থাকে আড়ালে’ শিরোনামের গল্পগ্রন্থে। যথারীতি তৌহিন হাসানের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদযুক্ত গ্রন্থটি হাতে নিতেই সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’ টীমের নিরলস পরিশ্রমের কথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা নিখরচায় প্রতিভাবান উঠতি লেখকদের যেভাবে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তা সত্যি উদাহরণযোগ্য এক প্রয়াস। এ প্রয়াস অব্যাহত থাকুক, সৃজনশীল লেখককুল শত প্রতিকূলতার ভেতরও আশান্বিত হউক, নির্দ্বিধায় তা-ই আশা করতে পারেন লেখককুল।
ঘটনায় চমক তৈরি করা ফরিদুল ইসলাম নির্জনের গল্পের একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য। ‘প্রত্যাবর্তন’ গল্পে একজন আত্মত্মহত্যা করতে এসে একটি বিড়ালকে আশ্রয় করে বাঁচার আশ্বাস খুঁজে পান। মিশি নামের বিড়ালটি আত্মহত্যাকারীর অবসাদগ্রস্ত জীবনে আনন্দ ও ভালোবাসা যুগিয়ে। জীবনকে বরণ করে নিতে সাহায্য করে। ‘খুনি’ গল্পটি আরো নাটকীয়। সন্তান তার মায়ের মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে নারীদের সঙ্গে যে গোপন ফেলায় মগ্ন হয় তা-ই মায়ের বিরুদ্ধে সন্দেহ তৈরি করে ওর বাবার মনে। বাবা মাকে খুন করেন এবং একসময় সন্তানের কাছ থেকে সত্যটা জানতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। উল্লিখিত গল্পদুটো অতিনাটকীয়তার দোষে দুষ্ট বলে মনে হলেও লেখক ফরিদুল ইসলাম নির্জন বান্ধবসম্মতভাবে গল্প দুটি উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। ফলে পাঠকপ্রিয়তায় কোন আঁচড় পড়েনি। ‘অমীমাংসিত’ গল্পটি এক নারীর নিদারূণ যাতনার উপাখ্যান। বিয়ের আগে একটি মেয়ে ঘটনাচক্রে মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে অভিশপ্ত জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেতে বিয়ে করে স্বামীর হাত ধরে নতুন এক জীবনকে স্বাগত জানতে চায়। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েটি স্বামীর অকারণ নির্দয়-নিষ্ঠুর সন্দেহের শিকার হয়ে পড়ে। লেখক যেভাবে গল্পটি বলেছেন তা সত্যি হৃদয়বিদারক। গল্পটি বালখিল্য আধুনিক সময়ের অস্থিরতাকে নির্দেশ করেছে বারবার। একই সঙ্গে বলা যায় লেখক শুধু এর ছিন্নচিত্র না এঁকে দ্রোহের পথেও গল্পটি উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন তা থেকে তিনি বিরত রইলেন, তা পাঠকের মনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে।
‘বাবা হিসাবে সম্ভবত আমার ভুল ছিল’ আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার স্মারক। একমাত্র কন্যা ভুল করে প্রেমে অন্ধ হয়ে ভাড়ে পড়ে এক ছিনতাইকারীর। কিন্তু প্রবঞ্চক সেই প্রেমিক ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করে মা-বাবার চোখের মণিকে এবং অর্থ দাবি করে মা-বাবার কাছে। ছেলেটি শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও মা-বাবা হন সন্তানহারা। এ গ্রন্থের বেশিরভাগ গল্প নর নারীর সম্পর্ককে উপজীব্য করে রচিত। ‘অরুণোদয়ের করণাময়’ গল্পে বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের ছলনার শিকার অরুণার করুণ পরিণতি, ‘পে-অর্ডার’-এ আপু ললিতার স্বামীর হাতে খুন, ‘সে শুধু আড়ালে থাকে’ গল্পের সীমা নামের এক অপরিণত কিশোরীর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অকাল মৃত্যু, ‘আমি খুনি কিন্তু অপরাধী নই’ গল্পের দ্বিচারিণী স্ত্রী রুপার স্বামীর হাতে খুন, ‘নীল আকাশের সীমানায় মেঘ’ গল্পের নন্দিতার টাইম-পাস প্রেমের নাটক – সবই যেন লেখকের নারী বিষয়ক ভাবনায় প্রতিফলিত ঘটনাসমূহ। ছল-চাতুরি, আত্মহত্যা, প্রবঞ্চনা, সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল ব্যবহার, বিষাদ, বিষণ্ণতা, বহুগামিতার প্রচ্ছন্ন রূপায়ন এ গল্পগুলো।
