বাংলাদেশের চট্টগ্রামে নৌ বাহিনীর একটি কনভেনশন সেন্টারে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিয়েতে ‘ছাত্র পরিচয়ে’ হামলার পর ওই নেতাকেই আটক করেছে পুলিশ। হামলার সময় নারী অতিথিদের ‘হেনস্থার’ও অভিযোগ উঠেছে।
হামলার ঘটনার যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথমে হামলাকারীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে। পরে তাদের কেউ কেউ উপস্থিত লোকজন ও নৌ বাহিনী সদস্যদের লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন।
এক পর্যায়ে পুলিশ ও নৌ বাহিনী সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর বরের পিতা ফখরুল আনোয়ারকে আটক করে। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক বলে জানা গেছে।
“ফখরুল আনোয়ারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা আছে। তাকে আমরা সেই মামলাতেই আটক করেছি,” বিবিসি বাংলাকে রবিবার জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডিসি (নর্থ) ফয়সাল আহম্মেদ। তবে মামলাটি কি ধরনের সে সম্পর্কে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত জানাতে পারেন নি।
এদিকে চট্টগ্রামের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি প্রচারণা চলছে সামাজিক মাধ্যমে। এক পক্ষ বলছে বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে। আর অন্যপক্ষ ‘কথিত ছাত্রদের’ লাঠিপেটার সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করছে।
স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললেও তারা অনুষ্ঠানে হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এমনকি বর ও কনের পরিবারও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।
কয়েকশো মানুষ চট্টগ্রামের ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা করে
ঘটনা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে
ঘটনার পর সেখানে গিয়েছেন এমন কয়েকজন সাংবাদিক ও আমন্ত্রিত ছিলেন এমন অন্তত দুজন বিবিসিকে জানিয়েছেন, যাদের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো তারা হলেন ফখরুল আনোয়ারের ছেলে এবং চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলমের বড় ছেলে নিজামুল আলমের কন্যা।
ফখরুল আনোয়ার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি রফিকুল আনোয়ারের ভাই এবং আরেক সাবেক সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির চাচা।
শনিবার রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিলো নগরীর টাইগারপাস এলাকায় নেভি কনভেনশন সেন্টারে। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিএনপি দলীয় বর্তমান মেয়র শাহাদত হোসেন সহ কয়েকজন বিএনপি নেতাও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেলেও তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিলেন ফখরুল আনোয়ার। সে সময় হঠাৎ করে কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে হৈ চৈ শুরু হয় এবং বাইরে থেকে একদল ব্যক্তি অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে ফেলে।
স্থানীয়দের দাবি এই বিয়েতে ফটিকছড়ির সাবেক এমপি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনি উপস্থিত আছেন-এমন শোরগোল তুলে রাত এগারটার দিকে হামলা শুরু হয়।
তার আগে একদল ব্যক্তি কনভেনশন সেন্টারটির সামনে জমায়েত হয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করেন। ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ এমন শ্লোগান শোনা গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশের আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত না হওয়াতেই মব জাস্টিস কিংবা দলবদ্ধ হামলা কমছে না বলে অনেকে মনে করেন।
এরপর সেন্টারটির ভেতরে হামলা শুরু হয় এবং অনুষ্ঠানটি পণ্ড করা হয়। এ সময় হামলাকারীরা ফখরুল আনোয়ারকে মারধর করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ও নৌ-বাহিনীর সদস্যরা সেখানে ছুটে আসেন। এ সময় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা লোকজন ও নৌ বাহিনী সদস্যদের হাতে হামলাকারীদের কয়েকজন লাঠিপেটারও শিকার হন বলে জানা গেছে।
এরপর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ফখরুল আনোয়ারকে আটক করে খুলশী থানায় নিয়ে যায়। পরে তাকে কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা এক মামলায় আটক দেখানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিসি (নর্থ) ফয়সাল আহম্মেদ।
অনুষ্ঠানে ছিলেন এমন একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন যে হামলাকারীরা অতিথিদের অনেককেও অপদস্থ করেছেন এবং কয়েকজন নারী অতিথি হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
বিবিসির পক্ষ থেকে সাবেক মেয়র মনজুর আলমের ছেলে সারোয়ার আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন মন্তব্য করেননি। আর মনজুর আলম ফোন রিসিভ করেননি।
‘মব’ আলোচনায় কেন
বাংলাদেশে গুজব বা জনমনে ক্ষোভ তৈরি করে গণপিটুনি বা হামলার মতো ঘটনা আগেও বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। তবে গত ছয় মাস ধরে একের পর এক ঘটনায় ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে এই ‘মব’ কিংবা ‘মব জাস্টিস’।
বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ ও হামলার কারণে এই মব অনেক দিন ধরেই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে দেশের আদালত প্রাঙ্গণে মামলার আসামীদের ওপর হামলাসহ মব জাস্টিসের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের মাথায়ই প্রধান উপদেষ্টার তৎকালীন বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম (বর্তমানে উপদেষ্টা) বলেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা হলো মব জাস্টিসের মতো ঘটনা কোনোভাবে বরদাশত করা হবে না।
তিনি তখন বলেছিলেন, কেউ অপরাধ করলে আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই।
“সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply