নিজস্ব প্রতিবেদক
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ক্ষুদ্র খামারিরা অর্থের সংস্থান, আধুনিক প্রযুক্তি ও পশুচিকিৎসা সেবার মতো বিষয়গুলোতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। এর পাশাপাশি কৃষি ও গবাদিপশু বীমার ওপর ১৫% ভ্যাট আরোপের ফলে খামারিদের বীমার ব্যয় বেড়ে গেছে। গবাদিপ্রাণি ও কৃষি বীমার ক্ষেত্রে এই ভ্যাট মওকুফ করা হলে আরো বেশি সংখ্যক প্রান্তিক মানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
ক্ষুদ্র চাষি ও খামারিদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির ‘লাইভস্টক গ্রো ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘গবাদিপ্রাণি সুরক্ষা বীমা’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেছেন। সোমবার ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান ড. এম. আসলাম আলম। এতে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেনা ইন্স্যুরেন্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম। এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (বাজেট, হিসাব ও নিরীক্ষা) ড. এ বি এম সাইফুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দেলোয়ার হোসেন এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) পরিচালক (ফিন্যান্স, ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ও হিসাব বিভাগ) কে. এ. এম. এম. রইসুল ইসলাম। ব্র্যাক মাইক্রোফাইনান্স কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক অরিঞ্জয় ধর অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং সহযোগী পরিচালক মোঃ বেলায়েত হোসেন ব্র্যাকের মাইক্রোইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, ব্যবসা এবং জনকল্যাণ পরস্পরবিরোধী নয়। তিনি উল্লেখ করেন, ব্র্যাক এটি প্রমাণ করেছে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসার শুরুতে কিছুটা ঝুঁকি, বিনিয়োগ ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্প্রসারণযোগ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হয়ে ওঠে। এটি সম্ভব করতে হলে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আসার আগে সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করতে হবে। ব্র্যাকের সামাজিক উদ্যোগ যেমন পোলট্রি, বীজ, ডেইরি এবং আড়ং তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষুদ্র বিমা খাতকে বিকশিত করতে হলে, একে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) হিসেবে না দেখে একটি টেকসই ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ চ্যানেল ব্যবহার করা হবে।
স্বাগত বক্তব্যে অরিঞ্জয় ধর বলেন, মাইক্রোফাইন্যান্স মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করে, আর বীমা নিশ্চিত করে তারা যেন সেই অবস্থানেই টিকে থাকতে পারে। এটি এক ধরনের নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করে, যা দারিদ্র্যের ধাক্কা সামলে উঠতে সহায়তা করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে ব্র্যাকের মাইক্রোইন্স্যুরেন্সের পণ্যগুলো সাজানো হয় বলে তিনি জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. এম. আসলাম আলম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন ইনস্যুরেন্স কাভারেজ এবং এর নিম্নমুখী প্রবণতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নের পথ শুরু করতে হবে মাইক্রোইনস্যুরেন্স দিয়ে। কৃষি বা গবাদিপ্রাণি বীমার মতো নতুন বিষয়গুলোর জন্য নীতিগত সংস্কার বা স্বতন্ত্র মাইক্রোইনস্যুরেন্স সংস্থা গঠন করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম বলেন, কৃষকদের বীমা সুবিধার আওতায় এনে তাদের ক্ষমতায়ন করতে পেরে আমরা গর্বিত। বীমার গ্রহণযোগ্যতা ও অভিযোজন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে সরকার, বীমা প্রতিষ্ঠান ও অংশীদারদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
ড. এ বি এম সাইফুজ্জামান বলেন, গবাদিপশু বীমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং এর বাস্তবায়নের বাধাগুলো দূর করতে সরকারি ও বেসরকারি সকল অংশীদারের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা আরো বাড়াতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক ও বীমা সংক্রান্ত চাহিদা পূরণে এনজিওগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোফাইন্যান্স ও মাইক্রোইনস্যুরেন্সের সমন্বিত প্রয়োগ একটি কার্যকর সমাধান সৃষ্টি করতে পারে। এই উদ্যোগটি আরও সম্প্রসারিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কে. এ. এম. এম. রইসুল ইসলাম বলেন, বীমা শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে। পাশাপাশি, গবাদিপশু বীমায় চুরির ঝুঁকির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘গবাদিপ্রণি সুরক্ষা বীমা’ উদ্যোগটি ক্ষুদ্র খামারিদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির ফলে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি কমাতে সাহায্য করবে। এর আওতায় দুগ্ধ উৎপাদন ও গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে যুক্ত কৃষকরা আর্থিক সহায়তা এবং পশুচিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন যা তাদের উৎপাদনশীলতা এবং আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়াবে। এই কর্মসূচির আওতায় গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসেবার জন্য টেলিমেডিসিন সেবা এবং দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে ঘাসের বীজ সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে।
Leave a Reply