সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
১. বিস্কিটের দাম বৃদ্ধি দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর
২. মাত্র ৫ টাকায় বিক্রি হওয়া বিস্কুট দীর্ঘদিন ধরে স্কুলগামী শিশু, সুবিধাবঞ্চিত তরুণ এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য পুষ্টির প্রধান উৎস ছিল।
৩. এখাতে আড়াই লাখ শ্রমিক কাজ করে, তাদের একটি বড় অংশের চাকুরি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে
৪. বিস্কিটের দাম বাড়াতে কমে যাবে রফতানি
শহরে বাসায় অথিতি এলে এক কাপ চা আর কয়েকটা বিস্কিট এটা বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ম মধ্য বিত্তের কাছে অতি পরিচিত দৃশ্য। আর ছোট শিশু থেকে রিকসওয়ালা প্রমূখকে দেখা যায় দিনে কখনও না কখনও সে বিস্কিট খাচ্ছে। অফিসে বস থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মকর্তার ড্রয়ারেও থাকে কয়েকটি বিস্কিটের প্যাকেট। এমনি ভাবে বিস্কিট লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশির জন্য একটি প্রধান স্ন্যাকস এবং পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
এখন উচ্চমূল্যের কারণে এই বিস্কিটতাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। “মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫” অনুযায়ী কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশে উন্নীত করায় এই শিল্প মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
এই কর বৃদ্ধি একটি বড় প্রভাব পড়বে দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর। কারণ, মাত্র ৫ টাকায় বিক্রি হওয়া বিস্কুট দীর্ঘদিন ধরে স্কুলগামী শিশু, সুবিধাবঞ্চিত তরুণ এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য পুষ্টির প্রধান উৎস ছিল। ভ্যাট বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা নির্মাতাদের কম দামে বিস্কুট উৎপাদন করা থেকে বিরত রাখবে এবং এর ফলে অনেকের জন্য এই অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টির উৎসটি বন্ধ হয়ে যাবে।
পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব
বিশেষ করে গ্রামীণ এবং নিম্ন-আয়ের শহুরে এলাকার শিশু ও শিক্ষার্থীদের জন্য, বিস্কুট শুধু একটি স্ন্যাকস নয়—এটি শক্তি ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অনেক শিক্ষার্থী স্কুলের টিফিন হিসেবে সাশ্রয়ী মূল্যের এই খাবারের ওপর নির্ভর করে। বিস্কুটের মূল্য বাড়লে এসব পণ্য তাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে, যা শিশুদের পুষ্টি উন্নত করার এবং অপুষ্টির খেকে বাঁচার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট আরও গভীর করতে পারে, বিশেষত উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের মধ্যে লড়াইরত পরিবারের ক্ষেত্রে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি
বাংলাদেশের বিস্কুট এবং কৃষি-প্রক্রিয়াজাত শিল্প দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই শিল্প ২,৫০,০০০ এরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে, যাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে এসেছে, পাশাপাশি এটি কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রান্তিক কৃষকদেরও সহায়তা করে।
ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, চাহিদা হ্রাস পাবে এবং অনেক নির্মাতাকে তাদের কার্যক্রম সীমিত করা বা পুরোপুরি বন্ধ করতে বাধ্য করবে। এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানো এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। চাকরির সংখ্যা কমে গেলে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে সমাজে চরম চাপ সৃষ্টি হবে, যা অস্থিরতা এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে।
রপ্তানি ও জাতীয় উন্নয়নে প্রভাব
বিস্কুট শিল্প কেবল দেশীয় বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়—এটি ১৪৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্মাতাদের উপর বাড়তি করের চাপ বৈশ্বিক বাজারে শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে, যার ফলে রপ্তানি হ্রাস পাবে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষতি হবে।
এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কৃষি-প্রক্রিয়াজাত শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার লক্ষ্যের বিরোধিতা করে। এই কর বৃদ্ধি দেশের রপ্তানি খাতকে প্রসারিত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় উন্নয়নে শিল্পের সম্ভাব্য অবদানকে দুর্বল করবে।
পুনর্বিবেচনার আহ্বান
এই করনীতির পরিণতি কেবল বিস্কুট শিল্পেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি পুষ্টি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের সামগ্রিক কল্যাণকে প্রভাবিত করে। সরকারকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা এবং বাতিল করতে হবে। অনেক দেশে যেমন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট রেয়াতের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমন একটি ব্যবস্থা বাংলাদেশেও গৃহীত হতে পারে, যা শিল্প ও জনগণের উভয়ের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করছেন দেশের শিল্প ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা।
Leave a Reply