নাঈম হক
ছোট্ট একটি পাখির ছবিকে ঘিরে ২০০৮ সালে বেশ শোরগোল পড়লো। ছবিটি ছিলো ব্রিটিশ দশ পাউন্ডের নোটে ডারউইনের ছবির ঠিক সামনে, হামিংবার্ড পাখির (hummingbird)। ওড়াউড়ির সময় হাম হাম অর্থাৎ গুনগুন শব্দ হয় বলে এই পাখির এই ইংরেজি নাম হয়েছে। বাংলাতে আমরা একে আদর করে ‘গুনগুন পাখি’ বলে ডাকবো।
(ছবি লেখকের তোলা)
ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড এই নোটটি ছাপে ডারউইনের প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত গালাপোগাস দ্বীপে গবেষণামূলক যাত্রার অবদানকে স্মরণ করার জন্য। কিন্তু ডারউইনের বদলে গুনগুন পাখিকে নিয়ে হৈহট্টগোল ব্যাঙ্কের এই মহান প্ল্যানকে কিছুটা বিস্বাদ করে দেয়। অবশ্য এই হৈচৈয়ের দুটো কারণ ছিলো। যেমন: প্রথমতঃ গুনগুন পাখি বিলাতে এমনকি ইউরোপ মহাদেশে বাস করে না। এদের দেখা মেলে শুধু নতুন-বিশ্বে (new world), অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিন অ্যামেরিকা মহাদেশ দুটোতে।
(উত্তর অ্যামেরিকায় লেখকের তোলা গুনগুন পাখির ছবি)
(উত্তর অ্যামেরিকায় লেখকের তোলা গুনগুন পাখির ছবি)
১৪৯২ সালের একুশে অক্টোবর, ইউরোপ থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বাহামা দ্বীপে পৌঁছানোর নয় দিনের মাথায়, ক্রিস্টোফার কলোম্বাস তার ডাইরীতে লেখেন, “ছোট্ট পাখিগুলো … আমাদের (পাখিগুলোর) থেকে একেবারে ভিন্ন রকমের এবং এরা এক বিস্ময়কর (পাখি)”। এটি ছিলো গুনগুন পাখি সম্বন্ধে প্রথম ইউরোপীয়ানের মন্তব্য।
কলোম্বাস নিঃসন্দেহে গুনগুন পাখি দেখে মুগ্ধ বিহবল হয়েছিলেন হবেন না কেন? তার সাথে বাহামা দ্বীপের দৈশিক আদিনিবাসী টাইনো জাতির মোলাকাত হয়েছিলো। দেখেছিলেন যে টাইনোরা পরম শ্রদ্ধার চোখে গুনগুন পাখিকে বলতো অমর্ত্য প্রাণ/আত্মা (sky spirit), দিব্য/অমর্ত্য ইন্দ্রজাল পাখি (magic sky bird), পাখিদেব (god bird), এবং অরুণদেব পাখি (sungod bird) ইত্যাদি।
শুধুমাত্র টাইনো জাতি নয়, নতুন-বিশ্বের অন্যান্য আদিবাসীদের, যেমন: মায়া, আজটেক, ইত্যাদিদের কাছেও গুনগুন পাখি ছিলো দেবতাতুল্য পবিত্র অন্তরীক্ষ পাখি। গোত্রের নেতাদের কানের দুল এবং পোশাকের উপকরণ তৈরী করতে মৃত গুনগুন পাখির পালক ব্যবহার হতো।
কলোম্বাস খুব সম্ভব মৃত গুনগুন পাখি নিয়ে ইউরোপে ফেরত যান। নতুন-বিশ্বের আদি দেশজবাসীদের মতোই ইউরোপীয়রাও গুনগুন পাখির মায়াজালে পড়ে যান। বিশেষ করে ইউরোপের অভিজাত মহিলাদের কাছে গুনগুন পাখি হয়ে ওঠে ফ্যাশন এবং সামাজিক পদ মর্যাদার প্রতীক। গুনগুন পাখির পালক দিয়ে তাদের মাথার টুপি, হ্যান্ড ব্যাগ, হাতের পাখা এবং গাউনের ডেকোরেশনের চাহিদা মেটাতে লাখ লাখ নিরীহ গুনগুন পাখি হত্যা করে নতুন-বিশ্ব থেকে ইউরোপে চালান পাঠানো হতো।
ইউরোপের অভিজাত মহিলাদের মতো বিজ্ঞানীরাও গুনগুন পাখির মোহে পড়েন।
ষোলশো শতাব্দীতে, পাল তোলা জাহাজে চেপে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নতুন-বিশ্ব থেকে ইউরোপে যেতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যেতো। এই লম্বা টানা যাত্রা সহ্য করা গুনগুন পাখির পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিলো না। ফলে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা মৃত গুনগুন পাখি দিয়েই তাদের বৈজ্ঞানিক কৌতুহল নিবারণ করতেন।
দ্বিতীয় কারণনটি হলো: গুনগুন পাখি, ইউরোপের বিঞ্জান মহলের সুপার স্টার হলেও, ডারউইনের মনোযোগ আর্কষন করতে পারেনি। তার বিশ্বখ্যাত “অরিজিন অফ স্পেসিস” গ্রন্থটিতে গুনগুন পাখির কোনো উল্লেখ নেই। ডারউইনকে অবশ্য পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। গালাপোগাস দ্বীপে গবেষণার কাজ, যা ছিলো ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বিকাশলাভের মূলভিত্তি সেই দ্বীপে গুনগুন পাখি বাস করে না।
এসব কারণের জন্য, দশ পাউন্ডের নোটে গুনগুন পাখির ছবিকে ঘিরে যে শোরগোলের বা বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তার সুরাহা করতে গিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক স্টীভ জোন বলেন যে “বর্তমান দশ পাউন্ডের ব্যাঙ্কনোটে গুনগুন পাখির ছবি দেয়াটা হয়েছে মস্ত বড়ো ভুল।”
নাঈম হকের নেশা হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে প্রকৃতির ছবি তোলা। লেখক ‘বোম্বেএ ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’ এবং ‘ওয়াশিংটন এন্টোমোলোজি সোসাইটি’র আজীবন সদস্য।
Leave a Reply