সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
১. কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস এবং কৃষিপন্য রপ্তানি সক্ষমতার অভাব
২. বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫% কৃষিতে নিয়োজিত, তবে তরুণ প্রজন্মের শহরমুখী হওয়ার ফলে শ্রমিকের ঘাটতি তীব্রতর হচ্ছে।
৩. সংরক্ষণ অবকাঠামোর অভাবে ২৫% পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়।
৪. কৃষিখাতকে এখন কর্পোরেট সিস্টেম ও মুক্ত অর্থনীতির হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত
ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পরও কৃষকরা প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন– কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহারের কারণে।
বাংলাদেশের কৃষি খাত, যা এখনও দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মেরুদণ্ড শুধু নয় দেশের সব থেকে বড় উৎপাদন খাত। বর্তমানে এই কৃষিখাত একাধিক সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি– বিষয়টি অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্সের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রথমে আসে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম উৎপাদনশীলতা, কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস এবং কৃষিপন্য রপ্তানি সক্ষমতার অভাবের মতো চ্যালেঞ্জগুলো দিন দিন কৃষিখাতকে দুবর্ল করে একটি জটিলতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
এই বিষয়গুলো “সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির পুনঃকৌশল ও সম্পদ সংগ্রহ সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্সের প্রতিবেদন”-এ উল্লেখ করা হয়েছে, যা পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) হস্তান্তর করেছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাচ্ছে।
বর্তমানে, এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫%, যা ১৯৯০-এর দশকে ছিল ৪.৫%। তুলনামূলকভাবে, ভারতে এই হার ২.৯%, পাকিস্তানে ২.৭% এবং ভিয়েতনামে ২.৮%।
উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, জমির পরিমাণ হ্রাস এবং নতুন প্রযুক্তির সীমিত গ্রহণের কারণে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫% কৃষিতে নিয়োজিত, তবে তরুণ প্রজন্মের শহরমুখী হওয়ার ফলে শ্রমিকের ঘাটতি তীব্রতর হচ্ছে।
বর্তমানে, দেশের প্রতি হেক্টরে মাত্র ৫০% কৃষক যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যবহার করেন, যেখানে ভারতে এই হার ৮০%। শ্রমিকের ঘাটতির কারণে ধান ও পাট চাষের হ্রাস দেশকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের ফসল ক্ষতি করে। তাপমাত্রা মাত্র ১° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ধান উৎপাদন ৫-৭% হ্রাস পেতে পারে, যা কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি বাড়াবে এবং খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে।
সেচ কভারেজের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ ৫৮% এ দাঁড়িয়েছে, যেখানে ভারতে ৪৮%, পাকিস্তানে ৫০% এবং ভিয়েতনামে ৬৫%। হেক্টরপ্রতি ২৩৬ কেজি সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও, সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায় ভিয়েতনাম ও ভারতের থেকে পিছিয়ে।
প্রতিবেদনে এই ফাঁক পূরণের জন্য উন্নত সেচ ও সার ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ফসল কাটার পর ক্ষতি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যেখানে পর্যাপ্ত সংরক্ষণ অবকাঠামোর অভাবে ২৫% পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়। বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানি ২.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ভিয়েতনামের ৪০ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক কম।
রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার গুরুত্বের উপর প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে।
ভারত উন্নত প্রিসিশন ফার্মিং, ভিয়েতনাম স্মার্ট সেচ এবং পাকিস্তান ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রয়োগ করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ এখনও প্রধানত ঐতিহ্যবাহী ধান চাষের উপর নির্ভরশীল। এর বিপরীতে, ভারত ও ভিয়েতনাম ফল, সবজি এবং মাছ চাষে বৈচিত্র্য এনেছে।
এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায়, টাস্ক ফোর্স কয়েকটি সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ভর্তুকি এবং সহজ শর্তে ঋণের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধি।
ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বাজার সংযোগ উন্নত করা, সংরক্ষণ ও রপ্তানি নীতিমালার সংস্কার এবং লবণ-সহনশীল ও খরা-প্রতিরোধী ফসলের চাষ সম্প্রসারণও প্রধান প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে।
প্রতিবেদনে খাতকে শক্তিশালী করতে উচ্চ ফলনশীল বীজ, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে অনেক কৃষি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকারি ভর্তুকি ও কৃষি ঋন সহজ করার মতো সুপারিশ অনেকটা পুরোনো দিনের ধারনা। বর্তমানের প্রযুক্তি ও মুক্ত অর্থনীতির যুগে এটা খুব বেশি কার্যকর নয়। বরং বিষয়টিতে এখন কর্পোরেট সিস্টেম ও মুক্ত অর্থনীতির হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে তার আগে গত কয়েকমাস যাবত যেভাবে দেশে একটি কর্পোরেট বিরোধী ধ্যান ধারনা স্টাবলিশ হচ্ছে তা আগে দূর করে নিতে হবে।
Leave a Reply