গল্পগুলোর চেহারা বেশিরভাগ আমাদের চেনা। অনায়াস প্রচেষ্টায় ফরিদুল ইসলাম নির্জন সেগুলো বলেও গেছেন। কোথাও জড়তা নেই। সহজ-সরল ভাবলেশহীন নির্মোহ এক মন নিয়ে তিনি গল্পের চরিত্রকে সাজাতে চেয়েছেন। গল্পে চমক এনে পাঠককে নিজের দিকে আকর্ষণের চেষ্টা চোখে পড়ে বারবার। কিন্তু যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো শুধুমাত্র ঘটনার চমক দিয়েই সাহিত্য পদবাচ্য গল্প তৈরি করা যায় না। ঘটনার গভীরে অন্য এক ঘটনাকে আবিষ্কার করাও লেখকের কাজ যা পাঠ করে পাঠক ভাবতে শুরু করেন এবং নিজের চেনা গণ্ডিকে পেরোতে চান। তাই ঘটনা হলো লেখকের আবরণ কিংবা দেহকাণ্ড। মূল গল্পটি অদৃশ্য হয়ে থাকে ঘটনার ভেতরে আত্মারূপ ছদ্মবেশে। একে খুঁজে নিতে হয় পাঠকের। বোদ্ধা পাঠক ছাড়া তা বুঝতে পারেন না।
ফরিদুল ইসলাম সাগর গল্পকথক হিসাবে বেশ প্রাণবন্ত। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরাম তিনি গল্প বলতে পারেন। সুখ-দুঃখ-বেদনা সহজেই তাঁর গল্পে ছায়া ফেলে। এজন্য কসরৎ কিংবা কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে হয় না।
লেখক নিত্যনতুন চমকপ্রদ আধুনিক জীবনের জটিলতাপূর্ণ গল্প বলে যেতে চাইলেও যন্ত্রণাক্লিষ্ট চরিত্রগুলোকে পথ দেখাতে চান নি বলে পাঠকের মনে হতে পারে। একজন আধুনিক নারীর সহজাত প্রতিরোধ স্পৃহা কেন জাগাতে চান নি লেখক-সৃষ্ট এসব চরিত্রে, তা নিয়ে জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। তাঁর সমস্যা-নির্ভর নারী বিষয়ক গল্পগুলো আরো গহিনে গিয়ে সমাজ-সংসারকে বিশ্লেষণ করবে এবং পাঠকের মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই আশা তাঁর পাঠক করতেই পারেন।
তিন
আরিফুল আলমের ‘আধ্যাত্মিক’
‘আধ্যাত্মিক’ গল্পগ্রন্থটি মোট চারভাগে বিভক্ত। কর্তাজ্যাঠা, রক্তবন্ধক, ব্যক্তিত্ব শক্তি এবং মারণকাজ। বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নেয়া হয় গ্রামীণ সমাজের কিছু অতিপ্রাকৃত কিংবা অলৌকিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার। বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিশ্লেষণ করে পাঠকের মনে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই লেখকের মুখ্য উদ্দেশ্য। এসব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাকে লেখক গল্পের চলনে প্রকাশ করেছেন যা পাঠকের মনে আগ্রহ তৈরি করার অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে।
বিভাজিত হলেও গল্পগ্রন্থের পুরোটাই একই সুতো গাথা। বৃষ্টিমুখর রাতে ছাত্র-শিক্ষকের আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে লেখক চেয়েছেন বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার এর স্বরূপসন্তান। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে উন্মোচন করতে চেয়েছেন মানুষের অদ্ভুতুড়ে আচার-আচরণের সঠিক কারণ। আলাপচারিতায় অংশগ্রহণকারী সবাই পদার্থবিদ্যার জাঁদরেল সব শিক্ষক। শ্রোতা হিসাবে রয়েছেন কজন ছাত্র। এঁরা সবাই রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষাসফরে বেড়িয়েছেন। কাপ্তাই হ্রদে সারাদিন ভাসার পর বৃষ্টিমুখর রাতে অশরীরী বা আধিভৌতিক সব বিষয় নিয়ে মুখর হয়ে ওঠেন। কেউ তাঁর অভিজ্ঞতাপুষ্ট একটি ঘটনার অবতারণা করছেন তো অন্যজন তা যুক্তি দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করে সত্যকে তুলে ধরতে চাইছেন। অতিপ্রাকৃত এসব ঘটনার লৌকিক বা বাস্তব ব্যাখ্যাগুলো বেশ চমকপ্রদ। গ্রামে-গঞ্জে জিন-ভূত কেন শুধু গৃহবধূদের বেছে বেছে আছর করে এবং ওঝারা কেবল তাদেরই চিকিৎসার নামে নির্দয় অত্যাচারে রক্তাক্ত করে তোলে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন শিক্ষক জানালেন, তিনি কৈশোরে পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্ন দেখতে পেতেন স্বপ্নে এরকম বহু প্রশ্নের ধাঁধাঁ পর্যালোচনা করে লেখক পাঠককে যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান দেবার চেষ্টা করেছেন।
বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল, এসব প্রশ্নোত্তরের পান্ডিতাপূর্ণ গাম্ভীর্য মোটেই গল্পস্রোতকে ব্যাহত হতে দেয়নি। বরং এমন সব চরিত্র লেখক সামনে নিয়ে এসেছেন, যাদের দেখে পাঠকের গল্পতৃষ্ণা তো বটেই, উল্টো একটা সমাধান পেয়ে যান যা জ্ঞানতৃষ্ণাকেও প্রশমিত করে। ব্যক্তিত্বশক্তি পর্বে নূর উদ্দিনের চরিত্রটিকে যেভাবে লেখক পদার্থবিদ ও মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তা বেশ চিত্তাকর্ষক। নূর উদ্দিন একটি নিগেটিভ চরিত্র। শত অপকর্ম ও অপরাধ করে সে একটি চরম নেতিবাচক স্বভাব ‘অর্জন করে। তাই ওর সংস্পর্শে একজন শিক্ষক এসে রীতিমতো মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েন। পরে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বে সামান্য পরিবর্তন এনে দুষ্ট লোকটির কাছাকাছি চলে আসেন। নূর উদ্দিন যত খারাপ কথা বলেন তত তিনি হাসিমুখে সেসব বরণ করে নেন। একসময় নূর উদ্দিন নেতিয়ে পড়ে এবং শিক্ষক যেসব উপদেশ প্রদান করেন তার মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হয়।
গ্রামের এক কিশোর ওর নিজ গ্রামের এক কোনে অবস্থিত এক জলাশয়ে শাপলা-শালুক তুলতে গিয়ে ডুবে মারা যায়। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, জলাশয়টি এক পিশাচের আস্তানা। সেই পিশাচের মাথা নেই, পা নেই। আছে শুধু দুই হাত। দুপুরের দিকে সেই পিশাচ জলকেলি করে বেড়ায় সেখানে। অপ্রত্যাশিতভাবে বালকটি সেই সময় সেখানে যাওয়ায় প্রাণ দিতে হল পানিতে ডুবে। শিক্ষক মশায় সেই গ্রামে ছিলেন তখন। তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, পিশাচের ধারণাটি অমূলক। কালিবাউশের ঝাঁককে পিশাচ হিসাবে ভাবা হতো সেখানে। আর ছেলেটি মৃগী রোগের কারণে ডুবে মারা যায় বলে সেই শিক্ষক ধারণা করেন। তাছাড়া, নির্জনতা কিভাবে মানুষের অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে তার ভেতর অশরীরী আতঙ্ক তৈরি করে থাকে, লেখক এরও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
রক্তবন্ধক পর্বের জয়নাল চরিত্রটি একাধারে ভয়াল ও মর্মান্তিক। জয়নালের মা সামান্য কারণে গ্রামের মাতব্বরদের নির্মম বিচারে হেনস্থার শিকার হন। সেটি সহ্য করতে না পেরে গাছের সঙ্গে নিজের শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। অবুঝ শিশু জয়নালের চোখের সামনে সে ঘটনা ঘটে। বড় হবার পর জয়নালের স্বভাবে কিছু আস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। সারাক্ষণ গোরস্থানে পড়ে থাকে। কারো সঙ্গে তেমন কোন কথা হয় না। গ্রামের সবাই ভাবে, জয়নালের উপর ভূত-জিনের কিছু প্রভাব রয়েছে। ফলত লেখাপড়াসহ জাগতিক কোনকিছুতেই ওর মতি নেই। অথচ ওর অন্য দুভাই লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। অগত্যা জয়নালের আব্বা শেষ চেষ্টা হিসাবে ওকে বিয়ে করিয়ে দেয়। সন্তানও হয় জয়নালের। কিন্তু সেই সন্তান বড় হয়ে ওর সেবাযত্ন করার পরিবর্তে ভকে নিয়মিত মারধর করতে শুরু করে। ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে জয়নালকে নির্দয়ভাবে মারধর চালাতো আপন সন্তান। গ্রামের কারো কথা শুনত না। একই সঙ্গে ওর প্রতি স্ত্রীর গঞ্জনাও চরমে ওঠে। এসব আমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একসময় খাওয়া-দাওয়া সব ছেড়ে দেয় জয়নাল এবং এক-দেড়মাস পর কংকালসার দেহ নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর আগে সে প্রায়ই বলত, শয়তানের কাছে রক্তবন্ধক রাখলাম। একদিন শয়তান এর শোধ নেবে। এরপর যা ঘটল তা মোটেই অতিপ্রাকৃত বা শয়তানের কাজ নয়। জয়নালের ছেলে ও মা মিলে হিংসায় মত্ত হয়ে ওর অন্য দুই সচ্ছল ভাইয়ের সঙ্গে ক্রমাগত দা-কুড়াল নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হল। একদিন পুরো পরিবারটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। গ্রামের মানুষ ভাবল, জয়নালের পালিত শয়তান ওর হয়ে প্রতিশোধ নিল। কিন্তু লেখক পরিবারটির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন, এসব একটি গ্রামীণ পরিবারের নিজেদের ভেতর তীব্র কলহ ও চরম পরশ্রীকাতরতার বহিঃপ্রকাশ বৈ অন্য কিছু নয়।
চারপর্বে বিভক্ত গল্পটি একটি বড় গল্পের নমুনা। তবে লেখকের গল্প উপস্থাপনায় যে যুক্তিতর্কের মিশেল রয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই বেশ উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় এক প্রয়াস। তবে উত্তমপুরুষে লেখা নাদিম মনিসার আখ্যানটি যেখানে লেখক শেষ করেছেন তা অসম্পূর্ণ বলে মনে হতে পারে পাঠকের নিকট। তবে সব মিলিয়ে গল্পটি মজাদার তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় কারো।
যথারীতি তৌহিন হাসানের প্রচ্ছদ মুগ্ধতা কাড়ে। ছাপার মান, অলঙ্করণ মান-সম্মত। তবে কারো কাছে গ্রন্থের আধ্যাত্মিক শিরোনামটি অপপ্রয়োগ বলে মনে হতে পারে। কেননা মানব সভ্যতার বিকাশে তথা জীবনের সঠিক অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে যে ব্যাপক অর্থে শব্দটির প্রয়োগ ঘটে, এ গ্রন্থে প্রবীর ঘোষের জনপ্রিয় ধারা অনুসারে উল্লিখিত সংস্কার-কুসংস্কারের ছিন্ন ঘটনাগুলো সেটি নির্দেশ করে কিনা তা প্রশ্ন হিসাবে লেখককেই তাক করে।
সব মিলিয়ে গল্পগ্রন্থটি সুখপাঠ্য ও চিন্তা উদ্রেককারী। গল্পলেখায় লেখকের মননশীল এ যারা আরো সুসংহত ও সমৃদ্ধতর হউক পাঠক হিসাবে এ আশা রইলো।
চার
আহাদ আদনানের ‘সেদিন বর্ষাকাল’
মোট এগারোটি গল্প নিয়ে আহাদ আদনানের ‘সেদিন বর্ষাকাল’ গল্পগ্রন্থ। বৃষ্টির ফোঁটার মতো এক-একটি স্বাচ্ছ স্পষ্ট ঘটনা। সহসা ঝাপটা মেরে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবন নামের দীর্ঘ এক গানের একটি বা দুটি বেদনাময় শব্দের সুদূরপ্রসারী দ্যোতনা। মনের ভেতর আতশবাজির ফুলকির মতো একঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে বিস্মৃতপ্রায় বৃহৎ ঘটনার এক টুকরো অর্থময় আবেশ। লেখক তাঁর ঝুলি থেকে একটি করে করুণ মুখাচ্ছবি দেখাতে শুরু করেন আর পাঠকের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে বারবার। এই কি আমি? এই আমার দেশ। এই আমার স্বাধীনতার ফসল তুলতে গিয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক আত্মত্যাগের নির্মম-নিষ্ঠুর নির্দয় কাহিনি ?
আহাদ আদনান নিপুণ হাতে একটি করে ছবি এঁকে গেছেন একাত্তরের। ‘শ্বাস’ গল্পে পাক-হায়েনা ও তাদের দোসর রাজাকারের দল পাশের পাল বাড়িতে আগুন দিয়েছে। প্রতিবেশী রাহেলার কানে ভেসে আসছে তাদের আর্ত চিৎকার। শেষ-মেষ নতুন বিয়ে করা বউর আর্তনাদ। টেনে-হিঁচড়ে নেয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। একসময় রাহেলার পরিচিত আরজ কবির মিলিটারিদের নিয়ে ওদের বাড়িতেও হানা দেয়। প্রাণ বাঁচাতে রাহেলা ঘরে বুড়ি শাশুড়িতে একা রেখে কোলের বাচ্চাকে বুকে চেপে আশ্রয় নেয় বাড়ির পিছনে গু-র নালার উপর। কানে আসে আরজের গলা, আব্বাসের বউ কই গেলি? ওই মুক্তির বউ কই লুকাইলি। কীরে বুড়ি বউরে কার ঘরে লুকাইছিস?’ কথা নয়, এক-একটি শব্দতীর। একসময় শাশুড়ির মৃত্যুকাতর গোঁ-গোঁ শব্দ কানে আসে রাহেলার। ভয়ে-ত্রাসে অবুঝ শিশুকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাহেলা। নিজের অগোচরে শিশুর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। যখন রাহেলা বুঝতে পারে তখন ওর অবশ হাত থেকে সন্তানটি গু-র দলার উপর পড়ে যায়। তবু শব্দ বেরোয় না মায়ের গলা থেকে।
এরকমই কতগুলো হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুর গা শিউরে ওঠা চিত্র মিলে বইটির পাতায় পাতায়। একাত্তর সনে জন-মানুষের দুর্ভোগের কাহিনিগুলো যেন ভাসে চোখের সামনে। একশ্রেণীর মানুষের পাশবিকতার গল্পগুলো পাঠককে ফের শিহরিত করে। কাঁপা কণ্ঠে বলতে বাধ্য হয়, এক দেশ, এক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কেন মানুষের প্রতি এত নিষ্ঠুর হয়?
মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায়ের চিত্র নিয়ে একটি গল্পমালা গেঁথেছেন আহাদ। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫শে মার্চের কালো রাতের ছবি যেমন এসেছে তেমনি ভারতের মাটিতে রিফিউজি ক্যাম্পগুলোয় আশ্রিত অসহায় মানুষের দুর্দশার চিত্রও বাদ যায়নি। স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কেও লেখক বিশ্বস্তভাবে তুলে এনেছেন গল্পে। গল্পের বিশ্বস্ততা এতোই তীব্র যে পাঠকের হৃদয় সহজেই আর্দ্র হয়ে পড়ে। লেখক একেবারেই নির্মোহ ও উহ্য রেখেছেন নিজের অস্তিত্বকে এবং ঝাপটার পর ঝাপটা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যে পরিবেশটি এঁকেছেন তা নিষ্ঠুর মনকেও রীতিমতো বিষাদগ্রস্ত ও বিপন্ন করে তোলে। তাঁর গল্পভাবনা ও নির্মাণ-শৈলী দিনদিন আরো উৎকর্ষিত ও বিস্তৃত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পাঁচ
জয়শ্রী সরকারের ‘ঈশ্বরকে বল দুখী ডাকছে’
খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে যেন বই পড়ার একটা মিল রয়েছে। প্রথমে বইটি আমরা হাতে তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। এপিটাইজারের মতো তখনই পাঠকের পাঠ-তৃষ্ণা প্রভাবিত হয়। তৌহিন হাসানের মনোলোভা বিমূর্ত প্রচ্ছদ, ত্রুটিহীন ছাপা ও অলঙ্করণ নিঃসন্দেহে বইটি পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।
মোট বারোটি গল্পে সমৃদ্ধ এ গ্রন্থ। পিয়াইনে রাত্তির নেমে এলে মারিয়া আসে, ফিরোজা সুন্দরী, আলুর দম, মেরিন ড্রাইভ, হরহরের বউ, বেনারসী, মাছভাজা, আধাঢ়ের পয়লা বৃষ্টি, মহব্বতের পঁয়ত্রিশ বছর, প্রযত্নে শ্রীশ দাস লেন ও ঈশ্বরকে বল দুখী ডাকছে। ব্যতিক্রমী শিরোনাম থেকে সহজেই অনুমেয় যে, লেখক পাঠককে এক ভিন্ন ও অপরিচিত জগতে ঘুরিয়ে আনতে চান। প্রথম গল্পটি তুলে আনা হয়েছে সিলেটের খাসিয়া পল্লীসমাজ থেকে। মূল চরিত্রদ্বয় হলো মেনজপ ও মারিয়া। একদিকে বিয়োগান্ত রোমান্টিক আবহ, আবার অন্যদিকে খাসিয়া সমাজব্যবস্থার ভালোমন্দ। ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর স্বরুপসন্ধান নিঃসন্দেহে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। লেখক সেই দাবিটির প্রতি সুবিচার করেছেন বলে মনে হয়। দ্বিতীয় গল্প ‘ফিরোজা সুন্দরী’। একদিকে মনসা-সুখুর বৈচিত্রহীন নিস্পন্দ দাম্পত্যজীবন এবং অন্যদিকে সুখুর হারানো প্রেম যা লেখক অদৃশ্য ছায়ামানবী ফিরোজা সুন্দরীর মোহময় আবেশের মধ্য দিয়ে চিত্রিত করেছেন। এ গল্পটিও লেখকের সমাজ সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ক্ষয়িষ্ণু কুমোর সমাজের খুঁটিনাটি তিনি রোমান্টিক আবহের ভেতরই প্রচ্ছন্ন করে রেখেছেন। ‘আলুর দম’ গল্পটি ঝুপড়িবাসী বিত্তহীন ক্ষুধাসম্বল কজন মানুষের গল্প। গল্প পাঠের পর মনের ভেতর শরীর-গুলানো এক বোধের জন্ম হয়। গল্পটির শরীর জুড়ে এমন এক সমাজকে ইঙ্গিত করেন লেখক যেখানে ক্ষুধার জ্বালায় গরম ‘আলুর দমে’ মিশে থাকা ইঁদুরছানাও মাংসের স্বাদে পরিণত হয় কিছু দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের কাছে।
‘মেরিনড্রাইভ’ গল্পটি কক্সবাজারের উখিয়ায় গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করুণ এক প্রতিবেদন। নির্দয় দারিদ্র কিভাবে নারীর আত্মসম্মান ও সম্ভ্রমকে কেড়ে নেয় তা এ গল্পে বিধৃত হয়েছে।
গ্রামীণ সংখ্যালঘু সমাজের কুসংস্কারের ছবি আঁকা হয়েছে ‘হরহরের বউ’ গল্পে। ‘মাছভাজা’ গল্পে লেখক যে বিধবা ধনদিকে তুলে ধরেন তা অবশ্যই লেখকের সমাজ সচেতনতার পরিচয় বহন করে। দূরন্ত, মানবিক, সাহসী এক বিধবা নারী এই ধনদি। অথচ পড়ন্তকালে তাকে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বৈধব্যের কৃষ্ণতা পালনের নামে মৃতুর দিকে ঠেলে দেয়। এ হৃদয়বিদারক জীবনচিত্র আঁকতে গিয়ে জয়শ্রী সরকার মেধার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ‘বেনারসী’ পরিমল-হিরামন দম্পতির সন্তানহীনতার করুণ এক গল্প। ‘ঈশ্বরকে বল দুখি ডাকছে ‘করোনাকালের বিপন্ন সময়ের গল্প, যেখানে ছাই-বিক্রেতা দুখীকে একটুখানি খাবারের জন্য বাড়ি-বাড়ি ধর্ণা দিতে হচ্ছে।
জয়শ্রী সরকার একজন সমাজ-সচেতন লেখক। প্রতিটি গল্পে তিনি সেদিকে আলো ফেলার চেষ্টা করেছেন। তিনি নিজের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যত্র যেতে চেয়েছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত ছিন্নমূল সমাজের খুব কাছাকাছি চলে গেছেন তিনি। তাই শাঁখারিপট্টিতে যে মধু সন্তায় আনাজ বিক্রি করেন রাস্তার এককোনে বসে, তাকে যেমন গল্পে ঠাঁই দিয়েছেন তেমনি এসেছে ছাইবিক্রেতা দুখী, খাসিয়াপুঞ্জির মেনজপ ও মারিয়া কিংবা তাঁতশিল্পী পরিমলসহ অনেকের গল্প। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিস্তারিতভাবে তাঁদের পেশ করেছেন পাঠকের কাছে। এক্ষেত্রে লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তিকে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে। কেননা তিনি বরাবরই মধ্যবিত্তের গন্ডি ভেঙে খাসিয়াপুঞ্জি কিংবা এরকম অপরিচিত বিষয়ের অনেকখানি গভীরে ঢুকে পড়েছেন। তবে মাঝে মাঝেই গল্পে অতিকথনের মতো দোষে দুষ্ট হয়েছেন বলে কোন কোন পাঠকের মনে হতে পারে। বলার চাইতে না-বলা যে সাহিত্য-চর্চার কঠিন এক অভ্যাস, তা তাঁর গল্পে কোথাও কোথাও অনুপস্থিত বলে মনে হতে পারে। তবে সার্বিকভাবে জয়শ্রী সরকারের গল্পগুলো চিত্তাকর্ষক ও আনন্দবর্ধক, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয় যে, পাঁচটি গল্পগ্রন্থই সুসম্পাদিত ও দৃষ্টিনন্দন যা পাঠকের মনকে সহজেই আকর্ষণ ও আন্দোলিত করে। পাঠকপ্রিয়তার বিচারেও গল্পগ্রন্থগুলো উতরে গেছে। তবে সাহিত্যিকের মুখ্য দায়িত্ব পরিবেশ ও পরিস্থিতির চিত্রাঙ্কন হলেও যতক্ষণ না সেই শিল্পপট জীবনের গভীরে প্রবেশ না করে ততক্ষণ সেগুলো তারল্য-সংকটে ভোগে। শ্রীকান্তে শরৎবাবুর ‘মড়ার আবার জাত কি’ কিংবা ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে দেয় ‘কিংবা কবি উপন্যাসে ‘জীবন এ্যাতো ছোট ক্যানে’ জাতীয় কথাগুলো স্রেফ কথার কথা নয়, লেখক বিধৃত চরিত্র ও ঘটনাগুলোকে একধরনের মহত্ত্ব ও গভীরতা প্রদান করে থাকে। সাহিত্যিকের মূল কাজ হচ্ছে জীবনকে নতুন করে ব্যাখ্যা দান করার চেষ্টা। নানা ফর্মের ভেতর দিয়ে এ ব্যাখ্যা প্রদানে সচেষ্ট থাকেন লেকককুল। লেখক যদি আধুনিক মন-মানসিকতা ও জীবনবোধের অধিকারী না হন এবং অগ্রগামী সময়কে বর্তমানের মাটির উপর দাঁড় করাতে অপারগ হয়ে পড়েন তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপন সমাজের গভীর সংকটকে এড়িয়ে গিয়ে অতীত বিলাসী ও অলংকার সমৃদ্ধ আবেশ-আতিশয্যের সাহিত্য-ঘেরাটোপের ভেতর আটকা পড়ে যান।
এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, বন্ধ সমাজকে অর্গলমুক্ত রেখে মুক্ত আলো-বাতাসের প্রবাহকে সাবলিল করার দায়িত্ব লেখকেরই। একথা সত্য হিসাবে মেনে নিলে উপরে আলোচিত পঞ্চ-গদ্যকার তাঁদের স্ব-স্ব সাহিত্যচর্চায় দিনদিন আরো জীবনমুখী ও সাহসী হবেন, পাঠক হিসাবে তা আশা করা মোটেই অসমীচীন হবে না।
(অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন ২০২৫-এ পঠিত)
Leave a Reply